রাখি পূর্ণিমা

রাখি পূর্ণিমা

রাখি বন্ধন বা রাখি পূর্ণিমা (rakhi-purnima) উৎসবটি ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কের এক নিবিড় উদযাপন। তবে বর্তমানে শুধুই ভাই-বোনের মধ্যে এই উৎসব সীমাবদ্ধ নেই, আপামর ভারতবাসীর মধ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সৌভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির জন্যও রাখি পূর্ণিমা পালিত হয়ে থাকে। হিন্দু ছাড়াও জৈন এবং শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যেও রাখিবন্ধন পালনের চল রয়েছে। পুরাণের কাহিনি থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাসে এবং আধুনিক চলচ্চিত্রে রাখি পূর্ণিমার উদ্‌যাপন বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

রাখি পূর্ণিমার ঠিক পাঁচ দিন আগে ঝুলন উৎসব শুরু হয় এবং রাখি পূর্ণিমার সাত দিন পর জন্মাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর শ্রীকৃষ্ণের এই দুই লীলার মাঝে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাখি পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয় বলে এর আরেক নাম শ্রাবণী পূর্ণিমা।

ভারতীয় পুরাণে অনেকবার অনেকরকমের কাহিনি তৈরি হয়েছে এই রাখি পূর্ণিমার প্রচলনকে কেন্দ্র করে। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী, কৃষ্ণ পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কৃষ্ণের নিজের বোন সুভদ্রা একবার অভিমানভরে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর এই স্নেহের কারণ যার উত্তরে কৃষ্ণ বলেছিলেন সময় এলেই সুভদ্রা কারণ বুঝতে পারবেন। একদিন যখন কোনোভাবে কৃষ্ণের হাত কেটে যায়, তখন সুভদ্রা রক্ত বন্ধ করার জন্য কাপড় খুঁজছিলেন। তখন সেখানে উপস্থিত এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের মূল্যবান রেশম শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেঁধে দেন যার ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়। কৃষ্ণ তখন দ্রৌপদীকে প্রতিশ্রুতি দেন, ‘বোন’ দ্রৌপদীর প্রতিটি সুতোর প্রতিদান দেবেন তিনি এবং পরে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে কৌরবদের রাজসভায় চরম কলঙ্ক থেকে রক্ষাও করেছিলেন। এর ফলেই সুভদ্রা বুঝতে পেরেছিলেন কেন কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভাগবতপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ মতে, বিষ্ণু দৈত্যরাজ বলিকে যুদ্ধে হারালেও বলি তাঁকে নিজের প্রাসাদে থাকতে বাধ্য করেন। কিন্তু এই নতুন ঘর বিষ্ণু পত্নী লক্ষ্মীর পছন্দ হল না বলে তিনি একটি রাখি নিয়ে ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে গেলেন এবং তাঁকে ‘ভাই’ পাতিয়ে সেটি তাঁর হাতে পরিয়ে দিলেন। দৈত্যরাজ খুশি হয়ে বোনের ইচ্ছে জানতে চাইলে লক্ষ্মী স্বরূপ ধারণ করে তাঁকে জানালেন যে বলি যেন বিষ্ণুকে তাঁর নিজের বাড়ি বৈকুণ্ঠে ফিরতে দেন। বোনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মত দৈত্যরাজ বলি সেটাই করেছিলেন।

আবার ভবিষ্যপুরাণ অনুযায়ী দৈত্যরাজ বলির উপদ্রবে নাজেহাল দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির উপদেশে শ্রাবণ পূর্ণিমার দিনে বলির সঙ্গে লড়াই করতে যান। যুদ্ধে যাওয়ার আগে ইন্দ্র পত্নী শচী ভগবান বিষ্ণুর পরামর্শ মত ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দেন বিশেষ মন্ত্রঃপূত রক্ষাবন্ধনী। ফলত সেই যুদ্ধে ইন্দ্র জয়লাভ করেন। অনেকে এই ঘটনাকেই রাখির আদি উৎস হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে ভাই-বোনের সম্পর্কের কোনো কাহিনি এখানে নেই।

