চাকলা ধাম ভ্রমণ

চাকলা ধাম ভ্রমণ

চাকলা ধাম হল বাঙালি হিন্দুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই তীর্থস্থান বাবা লোকনাথের জন্মভূমি। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই বিতর্ক ভক্তদের ভক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি এতটুকু। কালীঘাট এবং দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পরেই পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ধর্মীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হল চাকলা ধাম। সারা বছর ধরে হাজার হাজার ভক্তের আনাগোনা হয় এখানে, তবে বাবা লোকনাথের তিরোধান উৎসবের সময় অসংখ্য ভক্তের ভিড় হয়।

চাকলা ধাম উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় বসিরহাট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

চাকলা ধাম মন্দির। ছবি সববাংলায়
চাকলা ধাম মন্দির। ছবি সববাংলায়

বাবা লোকনাথ বা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী তথা সিদ্ধপুরুষ। বাঙালি হিন্দুদের কাছে তিনি অত্যন্ত পূজনীয়। তাঁর বাবার নাম রামকানাই ঘোষাল, মায়ের নাম কমলাদেবী। বাবার ইচ্ছায় বালক লোকনাথ ব্রহ্মচর্য ধারণ করে গৃহত্যাগ করেন। তাঁর কর্মময় তীর্থক্ষেত্র হল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রম। তিনি বলতেন ভক্তরাই ভগবান। ভক্তের মাঝেই ভগবান বিদ্যমান। তাঁর বিখ্যাত উক্তি – “রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও, আমি রক্ষা করিব।” ভক্তদের মনে সান্ত্বনা দেয়। তাঁর ভক্তেরা কোন বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করেন। তবে তাঁর জন্মস্থান নিয়ে একাধিক মতভেদ রয়েছে। কারও মতে তিনি চাকলা ধামে জন্মেছিলেন, তো কারও মতে তিনি কচুয়া ধামে জন্মেছিলেন। তবে ভক্তেরা এই তর্কে না গিয়ে দুই স্থানেই তীর্থ করতে যান। রাজা নৃসিংহ দেব রায় চাকলা ধামের মন্দিরটির নির্মাণ শুরু করেন এবং পরে তাঁর বিধবা স্ত্রী রানী শঙ্করী মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কলকাতা থেকে চাকলা ধামের দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। গাড়িতে গেলে যশোর রোড ধরে গিয়ে গুমা ক্রসিং থেকে বাঁক নিতে হবে, প্রথমে বাদর বাজার এবং শেষে চাকলা গ্রামের চাকলা ধামে পৌঁছাবেন। ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকালে করে গুমা রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন। তারপর গাড়ি বা অটো করে গুমা রেলওয়ে স্টেশন থেকে চাকলা ধামে পৌঁছাতে পারেন।

চাকলা ধাম ভ্রমণের জন্য রাত্রিবাসের প্রয়োজন নেই। পর্যটকেরা মূলত দিনের দিন ঘুরে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু দূরবর্তী কোনও জেলা থেকে গেলে এক-দুদিন এয়ারপোর্টের কাছে বা কলকাতার অন্যান্য হোটেলে থেকে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলি একবারে ঘুরে নিতে পারেন।

চাকলা ধামের মূল আকর্ষণ এখানের মন্দির। মন্দিরটি বিশাল জমির উপর নির্মিত এবং সমস্ত মন্দিরটি মার্বেল পাথরে তৈরি। মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে। মন্দিরের বাইরে জুতো কাউন্টারে মাত্র দুই টাকা মূল্যের বিনিময়ে জুতো রাখুন। তবে জুতো ফেরত নেওয়া অবধি জুতোর কুপনটি যত্নে রাখবেন। মন্দির সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা অবধি খোলা থাকে। মূলত দুটি মন্দির রয়েছে এখানে। মূল মন্দিরে বাবা লোকনাথের মূর্তি রয়েছে। ভক্তেরা সেখানে পূজা দেন। পূজার জন্য লম্বা লাইন পড়ে এখানে। পূজার জন্য মন্দিরটি সকালে একবার এবং বিকেলে একবার খোলে। পূজার সময় হল সকাল ৮টা থেকে ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা। মূল মন্দিরের ভেতরের ছবি তুলবেন না। পাশে দোতলা মন্দিরে বেশ কয়েকটি দেবতার বিগ্রহ রয়েছে। এই মন্দিরটির চূড়ায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মূর্তি রয়েছে এবং প্রবেশ পথে রয়েছে বিশালাকায় ষাঁড়ের মূর্তি। এই মন্দিরের মেঝেতে বসে বিশ্রাম করুন কিন্তু মন্দিরটি নোংরা করবেন না। মন্দিরের গায়ে কিছু লিখলে ৫০০ টাকা ফাইন করা হয়। মন্দিরের সামনে রয়েছে বিশাল বড় মাঠ।

