হিন্দুদের দেবতাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ বহু প্রাচীন কাল থেকেই বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা, দোলযাত্রা ইত্যাদি ঘটনার পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে জন্মাষ্টমী(Janmashtami) পালন করে থাকেন আপামর হিন্দু ধর্মবিশ্বাসীরা। বিশেষভাবে মথুরা আর বৃন্দাবনে পালিত হলেও পৃথক পৃথক স্থানে যেখানে কৃষ্ণভজনা হয়, সেখানে ধুমধাম করে পালিত হয় এই জন্মাষ্টমী। কৃষ্ণাষ্টমী ও গোকুলাষ্টমী নামেও এই উৎসব পরিচিত।
জন্মাষ্টমী উৎসব ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালন করা হয়। রাখি পূর্ণিমার ঠিক পাঁচ দিন আগে ঝুলন পূর্ণিমা শুরু হয় এবং রাখি পূর্ণিমার সাত দিন পর জন্মাষ্টমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ ঠিক এই দিনই পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিলেন দিনটি জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়।
জন্মাষ্টমীর পৌরাণিক ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় ভাগবত পুরাণেই প্রথম শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বর্ণনা করে মর্ত্যধামে তাঁর জন্ম এবং বিভিন্ন লীলার বর্ণনা করা হয় যা আজও সমানভাবে প্রচলিত। পুরাণ মতে, মথুরার রাজা কংস তাঁর বাবাকে বন্দী করে রাজ-সিংহাসন দখল করেন। ক্রমেই অত্যাচারী হয়ে ওঠেন কংস। বোন দেবকীর সঙ্গে কংস বাসুদেবের বিবাহ দেন। বিবাহের পর বোনকে বিদায় জানানোর সময় আকাশে দৈববাণী হয়, ‘দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তান কংসকে বধ করবে’। এতদিন পর্যন্ত মথুরার প্রজাদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করেছিলেন কংস। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া সিংহাসন তাঁকে অহঙ্কারী করে তুলেছিল। ফলে এই দৈববাণী শুনে কংস রুদ্ররূপ ধারণ করে দেবকী ও বাসুদেবকে কারাগারে বন্দী করেন এবং প্রহরীদের আদেশ দেন তাঁদের কোনো শিশু জন্মালেই যেন কংসকে খবর দেওয়া হয়। এইভাবে দেখতে দেখতে দেবকীর ছয়টি সন্তানকে নৃশংসভাবে কংস আছড়ে মেরে ফেলেন। কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবকী তাঁর সপ্তম সন্তান দৈবশক্তির দ্বারা রোহিনীর গর্ভে প্রদান করলে বলরামের জন্ম হয়। এরপর আসে দৈববাণী কথিত সেই পবিত্র সময়। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণ জন্ম নেওয়ার পর্ব। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি, রাতের প্রথম প্রহর। প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কারাগার আলো করে জন্ম নিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আকাশে দৈববাণী হল ‘বাসুদেব তুমি এই সন্তানকে নিয়ে নন্দালয়ে রেখে এসো ও নন্দরানী যশোদা যে কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন তাকে নিয়ে এসো’। বাসুদেব আর দেরি না করে নন্দালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দৈববলে কারাগারের সব শিকল খুলে যায়, প্রহরীরা সবাই ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। এদিকে প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে যমুনা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তখন। বাসুদেব ভীত হয়ে করজোড়ে প্রার্থনা জানালে যমুনা দুইভাগ হয়ে বাসুদেবকে রাস্তা করে দেয়। অনেক পুরাণে বলা হয়েছে এই সময় বিষ্ণু সপ্তমুখী নাগের রূপ নিয়ে যমুনার জল থেকে বাসুদেব এবং শিশু কৃষ্ণকে রক্ষা করেন। শিশু কৃষ্ণকে মাথায় করে বাসুদেব নন্দালয়ে যশোদার (কৃষ্ণের পালক মা) কাছে পৌঁছে তাঁর সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে নিয়ে মথুরায় ফিরে এলেন। সকালে শিশুর কান্নার শব্দে প্রহরীদের ঘুম ভাঙলে তাঁরা কংসকে খবর দেন। কংস এসে শিশুটিকে আছাড় দিতে গেলে সে শূন্যে ভেসে হাসতে হাসতে কংসকে বলে ‘আমি মহামায়া, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। কৃষ্ণের জন্মকে কেন্দ্র করে সেদিন বৃন্দাবনের নন্দালয়ে সবাই আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছিল আর এই আনন্দ-উৎসবই আজকের ‘জন্মাষ্টমী’ নামে পরিচিত। ছোট্ট কৃষ্ণ মাখন, ক্ষীর, ননী চুরি করে খেয়ে সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিল। একজন সাধারণ বালকের মতোই কৃষ্ণ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকেন এবং ছোট থেকেই তিনি নানা অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিয়ে গেছেন যার মধ্যে পূতনা রাক্ষসী বধ, কালীয়নাগ দমন, গোবর্ধন পর্বত ধারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বালক কৃষ্ণ বড় হলে তাঁর মামা কংস তাঁকে মথুরায় আমন্ত্রণ জানান। বৃন্দাবনের পর্ব শেষ করে তিনি মথুরায় ফিরে আসেন এবং অন্তিমে মামা কংসকে বধ করেন।
সমগ্র ভারতে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, ওড়িশা, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য স্থানেও ঘটা করে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। মুম্বাই, নাগপুর ইত্যাদি স্থানে জন্মাষ্টমীর পরের দিন পালিত হয় ‘দহি হান্ডি’ নামে বিশেষ উৎসব। সেই দিন দই ভর্তি মাটির হাঁড়ি ফাটিয়ে সেই দই সমবেত ভক্তদের মাঝে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। গুজরাটের দ্বারকায় এই একই রীতি ‘মাখন হাণ্ডি’ নামেই পরিচিত। উত্তর ভারতে মথুরা সহ অন্যান্য জায়গায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে এই জন্মাষ্টমীর দিন শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন লীলার কাহিনী বর্ণন, মূর্তি তৈরির চল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে জন্মাষ্টমী পালিত হয় ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী’ নামে আর এর পরেরদিন চলে নন্দোৎসবের উদ্যাপন। ভক্তেরা এই জমাষ্টমীর দিন উপবাসে থেকে কৃষ্ণের উপাসনা করেন এবং ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্দটি পাঠ করেন। গঙ্গায় রাধামাধবের বিগ্রহকে স্নান করিয়ে মধ্যরাত্রে চারশো পদ সহযোগে ভোগ অর্পণ করা হয়। তবে ভারতের বাইরে নেপাল, বাংলাদেশ, ফিজি দ্বীপপুঞ্জতেও এই জন্মাষ্টমী উৎসব পালনের কথা জানা যায়।
5 comments