বাগবাজার ঘাট

 বাগবাজার

কলকাতার মানচিত্রে বেশ কিছু ‘বাজার’ আছে, যেমন  বাগবাজার, শ্যামবাজার, লালবাজার, বৌবাজার ( বহুবাজার) , আমিনীবাজার, জানবাজার, চিনাবাজার, বড়বাজার, টেরিটি বাজার, শোভাবাজার ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বাজারেরই আছে তার নিজস্বতা, আছে তার ইতিহাস। এইরকমই স্থাননামে প্রসিদ্ধ কলকাতার বাজার-গুলির মধ্যে এখানে  বাগবাজার নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হল।

বাগবাজার নাকী বাঘ বাজার? অনেকেই মনে করেন ‘বাঘ’ থেকে ‘ বাগ’ শব্দটি এসেছে কিন্তু তা ঠিক নয়৷ ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন মনে করেন ‘বাগ’ শব্দটি ‘বাঁক’ থেকে এসেছে। নিকটেই আছে হুগলী নদীর প্রকান্ড বাঁক৷ আরেক ধারণা অনুসারে বাগান বাজার থেকে বাগবাজার নামটির উদ্ভব হয়েছে, চিৎপুরের বাগানবাড়ির সন্নিহিত স্থান হিসেবে এর নামকরণ।বাগবাজার

ইতিহাসে উঁকি দিলে জানা যাবে একসময় বাগবাজার ছিল সুতানুটি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলটি ছিল বসু ও পাল পরিবারের বাসভূমি। এই বসু পরিবারে অন্যতম ধনী ব্যক্তি নন্দলাল বসু ব্রিটিশদের আসার অনেক আগেই সুতানুটিতে আসেন। ডিহি কলকাতা গ্রামে বসতি স্থাপনের পর সুতানুটি অঞ্চল ধীরে ধীরে ইংরেজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে যায়৷ এই অঞ্চলের উত্তরে আছে পেরিনস গার্ডেন নামে একটি প্রমোদ উদ্যান। বলা হয় কলকাতার কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা একসময় সস্ত্রীক এই উদ্যানে আমোদ প্রমোদ করতে আসতেন। কলকাতার অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী জমিদার ‘ব্ল্যাক জমিদার’ নামে খ্যাত গোবিন্দরাম মিত্রের পুত্র রঘু মিত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালেই বাগবাজারের বিখ্যাত বাগবাজার ঘাটটি নির্মাণ করান। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে বাগবাজারের কাছেই কোম্পানির সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত লালদিঘির যুদ্ধটি ঘটেছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বাগবাজারের কথা আসলেই যাঁর নামটি মনে আসে তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ। সম্ভবত ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সালে তিনি প্রথমবার বাগবাজারে এসেছিলেন। বাগবাজার নাট্যসংস্কৃতির পীঠস্থান। বাগবাজার স্ট্রিটে অবস্থান করছে কলকাতার দুটি অন্যতম প্রধান অডিটোরিয়াম, একটি গিরিশ মঞ্চ। ৯০০ আসন বিশিষ্ট এই অডিটোরিয়ামটির উদ্বোধন হয় ১৯৮৬ সালে অপরটি পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির শশিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চ। বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিটি শহরের অন্যতম প্রাচীন লাইব্রেরি যেটির বয়স প্রায় ১২৫ বছর৷

যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তিত্বের নাম বাগবাজারের সঙ্গে জড়িত তাঁরা হলেন –  গিরীশ ঘোষ ( নট ও নাট্যকার), মোহনচাঁদ বসু ( নিধুবাবুর শিষ্য এবং বাংলা আখড়াই ও খেউড় গানের উদ্ভব কর্তা), ভোলা ময়রা ( মিষ্টান্ন বিক্রেতা এবং কবিয়াল), নগেন্দ্রনাথ বসু ( ‘বিশ্বকোষ ‘ নামক বাংলা জ্ঞানকোষ রচয়িতা)।

