পাশাখেলা এবং দ্রৌপদীর অপমান

পাশাখেলা ও দ্রৌপদীর অপমান

মহাভারতের সভাপর্বের ৪৬তম অধ্যায় থেকে ৭৯তম অধ্যায় জুড়ে বর্ণিত আছে মহারাজ যুধিষ্ঠির ও শকুনির মধ্যে পাশাখেলা এবং তার ফলস্বরূপ প্রকাশ্য রাজসভায় দ্রৌপদীর অপমান। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর যখন অন্যান্য অতিথিরা সকলেই নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন, দুর্যোধন ও শকুনি তখনও ইন্দ্রপ্রস্থেই ছিলেন। ময়দানবের দ্বারা নির্মিত যুধিষ্ঠিরের অপরূপ সভাগৃহের সৌন্দর্য্য দেখতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। এমন সভা তাঁরা কেউ কখনো আগে দেখেননি, ফলে যত দেখেন ততই তাঁদের ধাঁধা লেগে যেতে থাকে। স্ফটিকের মেঝেকে জল এবং জলকে স্ফটিক মনে করে দুর্যোধন বারবার বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। তাঁর এই দুর্দশা দেখে উপস্থিত দাসদাসীরা হাসাহাসি করছিল। এই সমস্ত ঘটনার ফলে দুর্যোধনের মনে পান্ডবদের প্রতি পাহাড়প্রমাণ হিংসার সৃষ্টি হয়। মনের রাগকে মনেই চেপে রেখে তিনি ও শকুনি সেখান থেকে বিদায় নেন।

পথে যেতে যেতে তিনি শকুনিকে নিজের ঈর্ষার কথা খুলে বললে শকুনি পরামর্শ দেন যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার খুব শখ, অথচ তিনি ভালো খেলতে পারেন না। একবার যদি তাঁকে এনে পাশা খেলায় বসানো যায়, তবে শকুনি ফাঁকি দিয়ে পান্ডবদের সব সম্পত্তি জিতে নেবেন। কারণ শকুনির মতো পাশা খেলতে খুব কম জনই পারে।

এই প্রস্তাব দুর্যোধনের খুবই পছন্দ হওয়ায় তিনি হস্তিনাপুরে ফিরে গিয়ে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে এই পরিকল্পনার কথা জানালেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ভালো-মন্দ বিচার না করেই সম্মতি প্রদান করলেন। তাঁর নিজের মনেও পান্ডবদের প্রতি যথেষ্ট হিংসা ছিল। ফলে তিনি বিদুরকে আদেশ করলেন ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

নিমন্ত্রণ পেয়ে পান্ডবরা সকলেই দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হলেন। পরের দিন সকালে পাশাখেলা আরম্ভ হল। সেই খেলা দেখার জন্য রাজসভায় প্রচুর লোকজন এসেছেন। খেলা শুরু হওয়ার সময়ে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র সভায় এসে উপস্থিত হলেন। খেলার শুরুতে যুধিষ্ঠির পণ রাখলেন তাঁর গলার হার। শকুনি পাশা ফেলে সেটি জিতে নিলেন। দ্বিতীয় বারে যুধিষ্ঠির এক লক্ষ আট হাজার সোনার কলস ও ভান্ডারের সকল ধনরত্ন পণ রাখলে শকুনি তার সব কিছুই জিতে নিলেন।

এইভাবে ক্রমাগত যুধিষ্ঠির হারতে থাকলেন। যত হারেন, ততই তাঁর জেদ বেড়ে যায় এবং তিনি আরো খেলতে থাকেন। তিনি যতই ধনরত্ন পণ রাখেন, শকুনি ফাঁকি দিয়ে সবই জিতে নিতে থাকেন। এইভাবে চলতে চলতে যুধিষ্ঠিরের দাসী, চাকর, হাতি, ঘোড়া, সৈন্য, রথ ইত্যাদি সকলই কৌরবদের হাতে চলে গেল। সর্বনাশ উপস্থিত দেখে বিদুর এই খেলা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কিন্তু দুষ্ট দুর্যোধন এই কথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বিদুরকে গালি দিতে আরম্ভ করলে বাধ্য হয়ে বিদুর চুপ করে গেলেন।

