ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

“বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তি সাহিত্য জগতে বিদ্যাসাগরের স্থানকে আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মনে করা হয় বাংলার প্রথম সার্থক গদ্যকার। যদিও বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন তবুও বাংলা গদ্যকে ভারমুক্ত করে সর্বজনের কাছে সুবোধ্য করে তুলেছিলেন তিনি৷ শিশু বর্ণের সঙ্গে পরিচয় বিদ্যাসাগরের আঙুল ধরেই শিখে থাকে৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক গঠন ছিল কঠোর ও কোমলের সংমিশ্রণে তৈরী। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন প্রবল জেদী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট মাথা নত করার থেকে কাজ থেকে অবসর নেওয়া তিনি শ্রেয় মনে করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। কেবল তাই নয় নানা গল্পে তাঁর মাতৃভক্তির পরিচয়ও আমরা পাই৷

বিদ্যাসাগরের জীবনী শুনুন এখানে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর সন্তান ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত, বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা পুরুষ, তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন।

চার বছর নয় মাস বয়সে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে গুরুমশাই সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তিদানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে সেখান থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করলে, আট বছর বয়সে এই পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর চোখে কালীকান্ত ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। এমন গল্প শোনা যায় যে পায়ে হেঁটে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প চেষ্টাতেই আয়ত্ত করেছিলেন। ১৮২৯ সালের ১ জুন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ( যা বর্তমানে  সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরনের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি তখন তাঁর বয়স নয় বছর। ব্যাকরণ পড়তে পড়তেই ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণীতেও তিনি ভর্তি হন । ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি পেয়েছিলেন। অলংকার শাস্ত্র এর মত একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়ে তিনি মাত্র বারো বছর বয়েসে পারদর্শিতা অর্জন করেন৷ ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল’ কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৬ মে ল’ কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি তিনি পান সেখানেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

বিদ্যাসাগরের সংসারজীবন কেমন ছিল

বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাগ্রহণ শেষ করার পরই সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। সেখানে বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। ১৮৪৬ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল একই বেতন হারে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। ১৮৪৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় হিন্দি বেতাল পচ্চিসী অবলম্বনে রচিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ “বেতাল পঞ্চবিংশতি”। বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার এই গ্রন্থে দেখা যায়৷ ১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের রচিত “হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল” অবলম্বনে রচনা করেন “বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ” গ্রন্থখানি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। এই বছরেই ব্যাকরণ কৌমুদী তৃতীয় ভাগ ও কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্  অবলম্বনে তাঁর রচিত “শকুন্তলা “প্রকাশিত হয়। এছাড়া তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়।

রসিক বিদ্যাসাগরের কাহিনী শুনুন এখানে

১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব ” নামক প্রথম পুস্তক তিনি প্রকাশ করেন। এই বছরের এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষের দিন যুগান্তকারী বাংলা শিশুপাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ “বর্ণপরিচয়” প্রকাশিত হয়। সেই বছরই অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহ “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব ” নামক দ্বিতীয় পুস্তকপ্রকাশ করেন। কেবল তাই নয় বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সংবলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান এবং ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য। এই বছরই ১ মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে থাকাকালীন মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে তিনি নিযুক্ত হন। ১৭ জুলাই বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন তাঁর বন্ধু এবং বিশিষ্ট বাঙালি যুক্তিবাদী ও গ্রন্থকার অক্ষয়কুমার দত্তকে। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন তিনি যথাক্রমে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কখনও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিধা করেননি, নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন তিনি। হিন্দু বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাঁদের প্রতি পরিবারবর্গের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার গভীরভাবে তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। তাই এই বিধবাদের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সর্বস্ব পণ করে সংগ্রাম করেছেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে সঠিক নিদর্শন তুলে ধরেছেন সকলের সামনে। শেষপর্যন্ত ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে শুধু আইন প্রণয়নেই ক্ষান্ত থাকেননি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তাঁর উদ্যোগে একাধিক বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় এবং তাঁর পুত্রও এক ভাগ্যহীনা বিধবাকে বিবাহ করেন।

১৮৫৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত “কথামালা “প্রকাশিত হয়।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়।উল্লেখযোগ্য যে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৮৬৯ সালে এপ্রিল মাসে তাঁর সম্পাদনায় কালিদাসের “মেঘদূতম্ “প্রকাশিত হয় এবং ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত ”কমেডি অফ এররস্ “অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ ”ভ্রান্তিবিলাস”। শোনা যায় মাত্র পনেরো দিনে তিনি “কমেডি অফ এররস্” অনুবাদ করেছিলেন৷

বিদ্যাসাগর ও তাঁর পুত্রের সম্পর্ক নিয়ে তথ্যচিত্র

এই মানুষটিই ব্যক্তিগত জীবনে অনেক আঘাত পেয়েছেন (বিদ্যাসাগর ও তাঁর পুত্রের সম্পর্ক এখানে ক্লিক করে দেখুন ) ও শেষ জীবনে সভ্যসমাজ ছেড়ে বিহারের কার্মাটাঁড়ে আদিবাসীদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন।

১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৪ দিন। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তাঁরই নামে উৎসর্গিত।

সাহিত্য জগতে এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর অবদান বাঙালির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে যতদিন এ পৃথিবীতে মানব সভ্যতা বেঁচে থাকবে।

13 comments

আপনার মতামত জানান