টার্নার সিন্ড্রোম

টার্নার সিন্ড্রোম

মানুষের দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার পরিবর্তন ঘটলে কিংবা ক্রোমোজোমের গঠনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই ধরনের একটি অস্বাভাবিকতার নাম ‘ টার্নার সিন্ড্রোম ’ (Turner’s syndrome)। বিজ্ঞানী হেনরি টার্নার (Henry Turner) ১৯৩৮ সালে এই রোগ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন।

মানুষের দেহকোষে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। তার মধ্যে ৪৪টি হল অটোজোম বা দেহ ক্রোমোজোম এবং ২টি হল অ্যালোজোম বা সেক্স ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমোজোম দুটির নাম হল X ক্রোমোজোম এবং Y ক্রোমোজোম। মহিলাদের শরীরে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে এবং পুরুষদের শরীরে থাকে একটি X ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম। এখন যদি কোন জিনগত ত্রুটি বা মিউটেশনের জন্য কোনো মহিলার শরীরে দুটির পরিবর্তে একটি X ক্রোমোজোম তৈরি হয়, অর্থাৎ তার শরীরে ৪৬টির পরিবর্তে ৪৫টি ক্রোমোজোম থাকে, তবে সে শারীরিকভাবে নারী হয় কিন্তু তার শরীরে অনেকরকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই অস্বাভাবিকতাগুলিকেই একত্রে বলা হয় ‘টার্নার সিন্ড্রোম’। প্রতি ৩০০০জন কন্যা শিশু জন্মালে তার মধ্যে একজনের এই রোগ দেখা যায়।

টার্নার সিন্ড্রোমের বিভিন্ন কারণগুলি হল —

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মনোজোমি (monosomy) :- একটি X ক্রোমোজোমের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি সাধারণত বাবার শুক্রাণু বা মায়ের ডিম্বাণুতে ত্রুটির কারণে ঘটে। এর ফলে শরীরের প্রতিটি কোষে একটি মাত্র X ক্রোমোজোম থাকে।

মোজাইকিজম (mosaicism) :-  কিছু ক্ষেত্রে, ভ্রূণের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কোষ বিভাজনে একটি ত্রুটি ঘটে। এর ফলে শরীরের কিছু কোষে X ক্রোমোজোমের দুটি সম্পূর্ণ কপি থাকে। অন্যান্য কোষে X ক্রোমোজোমের একটি মাত্র কপি থাকে।

X ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা :- X ক্রোমোজোমের একটির মধ্যে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে বা কিছু অংশ অনুপস্থিত থাকতে পারে । এক্ষেত্রে কোষগুলির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ এবং একটি অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম রয়েছে৷ এই ত্রুটিটি শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে ঘটতে পারে যেখানে সমস্ত কোষের একটি সম্পূর্ণ এবং একটি অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম রয়েছে। অথবা ভ্রূণের প্রাথমিক বিকাশে কোষ বিভাজনে ত্রুটি ঘটতে পারে যাতে শুধুমাত্র কিছু কোষে দুটি X ক্রোমোজোমের মধ্যে একটির অস্বাভাবিক বা অনুপস্থিত অংশ থাকে (মোজাইকিজম)।

Y ক্রোমোজোমের অংশ :-  এই রোগের খুব অল্প শতাংশে দেখা যায়, কিছু কোষে একটি X ক্রোমোজোম থাকে এবং অন্য কোষগুলিতে একটি X ক্রোমোজোমের সঙ্গে Y ক্রোমোজোমের কিছু অংশ থাকে। এই ব্যক্তিরা জৈবিকভাবে মহিলা হয়, তবে Y ক্রোমোজোম উপাদানের উপস্থিতি গোনাডোব্লাস্টোমা (gonadoblastoma) নামে এক ধরণের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

    টার্নার সিন্ড্রোমের সবথেকে পরিচিত লক্ষণগুলি হল —

জন্মের আগে :-  গর্ভবতী মায়ের আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার সময় শিশুর টার্নার সিন্ড্রোমের কিছু লক্ষণ ধরা পড়ে, যেমন,