পুনরায় খেলা শুরু হল। আবার যুধিষ্ঠির হারতে থাকলেন। সব ধনরত্ন শেষ হলে গরু-বাছুর, সমগ্র রাজ্য এমনকী চার ভাইকে পর্যন্ত জিতে নিলেন শকুনি। কিন্তু তবুও জেদ থামে না যুধিষ্ঠিরের। শেষে তিনি নিজেকে পর্যন্ত পণ রাখলেন এবং তাও শকুনি জিতে নিলেন। তখন দয়া, ধর্ম, সদাচার সকল ভুলে যুধিষ্ঠির বলে উঠলেন, “এবার দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম’’। একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সভার সমস্ত লোক যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করতে লাগলো। কিন্তু ধূর্ত শকুনি পাশা ফেলে দ্রৌপদীকেও জিতে নিলেন। আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন কৌরবেরা। দুর্যোধন এক দারোয়ানকে আদেশ করলেন কুলবধূ দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে আসার জন্য। কৌরবদের ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেলেন না। কিন্তু সেই দারোয়ান দ্রৌপদীকে সভায় আনতে ব্যর্থ হলে দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন গেলেন দ্রৌপদীকে সভায় আনতে। দুঃশাসনের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে দ্রৌপদী অন্তঃপুরে অন্যান্য মহিলাদের কাছে আশ্রয় নিতে গেলেন। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছাবার আগেই দুরাত্মা দুঃশাসন একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাঁকে সভায় নিয়ে চললো। আকুল হয়ে দ্রৌপদী কাঁদতে লাগলেন…কিন্তু বহু মিনতি করা সত্ত্বেও সেই দুষ্টের মনে দয়া হল না। 

এইভাবে প্রকাশ্য জনসভায় কুলবধূকে নিয়ে আসা হলেও কেউ তার কোনো প্রতিবাদ করলেন না। দ্রৌপদী ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ গুরুজনদের কাছে বিচার চাইলেও তাঁরা সবাই চুপ করে রইলেন। একমাত্র প্রতিবাদ করলেন তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদকে ‘বালকোচিত’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে চরম অপমান করলেন দুর্যোধন ও কর্ণ। লজ্জায় ও অপমানে সভা ত্যাগ করলেন বিকর্ণ। 

এরপর কর্ণ বললেন দ্রৌপদী একজন নারী, কিন্তু তিনি একের অধিক পুরুষের ঘরণী হয়েছেন। সুতরাং তিনি কুলবধূ নন, বেশ্যা। আর বেশ্যাকে প্রকাশ্য জনসভায় অপমান বা বিবসনা করলেও কোনো পাপ হয় না। এই কথা বলে তিনি দুঃশাসনকে আদেশ করলেন দ্রৌপদীর গায়ের কাপড় খুলে নিয়ে তাঁকে বিবস্ত্র করতে। 

একথা শোনা মাত্রই পান্ডবরা সবাই তাঁদের নিজের নিজের উত্তরীয় খুলে ফেললেন। দুঃশাসন তাঁর কাপড় কেড়ে নিতে চেষ্টা করলে দ্রৌপদী আর উপায়ান্তর না দেখে স্মরণ করলেন অগতির গতি শ্রীকৃষ্ণকে এবং শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় সে সময়ে দ্রৌপদীর কাপড় পরিমাণে এতোই বেড়ে গেলো যে, দুঃশাসন অনেক চেষ্টা করেও তা খুলে ফেলতে পারলেন না। যতই চেষ্টা করেন, ততই নানা রঙের কাপড় দ্রৌপদীকে ঘিরে ধরে রইল। শেষে ক্লান্ত হয়ে দুঃশাসন দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিলেন। 

