১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যু হয়েছিল এক পন্ডিতের, এক সমাজ সংস্কারকের, নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার এক অগ্রদূতের। আর তার প্রায় ষোল বছর আগেই ১৮৭৫ সালের ৩১ মে (১২৮২ বঙ্গাব্দ) সেই ব্যতিক্রমী পন্ডিত তৈরি করে ফেলেছিলেন নিজের উইল। সে উইলে ছিল ২৫টি ধারা। উইলের সর্বশেষ ধারায় তিনি লিখেছিলেন, “আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এ জন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তি নির্ব্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে…।” এই উইল যে তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্ত নয় তা বোঝা যায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ পরবর্তী ষোল বছরে উইলের একটি শব্দও পরিবর্তন না করায়। অথচ, বিদ্যাসাগর ও তাঁর পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক চিরকাল এরকম ছিল না।
বিদ্যাসাগরের একমাত্র পুত্রসন্তান শ্রী নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি ‘নারায়ণ বিদ্যারত্ন’ বলেও পরিচিত। তাঁর বংশের তথাকথিত ‘প্রদীপ’। তাঁর সম্পর্কে একসময় কতই না গর্বিত ছিলেন বিদ্যাসাগর। কেননা বিধবা বিবাহ প্রচলন নিয়ে যখন ঝড় উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে – পরের ঘরের ছেলেকে বিধবাদের সঙ্গে বিয়ে দিতে তিনি নাকি সিদ্ধহস্ত। কই বিদ্যাসাগরের পরমাত্মীয় কেউ তো এ পথে পা মাড়াল না। সেই দুঃসময়েই বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিল ‘কুপথগামী’ ছেলে। তবে নিন্দুকরা বলেন ‘বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য’ নয়, হুগলির খানাকুল কৃষ্ণনগরের শ্রী শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ১৪ বছর বয়সী বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন নারায়ণ।
বিদ্যাসাগর গোটা নারীসমাজকে পথ দেখিয়ে নিজেও কিন্তু পিছিয়ে থাকেননি। নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণ চন্দ্রর বিয়ে দিয়েছিলেন ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে। গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা বিয়েতে না এলেও বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম সফল ও সার্থক হয়েছিল। ভবসুন্দরীকে বিয়ে করে বিদ্যাসাগরকে স্বস্তি দিয়েছিলেন নারায়ণ। সেকথা বিদ্যাসাগর নিজেই চিঠিতে লিখেছিলেন ভাই শম্ভুচন্দ্রকে। “ইতিপূর্ব্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবাবিবাহ করিলে আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার-ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য এই যে, নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়াছে; আমার ইচ্ছা বা অনুরোধে করে নাই। যখন শুনিলাম, সে বিধবাবিবাহ করা স্থির করিয়াছে, তখন সে বিষয়ে সম্মতি না দিয়া প্রতিবন্ধকতাচারণ করা আমার পক্ষে কোনও মতেই উচিত কর্ম্ম হইত না। আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্ত্তক; আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি। এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী-বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। …নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে।”
উইল তৈরি করার মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৮৭০ সালে এই চিঠি লিখছেন বিদ্যাসাগর। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, এই পাঁচ বছরে কী এমন হল যে পিতাকে গর্বিত করা পুত্র একেবারে খলনায়কে রূপান্তরিত হলেন। বিদ্যাসাগরের উইলটিকে পড়লে দেখা যায় এমন কেউ প্রায় নেই যিনি তাঁর জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথচ কোনও মাসহারা বা এককালীন অনুদান পাননি। তাহলে কী এমন হল যে জীবনের ঝরাপথে সর্বস্ব বিলানো করুণাসাগর নিজে বঞ্চিত করছেন তাঁর একমাত্র কুলপ্রদীপকে সম্পত্তির ভাগ থেকে?
