কলকাতার মানচিত্রে বেশ কিছু ‘বাজার’ আছে, যেমন বাগবাজার, শ্যামবাজার, লালবাজার, বৌবাজার ( বহুবাজার) , আমিনীবাজার, জানবাজার, চিনাবাজার, বড়বাজার, টেরিটি বাজার, শোভাবাজার ইত্যাদি৷ প্রত্যেকটি বাজারেরই আছে তার নিজস্বতা, আছে তার ইতিহাস। এইরকমই স্থাননামে প্রসিদ্ধ কলকাতার বাজার-গুলির মধ্যে এখানে শ্যামবাজার নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হল।
আজ গল্প হোক লালবাজার নিয়ে, জেনে নেওয়া যাক কেন বাজারটির নাম হলুদ সবুজ কিংবা নীল বাজার না হয়ে লালবাজার বলা হয়।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘লাল’ শব্দটির একটি প্রধান অর্থ লেখা আছে ‘কৃষিযোগ্য ভূমি’। ‘ লাল’ শব্দের বিপরীতে ‘খিল’ বলে যে শব্দটি আছে, তার অর্থ পতিত বা অনাবাদী জমি। অর্থাৎ শুরুতেই বোঝা গেল নামে থাকা ‘ লাল ‘ কোন রং অর্থে বোঝানো হচ্ছে না।
আলোচনা শুরু করার আগে জেনে নেওয়া যাক লালবাজার কোথায় অবস্থিত। মধ্য কলকাতার বিবাদীবাগ সংলগ্ন একটি অঞ্চল এটি এবং শহরের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চলেরসঙ্গে যুক্ত এই অঞ্চলটি । উল্লেখযোগ্য যে কলকাতা পুলিশের সদর কার্যালয় এখানে [১৮, লালবাজার স্ট্রিট] অবস্থিত।
ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির প্রথম দিককার কাগজপত্রে ‘লালবাজার’ নামটি উল্লিখিত হয়েছে। সেই দিক থেকে দেখলে লালবাজারের বয়স তিনশো বছরের বেশী। এখানে অবস্থিত লালদিঘির বয়স আরও প্রাচীন। জাহাঙ্গিরের আমলে এই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। এর কাছেই ছিল কলিকাতা, বোরো, পাইকান পরগনার জমিদার মজুমদারদের কাছারিবাড়ি। ১৭০৯ সালে মজে যাওয়া এই পুকুর দিঘিটির সংস্করণ ইংরেজদের হাত ধরেই হয়েছিল। তারপর থেকেই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে এই দিঘির জল। এমনকি ফল ও সবজির বাগান করা হতে থাকে এই দিঘির পাশেই। কমলালেবু চাষের কথাও উল্লেখ আছে কোম্পানির সেরেস্তার কাগজে। এরথেকে বোঝা যায় সেচকার্যের জন্য কাটানো মোগল আমলের লালদিঘি ইংরেজের জমিতেও জলসিঞ্চন করতে সাহায্য করেছিল । উর্বর কৃষিজমিতে উৎপন্ন ফসলের বেচাকেনা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যেই কৃষিজমির পাশেই গড়ে উঠেছিল ‘লালবাজার’; অর্থাৎ কৃষিযোগ্য জমি সংলগ্ন বাজার। এককথায় বলা যেতেই পারে লালবাজারের ইতিহাস তাই কৃষি থেকে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি ও শিল্পে উত্তরণের ইতিহাস।
লালবাজার এর কথা আলোচনা সূত্রে আরও একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমান পুলিশ কার্যালয়টি আগে ছিল কলকাতার বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী জন পামার (John Palmer)-এর বাসভবন। বলা হয় তারও পূর্বে এটি ছিল ‘একটি পুরনো বসতবাটীর ধ্বংসাবশেষ, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ স্থানীয় বাসিন্দার বাড়ি’। তার পাশেই ছিল সে যুগের সর্বাপেক্ষা সুন্দর বাড়ি হারমোনিক ট্যাভার্ন। আদি কলকাতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তি হিসেবে ফাঁসিতে ঝোলানোর নিয়ম ছিল। তাই লালবাজার ও চিৎপুর রোডের [বর্তমান রবীন্দ্র সরণি] সংযোগস্থলে সেযুগে একটি ফাঁসির মঞ্চও ছিল। ১৭৬৮ সালে এই রাস্তাটিকে কলকাতার শ্রেষ্ঠ রাস্তা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমান পুলিশ সদর কার্যালয়টি লালবাজারে নির্মিত হয়েছে ১৯১৯ সালে।
3 comments