গণেশ চতুর্থী বা ‘গণেশোৎসব’ হিন্দুদের একটি অন্যতম উৎসব। হিন্দু দেবতা গণেশের বাৎসরিক পূজা উপলক্ষে এই উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে অন্যতম শিব ও পার্বতীর পুত্র গজানন বা গণেশ। গণেশ বুদ্ধি, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের সর্বোচ্চ দেবতা। তিনি বিঘ্ন নাশক এবং সিদ্ধিদাতা। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই দিন গণেশ তাঁর ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন। তাই এই বিশেষ তিথিতে গণেশ আরাধনা প্রচলন রয়েছে।
‘গণেশ উৎসব’ বা ‘গণেশ চতুর্থী’ ছাড়াও এই উৎসব বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। সংস্কৃত, কন্নড়, তামিল ও তেলুগু ভাষায় এই উৎসব ‘বিনায়ক চতুর্থী’ বা ‘বিনায়ক চবিথি’ নামেও পরিচিত। কোঙ্কণি ভাষায় এই উৎসবের নাম ‘চবথ’। অন্যদিকে নেপালি ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় ‘চথা’।
হিন্দু মত অনুযায়ী, গণেশ চতুর্থীর দিন সিদ্ধিদাতা গণেশ কৈলাস পর্বত থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন তাঁর ভক্তদের প্রার্থনা পূরণ করার উদ্দেশ্যে। এই বিশেষ দিনটিকে গণেশের জন্মদিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই বলা যায়, সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্মোৎসব রূপেও পালিত হয় এই উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে গণেশের পুজো হওয়া বিধেয়। সাধারণত এই দিনটি ২০ আগস্ট থেকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনও এক দিন পড়ে। দশদিনব্যাপী গণেশোৎসবের সমাপ্তি হয় অনন্ত চতুর্দশীর দিন। “ভাদ্রপদ শুক্লপক্ষ চতুর্থী মধ্যাহ্নব্যাপিনী পূর্বাবিদ্ধ” –এই পুজোর প্রশস্ত সময়। তাই কখনো চতুর্থী দু’দিন পড়লে আগের দিন পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এমনকী দ্বিতীয় দিন মধ্যাহ্নের পুরোটাই যদি চতুর্থী থাকে তবুও আগের দিন মধ্যাহ্নে ২৪ মিনিট (এক ঘটিকা) চতুর্থী থাকলেই সে দিনই গণেশ পুজো হয়।
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী গণেশ হর-পার্বতীর পুত্র। তাঁর রূপ বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে বিভিন্ন প্রকার। তবে সর্বত্রই তিনি গজমুণ্ডধারী মনুষ্যাকার দেবতা। তাঁর বাহন মূষিক বা ইঁদুর; অথবা কোনও কোনও স্থলে সিংহ। গণেশকে সর্ববিঘ্নহন্তা মনে করা হয় যে কারণে তাঁর আরেক নাম বিঘ্নেশ বা বিঘ্নেশ্বর। তিনি শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক, এবং মহাবল, মেধা ও বুদ্ধির দেবতা। পুজো ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় গণেশের পুজো সর্বাগ্রে করা কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। লেখার সময় তাঁকে অক্ষরের পৃষ্ঠপোষকরূপে আবাহন করার রীতি আছে।
গণেশের অনেকগুলো নাম আছে- গণপতি, বিনায়ক, মহাগণপতি, বিরিগণপতি, শক্তিগণপতি, বিদ্যাগণপতি, হরিদ্রাগণপতি, উচ্ছিষ্টগণপতি, লক্ষ্মীবিনায়ক, হেরম্ব, বক্রতুণ্ড, একদন্ত, মহোদর, গজানন, লম্বোদর, প্রভৃতি। দুর্গা(অম্বিকা) এবং চামুণ্ডা, এই দুজনে গণেশকে পালন করেছিলেন বলে তিনি দ্বৈমাতুর নামেও অভিহিত হন। মারাঠি ভাষায় তাঁকে বলা হয় বলা হয় ‘বিনায়ক’, ‘বিঘ্নেষ’, ‘বিঘ্নেশ্বর’। তামিল ভাষায় দুটি জনপ্রিয় নাম হল ‘পিল্লাই’ ও ‘পিল্লাইয়ার’।
