জিরাফের ব্লাড প্রেশার

জিরাফের ব্লাড প্রেশার

হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। মানুষের নয়, জিরাফের ব্লাডপ্রেশার । ভাবছেন তো জিরাফেরও আবার ব্লাড প্রেশার হয় ! আলবাত হয় ! ব্লাড থাকলে তার প্রেশার তো থাকবেই , সুতরাং জিরাফের ও যে ব্লাড প্রেশার থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন নিশ্চয়ই ভাবছেন তো এত প্রাণী থাকতে জিরাফের ব্লাড প্রেশার নিয়েই কেন আলোচনা রে বাবা! আছে আছে কারণ তো একটা আছেই। নাহলে এত নায়কোচিত প্রাণী থাকতে সাতে পাঁচে না থাকা প্রাণীটা বা বলা ভালো প্রাণীটার ব্লাড প্রেশার নিয়েই বা আলোচনা কেন ! আসলে জিরাফ তার দেহে রক্ত চাপ বা ব্লাড প্রেশার এত অসামান্য কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে যে তা দেখে মানুষের হৃদপিন্ড নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা তো থ! কিন্তু কি এমন বৈশিষ্ট্য দেখলেন তাঁরা জিরাফের দেহে ?

জিরাফের ব্লাড প্রেশারের বৈশিষ্ট্য বোঝার আগে মানুষের ব্লাড প্রেশারের চরিত্রটা একটু বুঝে নেওয়া যাক। একজন সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক রক্তচাপ হল ১২০/৮০ (মিলিমিটার পারদ) বা তার কম। ১৪০/৯০ এর বেশি প্রেশার থাকলে কোন ব্যক্তির তাঁর স্টেজ -১ হাইপারটেনশন আছে ধরে নেওয়া হয় এবং ১৬০/১০০ বা এর বেশি থাকলে সেই ব্যক্তির স্টেজ -২ হাইপারটেনশন আছে ধরে নেওয়া হয় যা তাঁর মস্তিস্ক, হৃদপিন্ড, চোখ এবং কিডনির জন্য ভীষণ পরিমাণে বিপজ্জনক। এই যখন মানুষের রক্তচাপের অবস্থা সেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক পনেরো থেকে আঠেরো ফুট উচ্চতার একটি জিরাফের সর্বোচ্চ রক্তচাপ ওঠে ৩০০/১৮০ (মিলিমিটার পারদ) । এই বিপুল পরিমাণ রক্তচাপ সত্ত্বেও জিরাফের শারীরিক কোন ক্ষতি হয়না। কিন্তু কেন ? সেটাই আজ জানবো।

বিভিন্ন শারীরিক ভঙ্গিমায় থাকাকালীন জিরাফের রক্তচাপ মস্তিষ্কে এবং হৃদপিণ্ডে

যেকোন স্থলজ প্রাণীর তুলনায় জিরাফের গলা অনেকটাই যে লম্বা সেটা আমরা সকলেই জানি। হৃদপিণ্ড থেকে জিরাফের মস্তিষ্কের মাঝের ব্যবধান প্রায় ছয় ফুট। অর্থাৎ হৃদযন্ত্র প্রতিবার স্পন্দনে জিরাফের মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছতে ছয় ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় যেমন তেমনি হৃদপিণ্ড থেকে সারা দেহে রক্তকে ছড়িয়ে পড়তে প্রায় আঠারো ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এই বিপুল পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করে রক্তকে মস্তিষ্ক তথা জিরাফের সারা দেহে ছড়িয়ে দিতে গেলে কি সাংঘাতিক চাপ পড়ে জিরাফের হৃদপিণ্ডের ওপর সেটা আমরা মানুষরা কল্পনাও করতে পারি না। এই বিপুল পরিমাণ রক্তচাপ(মানুষের সর্বোচ্চ রক্তচাপ সীমার দ্বিগুণ প্রায়) সত্ত্বেও যে জিরাফ কিন্তু অজ্ঞান হয়ে যায়না। জিরাফ প্রায় সারাক্ষণই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তারপরেও এই প্রবল রক্তচাপে জিরাফের মাথাও ঘোরে না আর অজ্ঞানও হয় না কারণ জিরাফের হৃদপিণ্ড থেকে মস্তিষ্ক অবধি হৃদপেশীর মধ্যে কিছু অসামান্য তথা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক তথা দার্শনিক গ্যালেন যার নাম দিয়েছিলেন – ‘রিট মিরাবিল’ (rete mirabile) অর্থাৎ – অত্যাশ্চর্য জাল। জিরাফের শিরা ধমনীর যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জাল সারা দেহে ছড়িয়ে আছে তা এতই নিয়ন্ত্রিত ভাবে রক্তকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় যে জিরাফ মাথা নিচু করে জল পান করবার সময়ে রক্তচাপ ৩০০/১৮০ উঠে গেলেও জিরাফ কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারায় না। রক্তচাপের এই ভারসাম্য রক্ষায় অবশ্য হৃদপেশী বিভিন্ন কপাটিকার ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এই যে একটা অস্বাভাবিক রক্তচাপ (৩০০/১৮০) এটা কিন্তু জিরাফের মস্তিষ্কে থাকেনা বিশেষ করে জিরাফ যখন মাথা নিচু করে জল পান করে কিংবা মাথা উঁচু করে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে খায়। মস্তিষ্কে মানুষের সমানই রক্তচাপ থাকে। এই বিপুল রক্তচাপ থাকে জিরাফের হৃদপিণ্ডের কাছে। হৃদপিণ্ড পাম্প করে যখন রক্তকে ঠেলে মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যে পাঠায় তখন প্রাথমিক রক্তচাপ থাকে সাংঘাতিক। এই প্রবল রক্তচাপ জিরাফের ঘাড়ে থাকা ধমনীর মাধ্যমে যখন মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে যাত্রাপথে বিভিন্ন কপাটিকার মাধ্যমে তার চাপ নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। শেষ অবধি যখন রক্ত মস্তিষ্কে এসে পৌঁছয় তখন মানুষের মস্তিষ্কের রক্তচাপের সমান জিরাফের মস্তিষ্কের রক্তচাপ এসে দাঁড়ায়। এছাড়াও জিরাফের ঘাড়ে থাকা কপাটিকাগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে। জিরাফ যখন মাথা নিচু করে জল পান করে তখন কিন্তু হৃদপিণ্ড থেকে পাম্প করা ওই প্রবল চাপে রক্ত জিরাফের মাথায় উঠে যায় না বিশেষত এই কপাটিকাগুলির জন্য যা রক্তকে মাধ্যাকর্ষণের ডাকে সাড়া দিয়ে মাথায় উঠতে দেয় না শুরুতেই আটকে দেয়। অন্যদিকে জিরাফের সুদীর্ঘ চার পায়ের পেশিতে থাকা বিশেষ কপাটিকা সেও রক্তকে পায়ের দিকে ছুটে যাওয়া থেকে আটকে দেয়। ফলত জিরাফও আরাম করে তার তৃষ্ণা মেটায়।

আপনার মতামত জানান