ভারতবর্ষে যুগে যুগে এমন একেকজন সমাজসংস্কারকের আগমন ঘটেছে যাঁদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। তেলেগু ভাষী কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম (Kandukuri Veeresalingam) তেমনই একজন মহান ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসে তিনি তেলেগু নবজাগরণের জনক হিসেবে বিখ্যাত। উনিশ শতকের দক্ষিণ ভারতে নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি যেমন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন, তেমনি পণ প্রথা, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন বীরসালিঙ্গম। বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য সংঘ গঠন করে গ্রাম থেকে গ্রামে বিধবা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী পুরুষের খোঁজে ঘুরেছেন। সমাজ সংস্কারে ও নারী শিক্ষায় তাঁর লক্ষ্যের সাথে বিদ্যাসাগরের সাদৃশ্য থাকার কারণে তিনি দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর নামেও পরিচিত। অনেকে আবার তাঁর সঙ্গে রাজা রামমোহনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে তাঁকে দক্ষিণ ভারতের রামমোহন নামেও আখ্যায়িত করে থাকেন। তাঁর লেখা ‘রাজশেখর চরিত্রমু’ গ্রন্থটিকে তেলেগু ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৮৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশ) অন্তর্ভুক্ত রাজমুন্দ্রিতে এক তেলেগু ভাষী পরিবারে কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গমের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম সুব্বারায়ুডু এবং মায়ের নাম পূর্ণামা। বীরসালিঙ্গমের যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। এরপর কাকা ভেঙ্কটরত্নম তাঁকে মানুষ করেছিলেন। তৎকালীন সমাজের প্রথা অনুযায়ী বীরসালিঙ্গমের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের সময় তাঁর স্ত্রী বাপাম্মা রাজ্যলক্ষ্মীর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর এবং বীরসালিঙ্গমের নিজের বয়স ছিল চোদ্দ বছর।
প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যেও বীরসালিঙ্গমের মা তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি করেন। প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে এরপর বীরসালিঙ্গম একটি ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি হন। বীরসালিঙ্গমের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ও ভদ্র আচরণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এমনকি তিনি বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রের খেতাবও পেয়েছিলেন। ১৮৬৯ সালে বীরসালিঙ্গম ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং কোরাঙ্গী গ্রামে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান। তিনি সেখানে দুই বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে রাজামুন্দ্রির কাছে ধভালেশ্বরমে চলে যান কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম ।
সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে চাকরি ছাড়ার পর ১৮৭৬ সালে, তিনি ‘বিবেকা বর্ধিনী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা শুরু করেন এবং সেই যুগের মহিলাদের সমস্যা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি প্রাথমিকভাবে চেন্নাইতে (তৎকালীন মাদ্রাজ ) ছাপা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর লেখার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে তিনি রাজমুন্দ্রিতে তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ ছাড়াও তিনি নির্ভয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতির কথাও তুলে ধরতেন সেই পত্রিকায়।
কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম কেশবচন্দ্র সেনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এর ধারণা ও কর্মকাণ্ডের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ১৮৮৭ সালে রাজমুন্দ্রিতে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রথম ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করেন তিনি। নারী শিক্ষার প্রগতির উদ্দেশ্যে বীরসলিঙ্গম ধভালেশ্বরমে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
১৮৭৮ সালে বীরসালিঙ্গম ‘রাজামুন্দ্রি সমাজ সংস্কার সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন বিধবা বিবাহের প্রচলনের উদ্দেশ্যে। বিধবা বিবাহের বিপক্ষে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বীরসালিঙ্গমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাঁকে শারীরিক আক্রমণও করে। তা সত্ত্বেও বীরসালিঙ্গম তাঁর লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তিনি তাঁর সমিতির সদস্যদের অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিধবাবিবাহ করতে ইচ্ছুক এমন পুরুষদের খুঁজে বের করার ভার দেন। অবশেষে বীরসালিঙ্গম ১৮৮১ সালে প্রথমবার বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করতে সফল হন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি চল্লিশজন বিধবাকে পুনরায় বিয়ে দিয়েছিলেন।
বীরসালিঙ্গম বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের শ্লোক ব্যবহার করে মানুষকে বোঝাতেন যে হিন্দু ধর্মে বিধবা বিবাহ কোন নিষিদ্ধ প্রথা নয়। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে তিনি রাজা ভোজ এবং শ্রীকৃষ্ণদেব রায়ের উদাহরণ উদ্ধৃত করে ঐ রাজাদের দরবারে সভাসদ হিসেবে বিশিষ্ট মহিলা কবি ও পণ্ডিতদের উল্লেখ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতে নারী শিক্ষার গুরুত্বের কথা বোঝাতেন তিনি।
সামাজিক সংস্কারক হিসেবে তাঁর পরিচয়ের বাইরে লেখক হিসেবেও তাঁর অবদান অসীম। তিনি তেলেগু, সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষাতে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। সাহিত্যকে সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন নাটক ও উপন্যাসে সামাজিক সমস্যারই প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত নাটক হল, ‘প্রহ্লাদ’ (১৮৮৬), ‘সত্য হরিশ্চন্দ্র’ (১৮৮৬) প্রভৃতি। ১৮৭৮ সাল থেকে বিবেক চন্দ্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে বেরোয় তাঁর উপন্যাস ‘রাজশেখর চরিত্রমু’। এটি আইরিশ লেখক অলিভার গোল্ডস্মিথ রচিত উপন্যাস ‘দ্য ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ এর থেকে থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর এই উপন্যাসকেই তেলেগু ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হল – গোপাল সাতকামু, মার্কন্ডেয় সাতকামু, শুদ্ধন্ধ্র নিরোষ্ট্য নির্বাচনানিষধামু, রসিকজন রঞ্জনামু, শুদ্ধন্দ্রোত্তর রামায়ণমু, শুদ্ধান্ধ্র ভারত সংগ্রহমু ইত্যাদি।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সমাজে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গমকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯১৯ সালের ২৭ মে কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গমের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি বিশাখাপত্তনমের বিচ রোডে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। তাঁর স্মরণে, ভারতীয় ডাক পরিষেবা ১৯৭৪ সালে একটি ২৫ পয়সার ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
One comment