এদিকে এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখে সভায় ঘোরতর কলরব শুরু হয়ে গেছে। সভাসদরা দ্রৌপদীর প্রশংসা করতে করতে দুঃশাসনকে গালি দিতে শুরু করেছেন, আর ভীম রাগে কাঁপছেন। শেষে আর থাকতে না পেরে সভার সকলকে ডেকে ভীম বললেন, তিনি যদি ভীষণ যুদ্ধের পর দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান না করেন, তবে যেন তাঁর স্বর্গলাভ না হয়। 

এমন সময় বিদুর আবার সকলকে অনুরোধ করলেন দ্রৌপদীর কথা বিচার করতে। কিন্তু তবুও কেউ কোনো কথা বললেন না। তখন কর্ণের কথায় দুঃশাসন আবার দ্রৌপদীকে টানাটানি করতে লাগলেন। এইভাবে কৌরবেরা বারবার দ্রৌপদীকে এবং পান্ডবদের অপমান ও বিদ্রুপ করতে লাগলো। বাকি চার ভাই চুপচাপ সহ্য করলেও ভীম কিছুতেই এই নিদারুণ অপমান মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই দুর্যোধন যখন হাসতে হাসতে দ্রৌপদীকে নিজের নগ্ন ঊরু দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করলেন এবং তা দেখে কর্ণ হাসতে লাগলেন, তখন ভীম ভয়ঙ্কর গর্জনে সভা কাঁপিয়ে ঘোষণা করলেন, যে ঊরু দেখিয়ে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে অশ্লীল ইঙ্গিত করলেন, ভীম গদা দিয়ে সেই ঊরু ভেঙে দেবেন।   

এতক্ষণে সবাই বুঝতে পারলেন এ সকল ঘটনার ফল খুবই মারাত্মক হবে। তখন প্রাণের ভয়ে আর নিন্দার ভয়ে ধৃতরাষ্ট্র কৌরবদের তিরস্কার করে দ্রৌপদীকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। দ্রৌপদী দুই বরে অস্ত্রশস্ত্র সহ পঞ্চপাণ্ডবের মুক্তি কামনা করলেন। তাঁর প্রার্থনা অনুযায়ী ধৃতরাষ্ট্র সব সম্পত্তি ফেরত দিয়ে পান্ডবদের মুক্ত করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যেতে বললেন। 

কিন্তু এই ব্যবস্থা দুর্যোধনের পছন্দ হল না। তিনি দ্বিতীয় বার পাশাখেলার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। মুহুর্তেই ধৃতরাষ্ট্রও তাঁদের কথায় সম্মতি দিয়ে ফেললেন। এবারের খেলায় পণ হল বারো বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস। পান্ডবরা এবারেও হেরে গেলেন। রাজসভা ত্যাগ করার সময় পঞ্চপাণ্ডব প্রতিজ্ঞা করে গেলেন, তেরো বছর পরে এই অপমানের প্রতিশোধ তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে নেবেন। দুঃশাসনের টানে দ্রৌপদীর চুলের বেণী খুলে গিয়েছিল। দ্রৌপদীও প্রতিজ্ঞা করলেন, দুষ্ট দুঃশাসনের রক্ত দিয়ে যতদিন না তিনি চুল ধুতে পারবেন, ততদিন তাঁর বেণী খোলাই থাকবে। বনে যাওয়ার আগে যুধিষ্ঠির বিদুরের আদেশে মা কুন্তীকে তাঁর বাড়িতে রেখে এলেন। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে দ্রৌপদী ও পুরোহিত ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসে রওনা হলেন পান্ডবরা।

তথ্যসূত্র


  1. ‘মহাভারত’, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, সভাপর্ব, অধ্যায় ৪৬-৭৯, পৃষ্ঠা ৩৫৮-৩৯৬
  2. ‘উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র', ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ,
    পৃষ্ঠা ২১৭-২২৫

One comment

আপনার মতামত জানান