কালীঘাট মন্দির পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এবং চার আদি শক্তিপীঠের একটি। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সতীর ডান পায়ের আঙুল এখানে পড়েছিল। মতান্তরে বলা হয়ে থাকে এখানে সতীর মুখ খন্ড পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব হলেন নকুলেশ্বর। এটি হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সারা বছর এই মন্দির প্রচুর ভক্তের ভিড়ে ভরে থাকে, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ও কালীপূজার দিন মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম ঘটে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় এখানে সতীর ডান পায়ের আঙুল এখানে পড়েছিল,মতান্তরে আবার বলা হয়ে থাকে এখানে সতীর মুখ খন্ড পড়েছিল।
এই মন্দির অতি প্রাচীন। বর্তমানে যেখানে মন্দিরটি অবস্থিত, প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে সেখানে একসময় জঙ্গল ছিল। ওখানে মানুষ সচরাচর যেত না।একদল সন্ন্যাসী নদীপথে ওই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পথ হারিয়ে ওখানে কুটির তৈরি করেন। সেখানে বসবাস করার সময় তারা একটি বড় কষ্টিপাথরের শিলা খন্ডকে আবিষ্কার করেন এবং সেটিকে কালীরূপে পুজো করেন (যেটি বর্তমানে মায়ের মূর্তি)। পরে সেখানে আত্মারাম ও ব্রহ্মনন্দ নামে আরও দুই সন্ন্যাসী এলে তারা দূরে উজ্বল আলোর ন্যায় কিছু চকচক করতে দেখে তার সামনে যান। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন,মানুষের পায়ের পাতার আকারের এক প্রস্তর খন্ড উজ্বল আলোর ন্যায় চকচক করছে । এই শিলা খন্ডটিকে তারা পুরাণের সতীর দক্ষিণ পায়ের ছোট আঙুল বলে দাবি করেন। দীর্ঘকাল কালীঘাটের কালি মায়ের সেবার দায়িত্ব সন্ন্যাসীদের হাতেই ছিল। তখন থেকেই এই কালীঘাট সতীপীঠ হিসাবে প্রসিদ্ধ হয়েছে। অনেকে এও মনে করেন যে এই কালীঘাট থেকেই কলকাতা নামটি এসেছে। আজকের মন্দিরের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, তা ১৮০৯ সালে বড়িশার বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী জমিদার বংশের উদ্যোগে আদি গঙ্গার তীরে নির্মিত হয়েছে।
এই সতীপীঠের ভৈরব এবং পীঠরক্ষক হলেন নকুলেশ্বর দেব। যিনি শিবের রূপ। ভৈরব অর্থাৎ সতীপীঠের দেবীর স্বামী। ভৈরবের মন্দিরটি কালীমন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। নীলষষ্ঠী বা শিবরাত্রির সময়ে এখানে খুব ভিড় হয়। কালীমন্দিরের পশ্চিমদিকে রয়েছে কৃষ্ণের মন্দির। এই মন্দিরে রামনবমী বা দোলযাত্রা প্রভূতি অনুষ্ঠানে প্রচুর ভিড় হয়ে থাকে।
কালীঘাট মন্দিরে কালীমূর্তির জিভ, দাঁত, মুকুট সব সোনার তৈরি। হাত ও মুন্ডমালাটিও সোনার। মন্দিরের মধ্যে একটা সিন্ধুকে মাতা সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রাখা আছে, যেটি কারোর সামনে বার করা হয় না। দুর্গাপূজা, কালীপূজায় কালীঘাটে মায়ের বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময়ে বিশেষ করে কালীপূজার সময় মন্দিরে অগণিত ভক্তের ভিড় হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে পূজিত হন লক্ষ্মীরূপে। কালীপূজা ছাড়াও পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপূজার দিন মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম ঘটে।
তথ্যসূত্র
- সত্যের সন্ধানে ৫১ পীঠ - হিমাংশু চট্টোপাধায়, মহাতীর্থ কালীঘাট পাতা নং ৩০- ৫২
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kalighat_Kali_Temple
- https://www.culturalindia.net/
- https://www.thedivineindia.com/51-shakti-peeths/
- https://www.kolkata24x7.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://bangla.asianetnews.com/
4 comments