জ্যোতির্লিঙ্গ ভীমশঙ্কর 

জ্যোতির্লিঙ্গ ভীমশঙ্কর 

ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরটি মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনে থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরে ভোরগিরি গ্রামের সহ্যাদ্রি পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫০০ ফুট উচ্চতায় এই মন্দিরটি অবস্থিত। এই ভীমশঙ্কর মন্দিরের চতুর্দিক সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত। সেই বিরাট অরণ্যভূমিকে ভীমশঙ্কর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণাও করা হয়েছে। এই মন্দিরেই কাছেই ভীমা নদীর উৎসস্থল রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষ উৎসব ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তেরা এই ভীমশঙ্কর মন্দির পরিদর্শনের জন্য আসেন।

শিবপুরাণ অনুযায়ী একদা ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে দুজনের তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। সেই বিবাদ সন্তোষজনক পরিণতিতে না পৌঁছে চলতেই থাকলে মহাদেব তখন একটি আলোকরশ্মির স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে প্রকট হন। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু কেউই সেই আলোকস্তম্ভের আদি ও অন্ত খুঁজে পাননি। শেষমেশ তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দিব্য জ্যোতিই শ্রেষ্ঠতম। এভাবেই জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণাটির উদ্ভব হয়।

বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হল ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ। এই জ্যোতির্লিঙ্গকে ঘিরে নানারকম কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। শিবপুরাণ অনুযায়ী, ভীম নামে এক রাক্ষস সহ্যাদ্রি পর্বতমালার সীমানায় ডাকিনি বনে তার মা কর্কটীর সঙ্গে বাস করত। এই ভীম আসলে রামায়ণে উল্লিখিত রাবণের ছোটভাই কুম্ভকর্ণের পুত্র। সে যখন জানতে পারে যে, ভগবান বিষ্ণুর অবতার রাম তার পিতাকে হত্যা করেছে তখন ভীমের ভিতরে প্রতিশোধস্পৃহা জাগ্রত হয়। রামকে হত্যা করার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং কঠোরভাবে ব্রহ্মার তপস্যা করতে থাকে। ব্রহ্মা তার তপস্যার সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশীর্বাদ দেন এবং সেই বলে বলীয়ান হয়ে ভীম দেবতাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। যুদ্ধে দেবতাদের পরাস্ত করে দেওয়ার পর তার দম্ভ এতই বেড়ে যায় যে, সে শিবভক্ত কামরূপেশ্বরকে শিবপূজা করতে নিষেধ করে। রাজা কামরূপেশ্বর সেই নিষেধ অগ্রাহ্য করলে ভীম তাকে কারাবন্দী করে রাখে এবং কামরূপেশ্বরের তৈরি শিবলিঙ্গকে তলোয়ারের আঘাতে ধ্বংস করতেও উদ্যত হয়। তখন শিব স্বয়ং সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে ভীমকে ভস্ম করে তার বিনাশ ঘটান এবং দেবতারা সেইখানেই তাঁকে অবস্থান করবার জন্য অনুরোধ করলে শিব ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অন্য কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই জ্যোতির্লিঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরাসুর নামক রাক্ষসের কাহিনির যোগ রয়েছে। তিনজন রাক্ষস একত্রে ত্রিপুরাসুর নামে পরিচিত ছিল। ত্রিপুরাসুরের কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মা খুশি হন এবং তাদের ইচ্ছানুসারেই ব্রহ্মা বর দেন যে ত্রিপুরাসুরদের কোনো দেবদেবী, যক্ষ কিংবা গন্ধর্ব কেউ হত্যা করতে পারবে না, তবে ময়দানব নির্মিত তাদের তিনটি বাসস্থানকে একত্রে কোনো দেবশক্তি যদি ভেদ করতে পারে তবেই ত্রিপুরাসুরের বিনাশ হবে। ব্রহ্মার দেওয়া সেই শক্তির অপপ্রয়োগ করে ত্রিপুরাসুর কেবল মানুষ নয়, দেবতাদের ওপরেও নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে ত্রিপুরাসুরের এই তান্ডবের হাত থেকে জগতকে মুক্ত করবার জন্য শিব এবং পার্বতী অর্ধনারী নটেশ্বর রূপে আবির্ভূত হয়ে ত্রিপুরাসুরের বিনাশ ঘটান। কার্তিক পূর্ণিমায় ত্রিপুরাসুরকে হত্যা করেছিলেন বলে সেই দিনটি ত্রিপুরারী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। কথিত আছে, অসুরকে পরাজিত করে এই সহ্যাদ্রি পর্বতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন শিব এবং যুদ্ধের পর শিবের সারা শরীর থেকে যে ঘাম ঝরেছিল তা থেকে ভীমা নদীর উৎপত্তি হয়েছিল। ভক্তরা শিবকে এই স্থানে চিরকাল বসবাস করবার জন্য করবার জন্য অনুরোধ করলে শিব ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে এখানে অবস্থান করতে থাকেন।

