হিন্দু ধর্মের এক কিংবদন্তী তান্ত্রিক বাঙালি সাধক বামাক্ষ্যাপা (Bamakhepa)। বীরভূমে অবস্থিত তারাপীঠ মন্দির ও মহাশ্মশানে সাধনা করেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সাধক বামাক্ষ্যাপা ‘তারা মায়ের ছেলে’ নামেও লোকমুখে পরিচিত। নানাবিধ অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে তাঁর জীবন জড়িয়ে আছে। এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক শক্তি নিহিত ছিল তাঁর মধ্যে। কৈলাসপতি বাবা এবং স্বামী মোক্ষদানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারণকবি মুকুন্দ দাস, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু বিখ্যাত মানুষ বামার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তারাপীঠে।
১৮৩৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তথা ১২৪৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের মহাশিবরাত্রির দিন বীরভূম জেলার তারাপুরের কাছে আটলা গ্রামে বামাক্ষ্যাপার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম রাজকুমারী দেবী। সর্বানন্দ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। গ্রামের ঘরে-ঘরে নিত্যপূজা এবং খুব সামান্য চাষের জমি থেকে যে ফসল পাওয়া যেত, তা থেকেই তাঁর সংসার চলত। ছোটবেলায় বামাক্ষ্যাপার নাম ছিল ‘বামাচরণ’। রামচরণ নামে তাঁর একটি ছোট ভাই এবং জয়কালী নামে তাঁর এক বড় দিদি ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই বামাচরণ তাঁর বয়সী অন্যান্য ছেলেমেয়েদের থেকে স্বভাবে আলাদা ছিলেন। সমবয়সীদের সঙ্গে মিলে খেলাধুলো করার থেকে তিনি মাটি দিয়ে নানারকমের দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি ও সেই মূর্তি পূজা-অর্চনা করতে বেশি ভালোবাসতেন।
একটু বড় হলে তাঁর বাবা তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বামার লেখাপড়ার প্রতি একেবারেই আগ্রহ ছিল না। পাঠশালায় গিয়েও তিনি ঠাকুরের নাম করতেন। ফলে বামার প্রথাগত শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়নি। বাবার সঙ্গে বামা প্রায়ই তারাপীঠে তারা মায়ের মন্দিরে যাতায়াত করেন। সেই মন্দিরে সর্বানন্দ প্রায়দিনই বেহালা বাজাতেন এবং বামা শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। কখনো বা গানের তালে বামা নাচতেও শুরু করতেন। এইভাবে চলতে চলতে বামার প্রায়ই ‘সমাধি’ হতে থাকে। কানের কাছে ‘তারা তারা’ নাম শোনালে তবে বামার সমাধি ভাঙে। এইসব আচরণ দেখে সাধারণ মানুষ বামাকে ‘ক্ষ্যাপা’ বলতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই বামাচরণ তারা মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
বামাচরণের যখন আঠারো বছর বয়স, তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। সংসার চালাবার জন্য বামা কাজ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু বিশেষ লেখাপড়া জানতেন না বলে কেউ তাঁকে কাজ দিতে রাজি হন না। অবশেষে মুহুটি গ্রামের জমিদার বাড়িতে কালীমন্দিরের ফুল তোলার কাজ পেলেন বামাচরণ। কিন্তু কাজে বামার মন বসে না। তাঁর অন্যমনস্ক ভাব দেখে মন্দির কর্তৃপক্ষ ফুল তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে বামাকে রাখলেন ঠাকুরের ভোগ রান্না করার কাজে। সেখানেও রোজই কিছু না কিছু ভুল করতে থাকেন বামাচরণ। সবাই তাঁকে ‘পাগল’ বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত জমিদার মশাই বামাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন। বাড়ি ফিরে এলেন বামা। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া সামান্য জমি-জমাতে চাষ করতে লেগে গেলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সে বছর ফসল ভালো হল না। নিরুপায় হয়ে রাজকুমারী দেবী বামাচরণ আর তার ভাই রামচরণকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। মামার বাড়িতে গিয়ে গরু চরানোর দায়িত্ব পেলেন বামা। কিন্তু দুই ভাইয়ের উপর ভীষণ অত্যাচার করতে থাকেন তাঁদের মামা ও মামী। তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বামাচরণের পৈতৃক সম্পত্তি তাঁদের নিজেদের নামে লিখিয়ে নেওয়া। সেখানে কয়েকদিন কাটানোর পর মামা-মামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বামা বাড়িতে ফিরে এলেন। এরপর তারাপীঠ মহাশ্মশানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ব্রজবাসী কৈলাসপতি বাবা ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ মোক্ষদানন্দের। তাঁদের কাছে বামা একে একে শিখতে লাগলেন বেদ ও শাস্ত্রপাঠ। এই সময় মায়ের অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করেন বামা। এর কয়েকদিন পরে তারাপীঠ মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসিয়ে বামাকে তান্ত্রিকমতে সন্ন্যাসে দীক্ষা দেন কৈলাসপতি বাবা। কয়েকদিন সাধনা করার পর সিদ্ধিলাভ করেন বামাচরণ। কথিত আছে তাঁর ইষ্টদেবী তারা মা নাকি স্বয়ং আবির্ভূতা হন তাঁর সামনে। এরপর থেকে তিনি পরিচিত হন ‘বামাক্ষ্যাপা’ নামে। কৈলাসপতি বাবা ও মোক্ষদানন্দের সঙ্গে কাশীধাম ও হরিদ্বার ঘুরতে যান বামাক্ষ্যাপা। সেখানে তাঁর সঙ্গে মহান সাধক ত্রৈলঙ্গ স্বামীর পরিচয় হয়। কাশী থেকে ফিরে আসার পর বামাক্ষ্যাপার মা রাজকুমারী দেবীর মৃত্যু হয়। যোগবলে মায়ের মৃত্যুর কথা জানতে পেরে বামা উপস্থিত হন নিজের জন্মভূমি আটলা গ্রামে। তাঁর ইচ্ছা ছিল তারা মায়ের পায়ের নিচে গর্ভধারিণী মাকে সৎকার করবেন। শোনা যায়, এই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এক অলৌকিক কাণ্ড করেছিলেন বামাক্ষ্যাপা। মায়ের মৃতদেহ পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সাঁতার দিয়ে পার হয়েছিলেন বর্ষাকালের উত্তাল দ্বারকেশ্বর নদ। তারাপীঠ মহাশ্মশানে তারা মায়ের পায়ের নিচে এভাবেই মায়ের সৎকার করেছিলেন বামাক্ষ্যাপা। মায়ের শ্রাদ্ধের দিনও এমনই আরেকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। নিমন্ত্রিতরা খেতে বসার সময় আকাশে ভয়ানক মেঘ জমেছে দেখে নিজের হাতের একটি কঞ্চি দিয়ে সব অতিথিদের চারদিকে একটি গণ্ডি টেনে দিয়েছিলেন বামা। শোনা যায়, সেদিন সারা গ্রাম বৃষ্টির জলে ভেসে গেলেও সেই গণ্ডির ভিতরে একফোঁটা জল ঢোকেনি।
আস্তে আস্তে লোকের মুখে মুখে এইসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সবাই বুঝতে পারে বামাক্ষ্যাপা কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি সিদ্ধপুরুষ। দলে দলে মানুষ নিজেদের নানান সমস্যা নিয়ে বামাক্ষ্যাপার কাছে ছুটে আসতে থাকে। এইসময় ঘটে আর একটি অদ্ভুত ঘটনা। একদিন তারা মায়ের মন্দিরে পুজো শুরু হওয়ার আগেই বামাক্ষ্যাপা মন্দিরে ঢুকে মায়ের ভোগ খেতে শুরু করে দেন। পুরোহিত ও দর্শনার্থীরা ভীষণ রেগে যান এবং মন্দিরের দারোয়ানরা বামাকে ভীষণ মারধোর করে। তাঁকে মন্দির থেকে বের করে দেওয়া হয়। সেই রাতেই মন্দিরের তৎকালীন সেবায়েত নাটোরের রাণী ভবানী স্বপ্ন দেখেন, তারাদেবী মন্দির ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে মা বলেন যদি তাঁর ভোগের আগে বামাক্ষ্যাপার ভোগের ব্যবস্থা রাণীমা করতে পারেন তবেই মা মন্দিরে থাকবেন। পরদিন সকালে মন্দিরে গিয়ে রাণীমা প্রধান পুরোহিতকে বরখাস্ত করে তাঁর জায়গায় নিয়োগ করেন বামাক্ষ্যাপাকে। এরপর থেকে বামা মায়ের পুজো করতে থাকেন এবং ভক্তদের মায়ের মহিমার কথা প্রচার করতে থাকেন। বামাক্ষ্যাপার মতে, কলিযুগে জীবের বেশি ধর্ম-কর্ম করার প্রয়োজন নেই। শুধুই ইষ্টমন্ত্র জপ করলেই মিলবে ফল। একমাত্র মন্ত্র জপ করলেই ভক্তির উদয় হবে, বিশ্বাস জন্মাবে, মনের দৃঢ়তা ও শক্তি বাড়বে। মন্ত্র জপ করতে না পারলে শুধু তারা মাকে একমনে ডাকলেও একই ফল পাওয়া যাবে। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার মহারাজ যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে বামা কলকাতায় আসেন। সেখানেও তাঁর আসার খবর পেয়ে লক্ষ লক্ষ লোক তাঁকে দেখতে আসেন। বামাক্ষ্যাপাও তাঁদের সবাইকে সাধ্যমত সাহায্য করেন আর তারা মায়ের মহিমার কথা বলেন। আদিগঙ্গায় স্নান ও কালীঘাটের মা কালীকে দর্শন করে বামাক্ষ্যাপা ফিরে এলেন তারাপীঠে। অনেক দুরারোগ্য রোগ নিয়েও ভক্তেরা বামার কাছে আসত রোগমুক্তির আশায়। বামাক্ষ্যাপা সেই সব রোগ সারিয়েও দিতেন। কিন্তু কোনো দৈব ওষুধ বা তাবিজ-কবচ প্রভৃতি তিনি দিতেন না কাউকেই। সবকিছুরই সমাধান করতেন যোগবলে এবং তাঁর ইষ্টদেবীর নাম জপ করে। তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কার্তিক গোস্বামী, তারানাথ নামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি পরবর্তীকালে পরিচিত হয়েছিলেন ‘তারাক্ষ্যাপা নামে, নগেন পাণ্ডা প্রমুখরা। তবে বামাক্ষ্যাপা কাউকে মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছিলেন বলে শোনা যায় না।
বাংলার অনেক বিখ্যাত মানুষ বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে দেখা করতে তারাপীঠে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ওরফে নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসার পর উনিশ বছরের নরেন্দ্রনাথ তারাপীঠে গিয়েছিলেন বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন করার জন্য। এক বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ব্রহ্মজ্ঞানী সাধকদের চারটি অবস্থা হয় যথা, বালকবৎ, জড়বৎ, উন্মাদবৎ এবং পিশাচবৎ। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের মধ্যে বাকি তিনটি অবস্থা থাকলেও পিশাচবৎ অবস্থা ছিল না। তাই নরেন্দ্রনাথ পিশাচ লক্ষণধারী বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, নরেন্দ্রনাথকে দেখে বামাক্ষ্যাপা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তিনি একদিন হিন্দু ধর্মের মুখ উজ্জ্বল করবেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও গিয়েছিলেন তারাপীঠে তারা মায়ের মন্দির এবং বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন করতে। বামাক্ষ্যাপাই দেবেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে, রেলগাড়িতে করে যেতে যেতে দেবেন্দ্রনাথ মাঠের মধ্যে একটি বিশাল ছাতিম গাছ দেখতে পাবেন। সেই ছাতিম গাছের নিচে যেন তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলেই তিনি শান্তি পাবেন। দেবেন্দ্রনাথ তারাপীঠ থেকে ফেরার পথে সত্যিই মাঠের মধ্যে দেখতে পেলেন একটি বিশাল ছাতিম গাছ। পরবর্তীকালে সেই ছাতিম গাছের নিচেই গড়ে ওঠে শান্তিনিকেতন। এছাড়াও স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারণকবি মুকুন্দদাস প্রমুখেরা তারাপীঠে এই মহান সাধককে দর্শন করতে এসেছিলেন। সবার সম্বন্ধেই বামাক্ষ্যাপা কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর কথাগুলিই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
শোনা যায়, মৃত্যুর আগেই বামাক্ষ্যাপা তাঁর দেহকে সমাধি দেওয়ার জায়গা ভক্তদের জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কথামতই তারাপীঠ মহাশ্মশানের ভিতর একটি নিমগাছের নিচে বামাক্ষ্যাপার দেহকে সমাধি দেওয়া হয়। সেই সমাধির উপর তৈরি করা হয় সমাধি-মন্দির।
১৯১১ সালের ১৮ জুলাই তথা বাংলা ১৩১৮ সালের ২ শ্রাবণ ৭৩ বছর বয়সে বামাক্ষ্যাপার মৃত্যু হয়।
One comment