বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের এক অবিস্মরণীয় কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (Mukundaram Chakrabarti)। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তাঁরই নাম উল্লেখ করেন ঐতিহাসিক ও সমালোচকেরা। তাঁর লেখা জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত কাব্যটির নাম ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’। আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই এই কাব্যটি লিখেছিলেন তিনি।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল হৃদয় মিশ্র এবং মায়ের নাম ছিল দৈবকী। তাঁর পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং তাঁর বড় ভাইয়ের নাম জানা যায় কবিচন্দ্র। ‘মিশ্র’ ছিল আসলে তাঁদের নবাব-কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। তাঁদেরতাঁর ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ কাব্যের ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ অংশেই তিনি নিজের পরিবার-পরিজন এবং জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে বিশদে বর্ণনা দিয়েছেন পাঁচালীর ঢঙে। চাষাবাদ করেই তাঁদের অন্ন-সংস্থান হত। কাব্য থেকেই জানা যায় যে কবি মুকুন্দরামের এক পুত্রের নাম ছিল শিবরাম এবং এক মেয়ের নাম ছিল যশোদা। শিবরামের স্ত্রীর নাম ছিল চিত্রলেখা।
সেই সময় সিলিমবাজ শহরের জমিদার গোপীনাথ নিয়োগীর তালুকের অধীন ছিল কবির জন্মস্থান দামুন্যা গ্রাম। পরবর্তীকালে গৌড়, বঙ্গ ও উৎকলের অধিপতি হন মানসিংহ এবং তাঁর ডিহিদার নিযুক্ত হন মামুদ শরীফ। এই মামুদ শরীফের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে তাঁদের বংশ-পরম্পরায় রক্ষিত বসতভিটে, জমি-জিরেত সব ছেড়ে গ্রাম থেকে পালাতে বাধ্য হন মুকুন্দরামের পরিবার। তাঁর আরেক ভাই রামানন্দ এবং এক অনুচর দামোদর নন্দী এই যাত্রায় মুকুন্দরামের সাথী হয়েছিলেন। পথে আবার রূপরায় নামে এক ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব লুট হয়ে গেল মুকুন্দরামের। যদু কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন। সেখানে কিছুদিন থেকে গোড়াই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে কিছুদূর গিয়ে তিনি নামেন তেউট্যা গ্রামে, আবার সেখান থেকে দারুকেশ্বর নদী পেরিয়ে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী প্রথমে বাতনগিরি এবং পরে কুচট্যা গ্রামে পৌঁছান। এই যাত্রাপথের মধ্যে না ছিল আহার, না ছিল পরনের কাপড়। এমনকি মাথার উপর ছাদটুকুও ছিল না মুকুন্দরামের। কুচট্যা গ্রামে এসে একদিন ঘুমের মধ্যে দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পান মুকুন্দরাম। তার কিছুদিন পরে ঘুরতে ঘুরতে ১৫৭৫ সালে তিনি এসে ওঠেন বাঁকুড়ার আড়র্যা গ্রামে। এই অঞ্চলের জমিদার বাঁকুড়া রায় তাঁকে আশ্রয় দেন এবং তাঁরই পুত্র রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পরে রঘুনাথ রায়ই এলাকার জমিদার হন এবং তাঁর সময়েই তাঁরই নির্দেশে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচনা করেন ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’। ঐতিহাসিকদের মতে আনুমানিক ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যেই মুকুন্দরাম এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যটি