শোভাবাজার

কলকাতার মানচিত্রে বেশ কিছু ‘বাজার’ আছে, যেমন  বাগবাজার, শ্যামবাজার, লালবাজার, বৌবাজার ( বহুবাজার) , আমিনীবাজার, জানবাজার, চিনাবাজার, বড়বাজার, টেরিটি বাজার, শোভাবাজার ইত্যাদি৷ প্রত্যেকটি বাজারেরই আছে তার নিজস্বতা, আছে তার ইতিহাস। এইরকমই স্থাননামে প্রসিদ্ধ কলকাতার বাজার-গুলির মধ্যে এখানে  জানবাজার নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হল।

নামে ‘ বাজার ‘ থাকলেও এই অঞ্চলটি বনেদীয়ানার কথা বলে৷উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলটির নাম শুনলেই ঐতিহ্য মন্ডিত পুরনো কলকাতার ছবিটিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷

শোভাবাজার অঞ্চলটি কলকাতা পৌরসংস্থার ৯ নং ওয়ার্ডে বিস্তৃত এবং এর উত্তরে বাগবাজার, পূর্বে শ্যামবাজার, দক্ষিণে নিমতলা এবং পশ্চিমে হুগলী নদী রয়েছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভৌগলিক পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে আমরা আসি ইতিহাসের পাতায়। আমরা সকলেই জানি কলকাতার পত্তন হয়েছিল গোবিন্দপুর সুতানুটি আর কলকাতা মিলে। সেই সুতানুটিতে প্রথম বসতি স্থাপনকারী ছিলেন সপ্তগ্রামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শেঠ ও বসাক । তাঁরা এই এলাকার বেশিরভাগ জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাসের যোগ্য করে তোলেন। কথিত আছে বসাকদের গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের (কৃষ্ণ) নাম অনুসারে পার্শ্ববর্তী এলাকার নাম               শ্যামবাজার রাখা হয়। শোভারাম বসাক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার এক বিশিষ্ট বাঙালি ধনী ব্যবসায়ী, বলাবাহুল্য তাঁর নাম অনুসারেই জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাস বলে রামচরণ দেব মেদিনীপুর জঙ্গলে বর্গীদের হাতে নিহত হলে তাঁর বিধবা স্ত্রী তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের গোবিন্দপুরের বাড়িতে ফিরে আসেন সেখান থেকে তাঁরা আড়পুলিতে আসেন তারপরে সুতানুটির শোভাবাজারে। ছোট ছেলে নবকৃষ্ণ মায়ের উত্‍সাহে ইংরেজি, ফারসি ও আরবি শিখে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বিখ্যাত হন ও প্রতিপত্তি লাভ করেন৷ ব্রিটিশদের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁদের গোবিন্দপুরের বুকে নতুন ফোর্ট উইলিয়াম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সময় থেকেই শোভাবাজারের ঐতিহ্যময় দিনগুলি শুরু হয়।

মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারে শোভাবাজার রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। অনেকে মনে করেন তিনি শোভারাম বসাকের থেকে এটা নেন এবং জাঁকজমক ও বিশালতার জন্য তাঁর পছন্দ মিলিয়ে এটিকে বাড়িয়ে তৈরী করেন। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর রামচাদ রায়, আমীর বেগ ও মীরজাফরের সঙ্গে গোপন কোষাগার থেকে আট কোটি টাকার মূল্যবান সম্পদ অর্জন করেছিলেন মহারাজা নবকৃষ্ণ।

১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গা পূজা শুরু করেন। তিনি পূজার জন্য একটি ধারা তৈরি করেন যা কলকাতার উঠতি বণিক শ্রেণির মধ্যে একটি রেওয়াজ এবং আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। আজও বনেদী বাড়ির এই পূজো বহাল রয়েছে। উল্লেখ্য যে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় যোগদানের পর স্বামী বিবেকানন্দকে শোভাবাজার রাজবাড়ির দালানে নাগরিক অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল। শোভাবাজার রাজবাড়ি কলকাতা পৌরসংস্থা দ্বারা ঐতিহ্য ভবন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

শোভাবাজারের নিকটেই অবস্থিত কুমোরটুলি। এই অঞ্চলটি ‘পটুয়াপাড়া’ বা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত৷ কলকাতার এই অঞ্চল থেকেই দেবদেবীর প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পূজার জন্যই নয় অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে৷

শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে সামান্য এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে মিনার্ভা থিয়েটার যেটি কোলকাতার জনপ্রিয় নাট্যশালা, নির্মাণ সাল ১৮৯৩ । এটি বেডন স্ট্রিটে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বিপরীতে অবস্থান করছে৷ ন্যশনাল থিয়েটারে প্রতাপচাঁদ জহুরী নামে এক অবাঙালী ব্যবসায়ী মালিক হয়ে আসার পর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন । মিনার্ভা থিয়েটারের মঞ্চে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল “ম্যাকবেথ” নাটকটি। এই মিনার্ভা থিয়েটার এবং এর বরাবর স্টার এবং ক্লাসিক থিয়েটারেই প্রথম হীরালাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিল।

শোভাবাজারের কথা বলতে গিয়ে আরেক ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, যিনি উত্তর কলকাতায় শোভাবাজারের নিকটে দর্জিপাড়াতে বসবাস করতেন । টপ্পা, বৈঠকি গান এবং বাংলা ক্লাসিক সঙ্গীতের জগতে তাঁর বিচরণ ছিল। তিনি গান গাওয়ার পাশাপাশি সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালনাতেও পারদর্শী ছিলেন৷

One comment

আপনার মতামত জানান