মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (Mahendranath Gupta) ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনী ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ রচনা করার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি মূলত ‘শ্রী ম’ নামেই পরিচিত ছিলেন৷
১৮৫৪ সালের ১৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর জন্ম হয়৷ তাঁর বাবার নাম মধুসূদন গুপ্ত এবং মায়ের নাম স্বর্ণময়ী দেবী৷ মহেন্দ্রনাথ খুব অল্প বয়সেই তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন এবং যৌথ পরিবারে তাঁর বড় হয়ে ওঠা৷ যৌথ পরিবারে মাতৃস্নেহের অভাব তিনি সর্বদাই অনুভব করতেন৷ পরিবারের নিত্যদিনের বিবাদ মহেন্দ্রনাথ দত্তের উপর প্রভাব ফেলেছিল৷ তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনই কঠিন সময়ে মহেন্দ্রনাথ দত্তের ভাগ্নে তাঁকে শান্ত করার জন্য দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে নিয়ে যায়৷ সেখানেই মহেন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে প্রথমবার রামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাত হয়৷ এই সাক্ষাতটি তাঁর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করেছিল।
তাঁর ছেলেবেলা সম্পর্কে নানা গল্প প্রচলিত আছে। যখন তাঁর পাঁচ বছর বয়স তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে মাহেশের রথ দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাঁদের নৌকোটি দক্ষিণেশ্বর ঘাটে এসে দাঁড়ায় । সবাই যখন মন্দিরে দেবদেবীর দর্শনে ব্যস্ত ছিল, তিনি কোনোভাবে হারিয়ে যান এবং ভবতারিনী মন্দিরের সামনে নাট মন্দিরে একা দাঁড়িয়ে তাঁর মাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে থাকেন। সেই মুহূর্তে কোন এক অপরিচিত তাঁকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মহেন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে এই ঘটনাটি তিনি আজীবন মনে রাখবেন। যিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন তিনি সম্ভবত ঠাকুর পরমহংসদেব ছিলেন।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় হেয়ার স্কুলে৷ তিনি বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিলেন৷ সর্বদা তিনি তাঁর ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতেন। মেধাবী ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি ছোটো থেকেই তাঁর মধ্যে ভক্তিভাব ছিল৷ বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় সেখানে ঠনঠনিয়ার মা শীতলা মন্দিরে (এই মন্দিরটি বর্তমানে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের সামনে দেখা যায়) প্রণাম না করে যেতেন না ।
মেধাবী ছাত্র হওয়ার দৌলতে তিনি বিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেতেন। এরপর বিদ্যালয় জীবন শেষ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সির প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন৷ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৭৪ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রী লাভ করেন৷ কলেজে প্রফেসর টনির প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি৷
মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর কর্মজীবন শুরু হয় সরকারি কাজ ও মার্চেন্ট অফিসে কাজের মধ্যে দিয়ে ৷ কিন্তু এসব কাজে তিনি শান্তি পেতেন না। তাই তিনি রিপন, সিটি ও মেট্রোপলিটন কলেজগুলিতে ইংরেজি, মনোবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি পড়ানো শুরু করেন। এরপরে ১৮৮২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উচ্চ বিদ্যালয় তথা মেট্রোপলিটন বিদ্যালয়ের শ্যামবাজারস্থ শাখায় তিনি হেডমাস্টারের পদে নিযুক্ত হন৷ তাঁকে সেখানে ‘ মাস্টার মহাশয় ‘ বলে সম্বোধন করা হত৷
মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের রামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷ তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের অন্যান্য শিষ্যের মতো কয়েক বছর ধরে ব্রাহ্মসমাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তেরো বছর বয়স থেকেই ব্যক্তিগত ডায়েরি লিখতেন। শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়ার পর তিনি প্রতিটি সাক্ষাতের কথোপকথন ডায়রিতে লিখে রাখতেন৷ পরবর্তীকালে যা ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ রূপে প্রকাশ পায়৷ প্রথমদিকে তিনি যখন ডায়রি লিখতে শুরু করেছিলেন তখন সেগুলি প্রকাশের তাঁর কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এই বইয়ের আয়তন ছিল বৃহৎ। বইয়ের প্রথম চার খণ্ড যথাক্রমে ১৯০২, ১৯০৪, ১৯০৮ এবং ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এরপর মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের স্বাস্থ্যের সমস্যার কারণে পঞ্চম খণ্ড বেশ কিছু সময় বাদে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। রামকৃষ্ণ কথামৃতকে ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে এবং রামকৃষ্ণদেবের ভক্তরা বইটিকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন ৷ কথামৃতের বিখ্যাত অনুবাদগুলির মধ্যে স্বামী নিখিলানন্দ এবং ধর্ম পাল গুপ্তের রচনাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে৷
এরপর মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত কলকাতার ৫০ আমহার্স্ট স্ট্রিটে চলে এসে ছোটদের উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে তোলেন৷ এই বিদ্যালয় ভবনটি ছিল পরমহংস যোগানন্দের যিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম দার্শনিক এবং যোগী হওয়ার পাশাপাশি মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ছাত্র ৷ যোগানন্দ তাঁর গুরু মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পর্কে আত্মজীবনীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে ভূষিত করেছেন৷ মহেন্দ্রনাথ শিক্ষা দানের মধ্যে দিয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন৷
১৯৩২ সালের ৪ জুন ঠনঠনিয়া কালী বাড়ির কাছে কথামৃত ভবনে মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর মৃত্যু হয়৷
তথ্যসূত্র
- https://www.kathamrita.org/
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://www.ramakrishnavivekananda.info/
- Ramakrishna as we saw him: by Swami Chetanananda,Publisher: Vedanta Society of St. Louis; 1 edition (23 June 2015): page- 288-289 (Digital version of the book https://archive.org/)
- https://belurmath.org/
তাঁর ভাগ্নী শ্রীম-কে প্রথম দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, এই মহান গবেষণালব্ধ তথ্যটি লেখক কোন সূত্র থেকে পেয়েছেন, তা জানাতে অনুরোধ করছি। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত যাঁরা মনোযোগ এবং গভীর অভিনিবেশ সহকারে তথা দীর্ঘকাল ধরে অধ্যয়ন করেন/করেছেন, তাঁদের কাছে এই আজগুবি তথ্যটি আপত্তিজনক–এবং এধরণের কথা শ্রীম বিষয়ে না প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়।
প্রসঙ্গতঃ, শ্রীম সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে, যেকোন সৎ ব্যাক্তিই কথামৃত’র সঙ্গে স্বামী নিত্যাত্মানন্দজী প্রণীত ষোলো খন্ড বিধৃত “শ্রীম দর্শন” না পড়ে এই ধরণের রচনায় হাত দেওয়া ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেয়। এবং এর দায়িত্ব সম্পাদকের ওপর বর্তায়।
‘ভাগ্নের’ পরিবর্তে ‘ভাগ্নী’ লেখা সংক্রান্ত অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারণে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে শ্রীম’র প্রথম পরিচয় সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা নিরূপণের জন্য আপনাকে আমাদের দেওয়া তথ্যসূত্রের ২ এবং ৪ নং সূত্রটি দেখার জন্য অনুরোধ জানাবো। আমরা আমাদের সমস্ত পাঠককূলকে অনুরোধ করব আমাদের সাইটে প্রাপ্ত কোন তথ্য সম্বন্ধে সন্দেহ থাকলে আগে আমাদের তথ্যসূত্রে দেওয়া লিংক বা গ্রন্থাবলী দেখবেন। আপনাকে আমাদের অনুরোধ আমাদের পরিবেশিত তথ্যে সত্যের অপলাপ থাকলে দয়া করে ভুল তথ্যটি উল্লেখ করে তার জায়গায় কি হবে সেটা সরাসরি বলবেন।