মধ্যযুগীয় বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। কাব্যের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় এই কাব্যটিকে কবি ‘অভয়ামঙ্গল’ বা ‘অম্বিকামঙ্গল’ নামে চিহ্নিত করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য ধারার সাহিত্যের মধ্যে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতই এখানে দেবখণ্ড, নরখণ্ড ইত্যাদি বিভাজন দেখা যায়। দেবখণ্ডের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব, নীলাম্বরের অভিশাপ প্রাপ্তি, হরগৌরীর সংসার-জীবন ইত্যাদি। অন্যদিকে এই কাব্যের নরখণ্ড দুটি ভাগে বিভক্ত আখেটিক খণ্ড এবং বণিক খণ্ড। আখেটিক খণ্ড হল কালকেতু আর ফুল্লরার গল্প এবং বণিক খণ্ড হল ধনপতি, খুল্লনা, লহনা ও ধনপতির পুত্র শ্রীমন্তের গল্প। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডের কাহিনিতে দেখা যায় চণ্ডীর প্ররোচনায় শিব ইন্দ্রের পুত্র নীলাম্বরকে ফুল তোলার কাজে ভুল করায় অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যে পাঠান। তারপর মর্ত্যে ব্যাধ ধর্মকেতুর পুত্ররূপে নীলাম্বরের জন্ম হয় এবং তাঁর নাম হয় কালকেতু। নীলাম্বরের পত্নী ছায়ারও মনুষ্যজন্ম হয় কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা রূপে। ফুল্লরা আরেক ব্যাধ সঞ্জয়কেতুর কন্যা। বড়ো হয়ে কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিবাহ হয়। কালকেতুর অত্যাচারে এদিকে বনের পশুরা সকলে অতিষ্ঠ হয়ে দেবী চণ্ডীর কাছে একযোগে প্রার্থনা জানায় এবং তাঁদের সেই আবেদনে চণ্ডী একদিন সোনার গোসাপের বেশে তথা স্বর্ণগোধিকা সেজে কালকেতুর শিকারে যাওয়ার পথে পড়ে থাকেন। অশুভ সোনালি গোসাপ দেখে কালকেতু প্রচণ্ড রাগে সেটিকে ধনুকের গুণে বেঁধে নিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। সেদিন সারা বন ঘুরেও কোনো শিকার পাননি কালকেতু। এদিকে কালকেতু বেরিয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ফুল্লরার স্বল্পকালীন অনুপস্থিতির সুযোগে দেবী চণ্ডী এক সুন্দরী ষোড়শী রমণীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁকে নিজের সতীন ভেবে আশঙ্কিত ফুল্লরা তাঁর দুঃখের বারমাস্যা শুনিয়ে তাঁকে বিদেয় করার চেষ্টা করেন। তারপর কালকেতু ফিরে আসে ঘরে আর তিনিও দেবীকে বিদেয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনুকের ছিলায় গুণ পরাতে উদ্যত হন। সেই মুহূর্তেই দেবী চণ্ডী নিজ মূর্তি ধারণ করে কালকেতু ও ফুল্লরাকে সাত ঘড়া ধন ও একটি মহামূল্যবান হিরের আংটি দিয়ে গুজরাত নগর পত্তনের আদেশ দেন। দেবীর পরামর্শ অনুযায়ী বিপুল অর্থ ব্যয় করে বন কেটে কালকেতু পত্তন করেন এই গুজরাত নগর। এদিকে ভাঁড়ু দত্ত নামে এক শঠ ব্যক্তির অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রজাদের নালিশ শুনে তাঁকে রাজ্য থেকে বের করে দেন কালকেতু। ভাঁড়ু দত্ত রাগে-ক্রোধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উক্ত্যক্ত করেন এবং কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু বন্দি হন। অবশেষে কাব্যে দেখা যায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্ত করেন এবং কালকেতু তাঁর রাজ্যপাট ফিরে পান। এরপরই মহাসমারোহে দেবী চণ্ডীর পূজা প্রচলিত হয় মর্ত্যে। দীর্ঘকাল রাজ্যভার সামলানোর পর পুত্রের হাতে তা অর্পণ করে কালকেতু