ত্রৈলঙ্গ স্বামী

ত্রৈলঙ্গ স্বামী

ত্রৈলঙ্গ স্বামী (Trailanga Swami) একজন ভারতীয় হিন্দু সাধক। ত্রৈলঙ্গ স্বামী সম্পর্কে শোনা যায় তিনি নাকি প্রায় ২৮০ বছর জীবিত ছিলেন।১৩৬ কেজি ওজন সম্পন্ন এই সাধক সম্পর্কে তাঁর ভক্তেরা মনে করে থাকেন তিনি ভগবান শিবের মানব রূপী অবতার। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ‘বারাণসীর চলন্ত শিব’ নামে নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন দশনামী সম্প্রদায়ের এই সাধকের শিষ্য ছড়িয়ে আছে সারা ভারতবর্ষে।

১৬০৭ সালের ২৭ নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের কুম্বিলাপুরমের ভিজিয়ানগরম নামক স্থানে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর জন্ম হয়। মতান্তরে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর জন্ম হয়েছিল ১৫২৯ সালে। তাঁর বাবার নাম ছিল নরসিংহ রাও ও মায়ের নাম ছিল বিদ্যাবতী দেবী। তাঁরা উভয়েই পরম শিবভক্ত ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন শিবের দয়াতেই তাঁদের সন্তানপ্রাপ্তি হয়, তাই তাঁরা সন্তানের নাম রাখেন ‘শিবরাম’। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে পর্যন্ত ত্রৈলঙ্গ স্বামী এই নামেই পরিচিত ছিলেন।

১৬৪৭ সালে শিবরামের বাবার মৃত্যু হলে শিবরাম মায়ের থেকে একটি ঘটনার কথা জানতে পারেন। তাঁর মাতামহ মৃত্যুর আগে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যে মানব জাতির মঙ্গলার্থে তিনি নিজ কন্যার গর্ভে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে দেবী কালীর সাধনা করতে চান। শিবরামের মায়ের বিশ্বাস শিবরামের মধ্যেই তাঁর মাতামহের পুনর্জন্ম হয়েছে। এই কথা জানতে পেরে সমস্ত সম্পত্তি ও পারিবারিক দায়িত্ব সৎ ভাই শ্রীধরের হাতে ছেড়ে দিয়ে শিবরাম নিকটস্থ কালী মন্দির ও পুণ্যক্ষেত্রে গিয়ে মা কালীর সাধনা শুরু করেন। তবে কখনোই তিনি নিজের জন্মদাত্রী মাকে ছেড়ে বেশি দূরে যাননি।

১৬৬৯ সালে বিদ্যাবতী দেবীর মৃত্যু হয়। শিবরাম তাঁর মায়ের চিতাভস্ম সংগ্রহ করে রেখে দেন। সেই ভস্ম গায়ে মেখে তিনি দিন-রাত ‘তীব্র সাধনা’য় মগ্ন হয়ে থাকতেন। ক্রমে শিবরাম শ্মশানে ছোট চালাঘর বানিয়ে নিভৃতে বাস শুরু করলেন।

প্রায় কুড়ি বছর এইভাবে সাধনার পর আটাত্তর বছর বয়সে তিনি দর্শন পান পাঞ্জাব থেকে আগত স্বামী ভগীরথানন্দ সরস্বতী নামে এক সন্ন্যাসীর। ১৬৮৫ সালে এই সন্ন্যাসীই শিবরামকে সন্ন্যাসে দীক্ষা দেন। নতুন জীবনে শিবরামের নাম হয় ‘স্বামী গণপতি সরস্বতী’। এরপর গণপতি অতি কঠোর জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং জন্মভূমি ত্যাগ করে গুরুর সঙ্গে তীর্থযাত্রায় রওনা হন। বিভিন্ন স্থান ঘুরে ১৭৩৩ সালে তিনি প্রয়াগ এবং সেখান থেকে ১৭৩৭ সালে বারাণসীতে এসে এখানেই বসবাস করতে শুরু করেন।

দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত স্বামী গণপতি তেলঙ্গ দেশ থেকে এসেছেন বলে বারাণসীর স্থানীয় মানুষ তাঁকে ‘ত্রৈলঙ্গ স্বামী’ বলে অভিহিত করতে শুরু করে। সমগ্র জীবনে তিনি অসি ঘাট, হনুমান ঘাটের বেদব্যাস আশ্রম, দশাশ্বমেধ ঘাট প্রভৃতি স্থানে বসবাস করতেন। তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত নগ্ন গাত্রে বারাণসীর বিভিন্ন রাস্তায় শিশুর মতো অনুদ্বিগ্ন চিত্তে ঘুরে বেড়াতে। তাঁকে নিয়ে অজস্র লোককথা, তাঁর অলৌকিক মহিমার কাহিনি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। শোনা যায় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গঙ্গার বুকে ভেসে থাকতেন অসুস্থ না হয়েই। ত্রৈলঙ্গ স্বামী বেশিরভাগ সময়েই মৌনব্রত অবলম্বন করে থাকতেন। তাঁর অলৌকিক শক্তির কথা জানতে পেরে দলে দলে তীর্থযাত্রীরা তাঁর কাছে নিজেদের দুর্ভাগ্যের প্রতিকার চাইতে আসতেন। বারাণসীতে থাকাকালীন অনেক বাঙালি সাধু-সন্তরা তাঁর সাথে দেখা করেছেন যাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী, ভগবান গাঙ্গুলি, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্যামাচরণ লাহিড়ী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এবং সাধক বামাক্ষ্যাপা।

ত্রৈলঙ্গ স্বামী কখনো কারও থেকে কিছু চাইতেন না। তাঁকে যে যা দিতেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। তাঁর শেষ জীবনে তিনি অজগরবৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন, অর্থাৎ তিনি কখনোই নিজের স্থান ত্যাগ করতেন না, ভক্তরা তাঁকে যা দিতেন তাই খেতেন। তাঁর শিষ্যরা মনে করতেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী ভগবান শিবের অবতার।

ত্রৈলঙ্গ স্বামীর আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে রবার্ট আরনেট লিখেছেন যে, ত্রৈলঙ্গ স্বামীর অলৌকিক কার্যকলাপের ঘটনাগুলি ভালোভাবে নথিভুক্ত এবং এই সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বহু মানুষ। কোনওভাবেই এই ঘটনাবলীকে নিছক ‘মিথ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শোনা যায় অনেক সময় ত্রৈলঙ্গ স্বামী তীব্র বিষ পান করা সত্ত্বেও তাঁর কোনো অনিষ্ট হয়নি। একবার এক সাধু ত্রৈলঙ্গ স্বামীর ক্ষতি করার জন্য দুধের বদলে তাঁকে চুনগোলা জল খেতে দিয়েছিলেন। স্বামী অবলীলায় সেই জল পান করেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থও থাকেন। বারাণসীর এক সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর যত্রতত্র নগ্ন ঘুরে বেড়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। শোনা যায় বন্ধ গারদ থেকে ত্রৈলঙ্গ স্বামী অনায়াসেই বেরিয়ে এসেছিলেন। বাধ্য হয়ে ওই সাহেব তখন হুকুম দেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁর ইচ্ছানুসারে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, কেউ তাঁকে কোনোরকম বাধা দিতে পারবেনা। এমনই নানা অলৌকিক কাহিনী আজও বারাণসীর অলিগলিতে কান পাতলে শোনা যায়।

১৮৬৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে দর্শন করতে এসেছিলেন। রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বলতেন “হাঁটা-চলা করা, কথা বলা কাশীর জ্যান্ত বিশ্বেশ্বর’’। মণিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভাগ্নে হৃদয় দেখলেন সেখানে শুয়ে আছেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী। শ্রীরামকৃষ্ণের পদধ্বনি শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। কেউই কোনো কথা বললেন না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই সেরে নিলেন ভাবের আদানপ্রদান। তখনই শ্রীরামকৃষ্ণের “ঈশ্বর এক না অনেক?’’ এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী ইশারায় বলেছিলেন, “সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদির ভেদ রয়েছে ততক্ষণ অনেক।”