এই মন্দিরটি নির্মাণের পিছনে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এই জনশ্রুতি অনুসারে ত্রয়োদশ শতকে ভাটিরাও লাখধারা নামের এক কাঠমিস্ত্রী এই জ্যোতির্লিঙ্গটি আবিষ্কার করেছিলেন। যখন তিনি তাঁর কুড়ুল দিয়ে একটি গাছে আঘাত করেছিলেন তখন সেই গাছ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল। গ্রামবাসীরা সেখানে জড়ো হয়ে গাছের উদ্দেশ্যে দুধ নিবেদন করলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন গ্রামের লোকেরা সেই স্থানে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করে এবং নাম দেয় ভীমশঙ্কর মন্দির।

এই মন্দিরটির নির্মাতা কে স্পষ্টভাবে তা জানা যায় না, তবে গবেষকেরা দাবি করেছেন যে, মন্দিরের কাঠামোটি কমপক্ষে ৮০০ বছরের পুরোনো এবং এটি ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত। চিমাজি আপা নামের এক মারাঠি ব্যবসায়ী এই মন্দিরের একটি অংশ নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। পরে আঠারো শতকে মারাঠা শাসনকালে মন্দিরের কিছু অংশ সংস্কার করা হয়েছিল। পেশোয়া যুগের একজন শক্তিশালী রাজনীতিবিদ নানা ফড়নবিস মন্দিরের সভামণ্ডপ ও শিখর নির্মাণ করেছিলেন। রাজা ছত্রপতি শিবাজিও নিত্য মন্দিরে উপাসনা করতেন এবং মন্দিরের প্রভূত সংস্কারসাধন করেছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি ছাড়াও রাজারাম মহারাজ এবং পেশওয়া বালাজি বিশ্বনাথের মতো অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ভগবান শিবের এই পবিত্র মন্দির পরিদর্শন করেছেন। অন্যান্য পেশোয়া শাসক যেমন দীক্ষিত পটবর্ধন এবং রঘুনাথ রাও মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে অবদান রেখেছিলেন। বর্তমানে মন্দিরের দায়িত্ব পুনে পৌর কর্পোরেশন এবং মহারাষ্ট্র সরকারের অধীনে রয়েছে।

ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরে অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী লক্ষ করা যায়। মন্দিরটি খুব বেশি বড় নয়। মূলত গর্ভগৃহ, সভামন্ডপ এবং কূর্মমন্ডপ নিয়ে মন্দিরটি গঠিত। প্রায় আড়াইশো-তিনশো সিঁড়ি অতিক্রম করে মন্দিরে যেতে হয়। মন্দিরের প্রধান দরজাটি শক্ত কাঠের তৈরি এবং সেখানে বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। প্রবেশপথের বামদিকে ভগবান গণেশের মূর্তি এবং ডানদিকে কালভৈরবের মূর্তি লক্ষ করা যায়। মন্দিরের প্রবেশপথেই একটি বিশাল ঘন্টা চোখে পড়বে, যেটি পেশোয়া চিমাজি আপা মন্দিরকে প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও প্রবেশপথে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি রয়েছে। মোট দুটি নন্দীর মূর্তি রয়েছে মন্দিরে। মন্দিরের সামনের দিকে দেবী পার্বতীর একটি মূর্তি রয়েছে। মন্দিরটিতে প্রায় সর্বত্র ইন্দো-আর্য এবং নাগারা স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। এছাড়াও হেমাদপন্থী শৈলীর ছাপও কোথাও কোথাও স্পষ্ট। বিশাল হলঘর, বড় বড় স্তম্ভ এবং দেওয়ালে জটিল ও সূক্ষ্ম কারুকাজ মন্দিরের শোভা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে ভগবান কৃষ্ণের মূর্তি, পশ্চিমে হনুমানের মূর্তি এবং উত্তরে দেখা যাবে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। মন্দিরের যে-গর্ভগৃহ, তার মেঝের ঠিক মধ্যিখানে জ্যোতির্লিঙ্গটির অবস্থান। গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, শিবলীলা এবং দশাবতারের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে। এই মন্দির চত্বরেই একটি শনি মন্দির রয়েছে। তার দেওয়ালে বিভিন্ন ঋষিমুনির মূর্তি খোদিত রয়েছে।

ভীমশঙ্কর মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বিশেষ কিছু উৎসব পালিত হয়ে থাকে। প্রথমেই বলতে হয় মহাশিবরাত্রির কথা। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে কিংবা মার্চের শুরুতে সাধারণত এই উৎসব পালন করা হয়। এই বিশেষ দিনে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো, অভিষেক, ভজন ইত্যাদি হয়ে থাকে। পাঁচদিন ধরে একটি বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ মহাশিবরাত্রির সময়ে এই ভীমশঙ্কর মন্দিরে এসে জমায়েত হয়। এরপরেই উল্লেখযোগ্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল কার্তিক পূর্ণিমা। কথিত আছে, এই দিনেই ত্রিপুরাসুরের বিনাশ ঘটিয়েছিলেন শিব। মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ এই কার্তিক পূর্ণিমা উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এই মন্দিরে গণেশ চতুর্থী উৎসবও খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। মূলত আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও ভীমশঙ্কর মন্দিরে আলোর উৎসব দীপাবলিও খুব বড় করে পালন করা হয়। কার্তিকের অমাবস্যার দিনে এই উৎসব পালিত হয়, যা সাধারণত অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে পড়ে। এসময় পুরো মন্দির চত্বরটিকে প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়। পুরোহিতেরা শিবের বিশেষ পূজা করে থাকেন। এই উৎসবগুলি ছাড়াও এই মন্দিরে নিত্যদিন ভোরের আরতি, অভিষেক, রুদ্রাভিষেক, লঘুরুদ্র পূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

ভক্তেরা ভীমশঙ্কর মন্দিরে স্বাস্থ্য, সুখ ও সম্পদের জন্য প্রার্থনা করতে যান । এমনকি শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পেতেও ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গের শরণাপন্ন হন অগণিত ভক্তবৃন্দ। তাই হিন্দুদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই মন্দির।

তথ্যসূত্র


  1. পৌরাণিক গল্পসমগ্র :- শিবপুরাণ, শতদ্রুশোভন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, মহালয়া আশ্বিন ১৩৬৪, পৃষ্ঠা :- ৭২-৭৫
  2. https://en.m.wikipedia.org/
  3. https://www.artofliving.org/
  4. https://myoksha.com/
  5. https://www.bhaktibharat.com/
  6. https://behindeverytemple.org/
  7. https://jyotirlingatemples.in/

আপনার মতামত জানান