বর্মি ভাষায় গণেশ ‘মহা পেইন্নে’। থাইল্যান্ডে গণেশের জনপ্রিয় নামটি হল ‘ফ্রা ফিকানেত’। শ্রীলঙ্কার সিংহল বৌদ্ধ অঞ্চলগুলিতে গণেশ ‘গণ দেবিয়ো’ নামে পরিচিত।
পুরাণ অনুযায়ী গণেশ পাঁচ রাক্ষসকে নিধন করেন- অহন্তাসুর (অহমের প্রতীক), মায়াসুর (মায়ার প্রতীক), লোবাসুর (লোভের প্রতীক), কামাসুর (কামের প্রতীক) এবং ক্রোধাসুর (ক্রোধের প্রতীক)।
তবে গণেশ চতুর্থীর দিন চাঁদের দিকে তাকাতে বারণ করা হয়। কথিত আছে, চন্দ্রদেব নাকি গণেশের গজমুখ দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে গণেশ ঠাকুর চাঁদকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাই কেউ যদি গণেশ চতুর্থী থেকে অনন্ত চতুর্দশী পর্যন্ত চাঁদের দিকে তাকায় তাহলে ওই ব্যক্তির জীবনে সমস্যা দেখা দেবে।
পুরাণমতে, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির সঙ্গে গণপতির বিবাহ হয়। তাঁর দুই সন্তান হল ক্ষেম ও লাভ।
পৃথক দেবতা রূপে গণেশের উদ্ভব খ্রিষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে। এছাড়াও একাধিক বৈদিক ও প্রাক-বৈদিক উৎস থেকেও গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে পাঁচ প্রধান দেবতার মধ্যে অন্যতম দেবতা রূপে গণ্য হন গণেশ। এই সময়কে গণেশকে সর্বোচ্চ দেবতা স্বীকার করে গাণপত্য সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। গণেশ সংক্রান্ত প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল ‘গণেশ পুরাণ’, ‘মুদগল পুরাণ’, ও ‘গণপতি অথর্বশীর্ষ’।
১৬৩০ সাল থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রজাদের মধ্যে জাতীয়তা বোধের উন্মেষ ঘটানোর জন্য মারাঠি শাসক ছত্রপতি শিবাজী ‘গণপতি উৎসব’-এর সূচনা করেন। এরপর ১৮৯৩ সালে লোকমাণ্য বালগঙ্গাধর তিলক প্রথম সার্বজনীনভাবে ‘গণেশ চতুর্থী’র পুজো শুরু করেন। ১৮৯২ সালে ব্রিটিশরা ভারতে সমস্ত রকম হিন্দু জমায়েত নিষিদ্ধ করেছিল। এই জনবিরোধী সমাবেশ আইনের প্রতিবাদে তিলক গণেশ চতুর্থীকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
গণেশ পুজো সমগ্র ভারতে অনুষ্ঠিত হলেও মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাত, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে এই উৎসব বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়। ভারতের বাইরে নেপালেও এই উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। শ্রীলঙ্কায় তামিল হিন্দুরাও এই উৎসব পালন করে থাকেন। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া (Australia), নিউজিল্যান্ড (New Zealand), কানাডা (Canada), মালয়েশিয়া (Malaysia) ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো ,(Trinidad and Tobago), গুয়েনা (Guyana) ফুজি (Fiji), মরিশাস (Mauritius) সাউথ আফ্রিকা (South Africa) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States) এবং ইউরোপ (Europe) প্রভৃতি বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রবাসী হিন্দুরা ‘গণেশ চতুর্থী’ পালন করেন থাকেন।
তথ্যসূত্র
- https://www.britannica.com/
- https://timesofindia.indiatimes.com/
- https://en.wikipedia.org
- https://www.ndtv.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://bn.vikaspedia.in/
- https://bengali.oneindia.com/