গৃহী সন্ন্যাসী শ্যামাচরণ লাহিড়ীও কিছুটা এরকমই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাঁকে দেখেও ত্রৈলঙ্গ স্বামী কোনো কথা বলেননি। শ্যামাচরণ লাহিড়ী চলে যাওয়ার পর এক শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যোগমার্গের যে অবস্থায় পৌঁছালে সাধক নির্দ্বিধায় নিজের পরনের বস্ত্রও ত্যাগ করতে পারে, ধুতি-পাঞ্জাবী পরা লাহিড়ী মশাই অনেকদিন আগেই সেই জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁকে আর স্বামীর কিছু বলার নেই। আবার সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দেখেছিলেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী প্রস্রাব দিয়ে দেবী কালীর পূজা করছেন। এই অদ্ভুত আচরণের জন্য বিজয়কৃষ্ণ বিস্মিত হলে স্বামী তাঁকে বলেছিলেন সেটি ছিল গঙ্গাজল। এই পৃথিবীর সব কিছুতেই ঈশ্বর আছেন। শুধু মনের চোখকে খুলে দিতে পারলেই সব একাকার হয়ে যায়। ত্রৈলঙ্গ স্বামী বিজয়কৃষ্ণকে দীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী প্রভুপাদ তাঁর কাছে দীক্ষা নিতে না চাইলে ত্রৈলঙ্গ স্বামী তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি কারোর গুরু নন বা হতেও চাননা,শুধু ঈশ্বরের আদেশে দেহের শুদ্ধিকরণের জন্য বিজয়কৃষ্ণকে দীক্ষা দিতে চান। এই কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণের মন পরিবর্তিত হয়। তিনি ভক্তিভরে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর দেওয়া মন্ত্র গ্রহণ করেন।

ত্রৈলঙ্গ স্বামী ধর্মের অনেক জটিল বিষয়কে অনেক সহজ কথায় সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত তাঁর কথা শুনতে। তাঁর মতে, বন্ধন হল পৃথিবীর সাথে সংযুক্তি এবং মুক্তি হল জাগতিক বিষয়বাসনা ত্যাগ ও ঈশ্বরকে ভালোবাসা’’। তিনি আরো বলতেন, কামনামুক্ত হতে পারলে এই পৃথিবীই স্বর্গে পরিণত হয় এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ফলেই কেউসংসার চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে। ক্ষণস্থায়ী জগতের সাথে আমাদের বন্ধন হল একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং এই রোগের একমাত্র ওষুধ বিচ্ছেদ।

ত্রৈলঙ্গ স্বামী মানুষের ইন্দ্রিয়গুলিকেই তার শত্রু এবং নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়কে বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে জগতের সবথেকে পবিত্র তীর্থস্থান মানুষের শুদ্ধ হৃদয়। তিনি এও বলতেন, খাঁটি সাধু হলেন একমাত্র তিনি যিনি সকল মায়া, আসক্তি ও অহংকারকে জয় করেছেন। এমন একজন মানুষকেই ‘গুরু’ বলে মানা উচিত। তাঁর এই সমস্ত বাণী সংরক্ষিত আছে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর শিষ্য শ্রী উমাচরণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা স্বামীর জীবনীগ্রন্থে। এছাড়াও বিরুদুরজু রামরাজু তাঁর ছয় খণ্ডের ‘’অন্ধ্রযোগুলু’’ বা ‘’অন্ধ্রের যোগীরা’’ গ্রন্থের গোটা একটি খণ্ড জুড়ে লিখেছেন ত্রৈলঙ্গ স্বামীর জীবনী। তাঁর জীবনের কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি বাংলা চলচ্চিত্রও। ছবিটির নাম ‘’ত্রৈলঙ্গস্বামী’’। কাহিনী ও সংলাপ লিখেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রযোজনা করেছিলেন নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ হুই। নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন ভট্টাচার্য প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীবৃন্দ। পরিবেশনায় ‘ভবতারিণী পিকচারস’ ও পরিচালনা করেছিলেন চিত্রসারথী।

১৮৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় ত্রৈলঙ্গ স্বামীর মৃত্যু হয়। দশনামী সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী তাঁর দেহটি গঙ্গায় ‘সলিলসমাধি’ দেওয়া হয়েছিল।

তথ্যসূত্র


  1. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস ‘সেই সময়', প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ২৭৫, ২৭৬, ২৯৪, ২৯৫ 
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. http://akashgangabairagi.blogspot.com/
  4. https://eisamay.indiatimes.com/
  5. https://youtu.be/s9f4VdfqQvk

One comment

আপনার মতামত জানান