বাগবাজারের দর্শনীয় স্থানগুলি হল ভগিনী নিবেদিতার বাসভূমি, গিরীশ এভিনিউ- যেখানে নাট্যকার গিরীশ ঘোষের বাড়ি অবস্থিত, স্টীমার জেটি, ‘মায়ের বাড়ি’ যেখানে আগে সারদা মায়ের বাসভবন ছিল, ব্যোমকালী মন্দির, মদনমোহন মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বলরাম মন্দির, পুঁটেকালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ ইত্যাদি৷ এর মধ্যে কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা না লিখলেই নয় –

ভগিনী নিবেদিতার বাসভূমি – ১৮৯৮ সালের ১ নভেম্বর যখন ভগিনী নিবেদিতা দ্বিতীয়বারের জন্য কলকাতায় আসেন সেই সময়ে হাওড়া ষ্টেশন থেকে তিনি সোজা বাগবাজারে রমাকান্ত বসু – স্ট্রীটে শ্রী বলরাম বসুর গৃহে চলে এসেছিলেন৷   সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী বলরাম বসুর গৃহে অবস্থান করছিলেন । সেই হেতু নিবেদিতার ইচ্ছা অনুসারে স্বামীজি শ্রীমা সারদা দেবীর ১০|২ বোসপাড়া লেনের বাসভবনে তাঁর অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করেন । এই বাসভবনে তিনি প্রায় ৮-১০ দিন ছিলেন। তার পর স্বামী বিবেকানন্দের চেষ্টায় ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের দোতলা বাসভবনে নিবেদিতার পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে তিনি জুন ১৮৯৯ পর্যন্ত বসবাস করেছিলেন।

বসু বাটী – পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের একটি সুবৃহৎ এবং প্রাচীন অট্টালিকা এইটি। এই অট্টালিকার সদরের বহির্ভাগ বিশালাকৃতি  করিন্থিয়ান গঠনশৈলী  অবলম্বনে তৈরী করা হয়েছে। ১৮৭৮ সালে প্রায় ২২ বিঘা জমির উপর বাগান সহ এই অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন গয়া জেলার জমিদার মহেন্দ্র বসুর দুই ভাই পশুপতি বসু এবং নন্দলাল বসু। এই বাড়িটির খিলান এবং প্রাচীরের নকশায় স্থাপত্যের বুনটে দেখা যায় ইসলামীয় এবং ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধন৷ ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই বসু বাটী থেকেই রাখি বন্ধন উৎসবের সূত্রপাত হয়েছিল – সেই হিসেবে এই বাড়ির গুরুত্ব অনেকখানি৷

গিরিশ মঞ্চ –  কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের একটি ব্যস্ততম নাট্যমঞ্চ।১৯৮৬ সালের ১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই মঞ্চটির উদ্বোধন করেনছিলেন, মঞ্চটি নামকরণ হয়েছে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের নামে।

লেখক প্যরীচাঁদ মিত্রের উপন্যাস ”আলালের ঘরে দুলাল” এ বাগবাজার ঘাটের বর্ণনা আছে।

কলকাতার উত্তরে বনেদিয়ানার মোড়কে আচ্ছাদিত এই অঞ্চলটি পুরনো কলকাতার স্বাদটি আজও বহন করে চলেছে।

 

তথ্যসূত্র


  1. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/বাগবাজার
  2. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/গিরিশ_মঞ্চ
  3. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ভগিনী_নিবেদিতার_বাসভবন
  4. কলিকাতার কাহিনী - সুকুমার সেন, আনন্দ প্রকাশনী,  পৃষ্ঠা ৪৪

13 comments

  1. বাল‍্যকালে কয়েক বছর শ‍্যামবাজারে বসবাস করেছি। বাগবাজারে নিত‍্য যাতায়াত ছিল। বাগবাজারে রসগোল্লার আবিষ্কর্তা নবীন ময়রার দোকান, বাগবাজারের মোড়ে দ্বারিক ঘোষের মিস্টান্ন ভাণ্ডার এবং পথপার্শে তেলে ভাজার দোকান তৎকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমার যতদূর মনে আছে সিনেমা অভিনেতা জহর গাঙ্গুলী এবং পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ও বাগবাজারের অধিবাসী ছিলেন।

আপনার মতামত জানান