এবার আসা যাক রাখির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। জনশ্রুতি আছে যে, সম্রাট আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে ভারতীয় রাজা পুরুর লড়াই শুরু হওয়ার আগে তাঁর স্ত্রী গ্রিক বীরের কাছে গিয়ে তাঁর হাতে রাখি পরিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন পুরুর কোনও ক্ষতি না করেন। এ গল্পটির অবশ্য ঐতিহাসিক কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। হয়ত রাখিকে একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি দেওয়ার জন্যেই এই কাহিনির প্রচলন করা হয়। আরও একটি কাহিনি অনুযায়ী গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করতে এলে সেখানকার বিধবা রানি কর্ণাবতী মুঘল বাদশা হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়ে তাঁর কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানান। হুমায়ুন অবশ্য সময়মতো সৈন্য পাঠাতে পারেননি বলে রানি যুদ্ধে পরাজিত হন। কিন্তু বাহাদুর শাহের কাছে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে রানি জহরব্রতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। এই কাহিনিরও ঐতিহাসিক প্রমাণ বিশেষ নেই তবে সপ্তদশ শতকের রাজপুতানার গল্পগাথায় এটি খুব পরিচিত একটি কাহিনি। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ আয়োজিত রাখি বন্ধন উৎসবের কথা তো বলতেই হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ‘রাখিবন্ধন কর্মসূচি’ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার ‘সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতি’র বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির ভাষণে প্রস্তাব রাখেন ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর হলে সেদিন বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধন পালিত হবে। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোস থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে সেদিন রাখিবন্ধন উৎসবের পরিকল্পনা করেন রবীন্দ্রনাথ আর সেই দিনটিকে ‘মিলন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাখিবন্ধন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন এক বিখ্যাত গান ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—পুণ্য হউক, পুণ্য হউক’।

৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর বাড়িতে আয়োজিত এক বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে একপেশে সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল তৈরি হচ্ছিল। সমস্ত প্রতীক গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম থেকে। এর ফলে অহিন্দুদের মনে সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রকাশ হতে পারে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা কেবল হিন্দুদের একার বাসস্থান নয়, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল মানুষের সহাবস্থান এই পুণ্যভূমি, সকলেই এখানে একত্রে মিলেমিশে থেকে এসেছে এতকাল। ফলে বঙ্গ বিভাজন ঘটলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের মধ্যেই বিভাজন দেখা দেবে, কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না। আর তাই বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ আবশ্যিক। রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলি মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও মানসিকভাবে সংস্কৃতিগতভাবে দূরে সরিয়ে দেবে। তাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিজয়া সম্মিলনীতে আহ্বান করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর হাত ধরেই বাংলায় রাখি পূর্ণিমার প্রচলন এক অন্য মাত্রা পায়। ধর্মীয় গণ্ডি থেকে বেরিয়ে মানবতার উৎসব হয়ে ওঠে রাখিবন্ধন।

রাখি পূর্ণিমার দিন প্রত্যেক বাড়িতে দাদা বা ভাইয়ের হাতে বোন বা দিদিরা রাখির পবিত্র সুতো পরিয়ে দেয় এবং দাদা বা ভাই তার বোনের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেন সারাজীবনের জন্য। তারপর চলে মিষ্টিমুখ, খাওয়া-দাওয়া। তবে রক্তের সম্পর্কের ভাই-বোন না হলেও অনাত্মীয়দের মধ্যেও রাখি বন্ধন পালিত হয়। কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরা এলাকার সকল মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে রাখি পরিয়ে দেন। সাম্প্রতিককালে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠন দেশের বিপর্যয়ের দিনে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার লক্ষে রাখি বন্ধন উৎসব আয়োজন করে থাকেন।

4 comments

আপনার মতামত জানান