মাঝে যে সময়টা পূজা বন্ধ থাকে, তখন মন্দিরের বাইরে কাউন্টার থেকে রাজভোগের কুপন বিক্রি করা হয়। কুপন বিক্রি বেলা ১২ঃ৩০ থেকে শুরু হয়। দুপুর একটা দেড়টার মধ্যে খাবারের কুপন সংগ্রহ করুন। এর পরে কুপন কাউন্টার বন্ধ হয়ে যায়। কুপন সংগ্রহ করে খাবারের লাইনে দাঁড়াতে পারেন। এখানে বসে খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়ে। আপনার হাতে সেই সময় না থাকলে আপনি ৫ -১০ টাকা বেশি মূল্যের বিনিময়ে ভোগ পার্সেল করে নিতে পারেন। মন্দির চত্বরে একটি বড় গাছ রয়েছে, যেখানে ভক্তেরা মানত করে সুতো বেঁধে আসেন। প্রধান ফটকের সামনে একটি বড় পার্কিং লট রয়েছে। গাড়ি নিয়ে গেলে সেখানেই গাড়ি রাখুন।

মূল মন্দিরের বাইরে। ছবি সববাংলায়

পূজা দেওয়ার তাড়া না থাকলে একই দিনে কচুয়া ধামও যেতে পারেন। চাকলা ধাম থেকে কচুয়া ধামের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। নিজের গাড়ি থাকলে সুবিধা। যদি নিজের গাড়ি নাও থাকে, তাহলেও চাকলা ধাম মন্দিরের বাইরে কচুয়া ধাম নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক গাড়ি পাওয়া যায়।

সারা বছর ধরেই এখানেই লোকের আনাগোনা থাকে। বছরের যে কোন সময়েই এখানে যেতে পারেন। তবে উৎসবের সময় মন্দির আরও সুন্দর ভাবে সেজে ওঠে। বাবা লোকনাথের তিরোধান উৎসবের সময় অসংখ্য ভক্তের ভিড় হয়। এছাড়াও জন্মাষ্টমী উৎসবেও বিশেষ আয়োজন হয়।

ভোগের লাইনের বাইরে সেলস কাউন্টার আছে যেখানে লোকনাথ বাবার ছবি, বই, অডিও, সিডি বিক্রি করা হয়। এছাড়া এখানে গ্রামের মানুষ মন্দিরের বাইরে টাটকা সবজি বিক্রি করে। এই সবজি অত্যন্ত সস্তা। যাঁরা গাড়ি নিয়ে যান তাঁদের অনেকেই সেখান থেকে সবজি কিনে আনেন।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – গাড়িতে গেলে যশোর রোড ধরে গিয়ে গুমা ক্রসিং থেকে বাঁক নিতে হবে, প্রথমে বাদর বাজার এবং শেষে চাকলা গ্রামের চাকলা ধামে পৌঁছাবেন। ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে শিয়ালদহ-বনগাঁ লোকালে করে গুমা রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন। তারপর গাড়ি করে চাকলা ধামে পৌঁছাতে পারেন।
  • কোথায় থাকবেন – এখানে রাত্রিবাসের প্রয়োজন নেই। পর্যটকেরা মূলত দিনের দিন ঘুরে বাড়ি ফিরে যান।
  • কী দেখবেন – চাকলা ধাম এখানের প্রধান দর্শনীয় স্থান। চাইলে কাছাকাছি কচুয়া ধাম ঘুরে আসতে পারেন।
  • কখন যাবেন – সারা বছরই যাওয়া যায়।
  • সতর্কতা
    • মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে। মন্দিরের বাইরে জুতো কাউন্টারে মাত্র দুই টাকা মূল্যের বিনিময়ে জুতো রাখুন। তবে জুতো ফেরত নেওয়া অবধি জুতোর কুপনটি যত্নে রাখবেন।
    • দুপুর একটা দেড়টার মধ্যে খাবারের কুপন সংগ্রহ করুন। এর পরে কুপন কাউন্টার বন্ধ হয়ে যায়।
    • মন্দিরের মধ্যে যেখানে সেখানে নোংরা আবর্জনা ফেলবেন না।
    • মূল মন্দিরের ভেতরের ছবি তুলবেন না।
    • মন্দিরের দেওয়ালে নিজের নাম লিখে এর স্থাপত্য নষ্ট করবেন না। এরকম করলে ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • বসে খাওয়ার জন্য প্রচুর লম্বা লাইন পড়ে। আপনার হাতে সেই সময় না থাকলে আপনি ৫ -১০ টাকা বেশি মূল্যের বিনিময়ে ভোগ পার্সেল নিতে পারেন।
    • মন্দিরের বাইরে অত্যন্ত সস্তায় টাটকা সবজি বিক্রি হয়। অনেকেই সেখান থেকে তা কিনে আনে।

সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://www.swarnabdutta.com/
  3. https://www.trainspnrstatus.com/

আপনার মতামত জানান