• শিশুর ঘাড়ের পিছন দিকে এবং আরও নানান জায়গায় অস্বাভাবিকভাবে জমা হওয়া তরল।

• হৃৎপিন্ডের অস্বাভাবিকতা।

• অস্বাভাবিক কিডনি।

জন্মের পরে এবং শৈশব অবস্থায়  :- 

• বাঁকা ঘাড় এবং ছোট কান

• চওড়া বুক এবং স্তনবৃন্ত অনেক দূরে দূরে অবস্থিত।

• কনুইয়ের ভাঁজ উল্টোদিকে।

• হাত ও পায়ের আঙুল ছোট এবং সরু। উপরদিকে বাঁকানো থাকে।

• হৃৎপিন্ডের অস্বাভাবিক অবস্থা ইত্যাদি।

বয়ঃসন্ধিকালে এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় :- 

• বয়সের অনুপাতে বৃদ্ধির হার কম।

• মানসিক দিক দিয়ে খাটো বুদ্ধিযুক্ত।

• গৌণ যৌনলক্ষণ অনুপস্থিত।

• মাসিক ঋতুস্রাব দেখা যায় না। 

• ডিম্বাশয় সাধারণত থাকে না, আর থাকলেও খুবই অনুন্নত।

• মাথার চুল ছোট হয়, যৌনকেশ গঠিত হয় না।

• গায়ে অনেক বাদামী দাগ থাকতে পারে।

• জনন ক্ষমতা থাকে না।

এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন:

ক হৃৎপিন্ডের সমস্যা:- এক্ষেত্রে জন্মগত ভাবে হৃদপিন্ডে গঠনগত ত্রুটি দেখা যায়। 

খ . উচ্চরক্তচাপ:- রোগীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্তচাপ খুব বেশি হয়।

গ দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি হ্রাস:- স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য এই রোগে দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি কমে যেতে থাকে।

ঘ. কিডনির সমস্যা:- প্রায় সব ক্ষেত্রেই কিডনির সমস্যা এবং মূত্রনালীতে সংক্রমণ দেখা যায়।

ঙ. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস:- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার জন্য এই রোগের পাশাপাশি আরও অন্য রোগ দেখা দিতে পারে, যেমন- ডায়াবেটিস, সিলিয়াক রোগ (celiac disease) এবং প্রদাহজনক পেটের রোগ (inflammatory bowl disease)।

চ. হাড়ের সমস্যা:- এই রোগীদের হাড়ের গঠন বাঁকা ও কমজোরী হয়।

ছ. মানসিক সমস্যা:- এই রোগ হলে রোগীদের মানসিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না এবং এরা কোন জিনিস শিখতে অনেক বেশি সময় নেয়।

জ. গর্ভকালীন সমস্যা:- বেশিরভাগ টার্নার সিন্ড্রোমের রোগীই বন্ধ্যা হন। জননক্ষমতা থাকলেও অনেক রকম সমস্যা দেখা যায়।

উপরিউক্ত লক্ষণগুলি দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা কিছু পরীক্ষা করেন, যেমন,

জন্মের আগে করা জেনেটিক পরীক্ষা একজন ডাক্তারকে টার্নার সিন্ড্রোম নির্ণয় করতে সাহায্য করতে পারে। অবস্থা ক্যারিওটাইপিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয় । প্রসবপূর্ব পরীক্ষার সময়, ক্যারিওটাইপিং শনাক্ত করতে পারে যে মায়ের ক্রোমোজোমে কোন জেনেটিক অস্বাভাবিকতা আছে কিনা।

ডাক্তার টার্নার সিন্ড্রোমের শারীরিক লক্ষণগুলি দেখার পর যেসব পরীক্ষা করতে বলতে পারেন তার মধ্যে থাকতে পারে: 

• যৌন হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য রক্ত পরীক্ষা

• হার্টের ত্রুটি পরীক্ষা করার জন্য ইকোকার্ডিওগ্রাম

• পেলভিক পরীক্ষা

• পেলভিক এবং কিডনি আল্ট্রাসাউন্ড

• বুকের এমআরআই

টার্নার সিন্ড্রোমের বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে, যেমন:

X ক্রোমোজোমের মনোজোমি :- প্রতিটি কোষে দুটির পরিবর্তে একটি X ক্রোমোজোম থাকে। এই রোগে আক্রান্ত প্রায় ৪৫% লোকের এই ধরনের টার্নার সিন্ড্রোম দেখা যায়। এটি মায়ের ডিম্বাণু বা বাবার শুক্রাণু থেকে আসে যা যথেচ্ছভাবে (randomly) X ক্রোমোজোম ছাড়াই তৈরি হয়। নিষিক্তকরণের পরে, শিশুর কোষেও এই ত্রুটি থাকে।

মোজাইক টার্নার সিন্ড্রোম :– এই ধরনের টার্নার সিন্ড্রোম প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে দেখা যায়। শিশুর কিছু কোষে এক জোড়া X ক্রোমোজোম থাকে, অন্যান্য কোষে শুধুমাত্র একটি থাকে। এটি গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে কোষ বিভাজনের সময় যথেচ্ছভাবে ঘটে।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত টার্নার সিন্ড্রোম:- খুবই বিরল ক্ষেত্রে, শিশুদের উত্তরাধিকারসূত্রে এই রোগ পাওয়া যেতে পারে, যার অর্থ তাদের বাবা অথবা মা অথবা দুজনেই এটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এটি নিয়েই বড় হয়েছেন। এটি সাধারণত X ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতির কারণে ঘটে। তবে এই ধরনের ঘটনা একেবারেই বিরল, কারণ এই রোগে আক্রান্ত স্ত্রীলোকের জনন ক্ষমতা প্রায় থাকে না। 

এই রোগের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে যে সব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় সেগুলি হল, 

হিউম্যান গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ :- হিউম্যান গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ করলে রোগীর উচ্চতা বাড়তে পারে। তবে এই চিকিৎসা খুব ছোট থেকে শুরু করতে হয়। উপযুক্ত সময়ে শুরু হলে এই পদ্ধতিতে রোগীর উচ্চতা কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে।

ইস্ট্রোজেন থেরাপি  :- প্রায়শই, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ইস্ট্রোজেন প্রয়োজন হয়, এটি হল একটি যৌন হরমোন। এই ধরনের হরমোন থেরাপি মেয়েদের স্তন সুগঠিত করতে এবং মাসিক ঋতুচক্র শুরু করতে সাহায্য করতে পারে। এটি তাদের জরায়ুকে একটি সাধারণ আকারে বাড়াতেও সাহায্য করতে পারে। ইস্ট্রোজেন প্রতিস্থাপন মস্তিষ্কের বিকাশ, হৃৎপিন্ডের কার্যকারিতা, লিভারের কার্যকারিতা এবং হাড়ের স্বাস্থ্যকেও উন্নত করে।   

চক্রাকারে প্রোজেস্টেরন প্রয়োগ :-  এই হরমোনগুলি প্রায়ই ১১ বা ১২ বছর বয়সে প্রয়োগ করা হয় যদি রক্ত পরীক্ষায় ঘাটতি দেখা যায়। প্রোজেস্টেরন ঋতুচক্রকে নিয়মিত হতে সাহায্য করে। চিকিৎসা প্রায়শই খুব কম ডোজ দিয়ে শুরু করা হয় এবং তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক বয়ঃসন্ধির অনুকরণে বৃদ্ধি করা হয়।

এই রোগকে আগে থাকতে আটকানো যায় না। এটি ঘটে যখন এলোমেলোভাবে কোষ বিভাজনের সময় অসম্পূর্ন X ক্রোমোজোমের সৃষ্টি হয়। বাবা-মায়েরা এই রোগ আটকানোর জন্য আগে থাকতে কিছুই করতে পারেন না। যদিও সাধারণত টার্নার সিন্ড্রোম রোগীর জীবনকাল স্বল্প হয়, তবু উপযুক্ত চিকিৎসা সঠিক সময়ে হলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।

তথ্যসূত্র


  1. ‘উচ্চতর জীববিদ্যা', দ্বাদশ শ্রেণী, সাঁতরা প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ, বংশগতি ও বিভেদ, পৃষ্ঠা ২৪৯, ২৫১, ২৫২
  2. https://www.mayoclinic.org/
  3. https://my.clevelandclinic.org/
  4. https://www.healthline.com/

One comment

আপনার মতামত জানান