ও ফুল্লরা স্বর্গে চলে যান। অন্যদিকে এই কাব্যের বণিক খণ্ডের গল্পটিকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী একটু ভিন্নভাবে সাজিয়েছেন। এই অংশের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ধনপতি আর তাঁর দুই স্ত্রী লহনা ও খুল্লনার কাহিনিকে কেন্দ্র করে। উজানী নগরের নিঃসন্তান বণিক ধনপতি তাঁর স্ত্রী লহনার সম্মতি আদায় করে খুল্লনাকে বিবাহ করেন। বাণিজ্যে যাওয়ার আগে তিনি খুল্লনার সমস্ত ভার দিয়ে যান লহনার উপরে। লহনা ও খুল্লনার মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তাঁদের দাসী দুর্বলা। ধনপতির নাম দিয়ে একটি জাল চিঠি খুল্লনাকে দেওয়া হয় আর সেই চিঠির বয়ান অনুযায়ী খুল্লনা ছাগল চরাবে, ঢেঁকিশালে শোবে, এক বেলা আধপেটা খাবে এবং খুঁয়ার বস্ত্র অর্থাৎ শণের সুতোয় তৈরি মোটা কাপড় পরবে। একদিন বনে ছাগল চরাবার সময় অসতর্কতাবশত খুল্লনার সর্বশী নামে ছাগলটি হারিয়ে যায়। সেই ছাগলের খোঁজ করতে গিয়ে খুল্লনা আবিষ্কার করে পঞ্চদেবকন্যাকে। তাঁদের কাছে চণ্ডীপূজা করতে শেখে সে। এদিকে ধনপতি বাড়ি ফিরে এসে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে লহনাকে অত্যন্ত তিরস্কার করেন। এর কিছুদিন পরেই ধনপতি সপ্তডিঙা সাজিয়ে সিংহল যাত্রা করেন এবং স্বামীর মঙ্গলকামনায় খুল্লনায় চণ্ডীপূজায় রত হয়। শিবের উপাসক ধনপতি তা জানতে পেরে লাথি মেরে চণ্ডীর ঘট ভেঙে দেন। দেবী চণ্ডী এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে সমুদ্রে বিশাল ঝড় তুলে ধনপতির ছয়টি ডিঙা ডুবিয়ে দেন জলে। কোনোরকমে একটি ডিঙা নিয়ে ধনপতি পৌঁছান কালীদহে আর সেখানেই দেবী চণ্ডীর ‘কমলে-কামিনী’ রূপ দেখেন। সিংহলে গিয়ে সেখানকার রাজাকে এই ‘কমলে-কামিনী’র কথা বলায় রাজা তা বিশ্বাস না করে উপরন্তু ধনপতিকে কারারুদ্ধ করেন। এদিকে খুল্লনার পুত্র শ্রীমন্ত নড়ো হয়ে বাবার খোঁজে সিংহল যাত্রা করেন এবং পথে তিনিও সেই ‘কমলে-কামিনী’ মূর্তি দেখতে পান। কিন্তু তাঁর কথাও সিংহলের রাজার বিশ্বাস হয় না, ফলে তাঁর শিরশ্ছেদ করার জন্য তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চণ্ডীর কৃপায় অবশেষে সিংহলরাজ ‘কমলে-কামিনী’ মূর্তি দেখেন। ফলশ্রুতিতে রাজা শ্রীমন্তকে অর্ধেক রাজত্ব দেন এবং তাঁর কন্যা সুশীলার সঙ্গে তাঁর বিবাহও দেন। কিছুকাল পরে পুত্র ও পুত্রবধূকে সঙ্গে ধনপতি ফিরে আসেন স্বদেশে। তারপর ধনপতি নিজেই চণ্ডীর পূজা শুরু করেন।
জমিদার রঘুনাথ রায় এই কাব্যটি লেখার পর মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে কবিকঙ্কণ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন বলে জানা যায়। অনেকে বলে থাকেন মুকুন্দরাম যেহেতু পাঁচালীর ছন্দে লেখা এই কাব্যটি গানের মত করে উপস্থাপন করতেন এবং সেই সময় পায়ে বাঁধা ঘুঙুরের সাহায্যে তাল দিতেন, তাই এই উপাধি পেয়েছিলেন তিনি।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর মৃত্যুর সময়কাল সঠিকভাবে জানা যায়নি।
তথ্যসূত্র
- শ্রী সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, 'সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান', সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৪১৩
- https://en.wikipedia.org/
- https://koulalpotrika.com/
- https://www.narajolerajcollege.ac.in/
- https://www.bongodorshon.com/