এই ‘কুপথগামী’ নারায়ণ বিদ্যারত্নই কিন্তু বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর পরই ১৮৯১ সালে বাবার অপ্রকাশিত জীবনচরিত প্রকাশ করছেন। ১৮৯২-এ প্রকাশ করছেন ‘ভূগোলখগোলবর্ণনম্’। আর পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী প্রকাশ (১৩০২ বঙ্গাব্দ) করতে গিয়ে সম্পাদকের ভূমিকা হিসেবে লিখছেন, “পূজ্যপাদ পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মানবলীলা সম্বরণের পর অনেকেই বলেছিলেন যে, যাঁহার অমৃতময়ী লেখনীর প্রসাদে বঙ্গভাষা পুনর্জীবন লাভ করিয়াছে, সেই মহাত্মার পুস্তকগুলি গ্রন্থাবলীরূপে প্রকাশিত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থাবলী মহামূল্য সামগ্রীর মধ্যে পরিগণিত হইয়া সর্ব্বত্র সাদরে পরিগৃহীত হইবেক।”
তাহলে ঠিক কী হয়েছিল পিতা-পুত্রের ভিতর যে বিদ্যাসাগরের কাছে নারায়ণ চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন? এই প্রসঙ্গে একটি চিঠি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারিখ বিহীন এই চিঠিটি পুত্রবধূ ভবসুন্দরীকে লেখা। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “আমি তোমাদের নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইলাম। তোমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত, আপাততঃ মাসিক একশত পঞ্চাশ টাকা নির্দ্ধারিত করিয়া দিলাম।”
১৮৭৫ সালে শশীভূষণ সিংহকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে জনৈক মধুসূদন ভট্টাচার্য্যের স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে সমাজের কিছু মাতব্বর উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণ। অন্যদিকে সহায়-সম্বলহীন বিন্ধ্যবাসিনীকে মাসহারা দেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং। তিনি চান নিজের অধিকার বলেই ওই বিধবা স্বামীর সম্পত্তি পাক। বিদ্যাসাগর নিজের ছেলে সম্পর্কে এই চিঠিতে লিখেছিলেন, “নারায়ণবাবুও এক্ষণে একজন প্রধান লোক হইয়াছেন। তিনি যে যারপরনাই পিতৃদ্বেষী তাহারই পরিচয় দিতেছেন। নতুবা আমি এবং আমার পিতৃদেব যাহা করিয়াছি তিনি তাহার অন্যথা করিতে উদ্যত হইতেন না।”
১৮৭৪ সালে অর্থাৎ উইল লেখার এক বছর আগেই বিদ্যাসাগর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে নারায়ণ যেন তাঁর ঘরে প্রবেশ না করেন। তারও দু বছর আগে পুত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হল বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যা কিনা বিদ্যাসাগরের জীবনের পুত্রের দিক থেকে পাওয়া অন্যতম গর্বের ঘটনার মাত্র দু বছর পরেই।
তবে পুত্রের কর্তব্যহীনতার কারণে গড়ে ওঠা এই বিচ্ছেদ স্থায়ী হয়নি। স্থায়ী হয়নি নারায়ণের উদ্যোগেই। তিনি বিদ্যাসাগরের থেকে প্রথমে দূরে সরে গেলেও বিদ্যাসাগর তাঁকে ফিরিয়ে নেন। আর তার নেপথ্যে আছে ১৮৮৯ সালে বাবাকে লেখা নারায়ণের এক মর্মান্তিক চিঠি। সেই চিঠি বাবা-ছেলের বেদনাদায়ক সম্পর্কের অশ্রু দলিল। সেখানে নারায়ণ ফিরতে চাইছেন বাবার কাছে, ক্ষমা ভিক্ষা করছেন, অনুতাপ করছেন, অক্ষরে অক্ষরে কাঁদছেন। “যখন আপনি এ অধমের মুখের দিকে তাকাইতেও অনিচ্ছুক, তখন আমি কোন সাহসে আপনার নিকটে বা সম্মুখে দাঁড়াইতে যাইব। …চাকরের মত থাকিব, ক্রমে অনুগ্রহ হয়, অনুমতি হয়, নিকটে যাইব। নচেৎ একধারে কুকুরের মত থাকিব। আমি যেমনই হই আপনার পুত্র। …যদি আপনার চরণ সেবা করিতে না পাইলাম, তবে কিসে পরকালে উদ্ধার পাইব?”
এই দীর্ঘ চিঠিতে নারায়ণচন্দ্র নিজের বিধবাবিবাহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, “একবার তো আপনাকে গর্বিত করতে পেরেছি, সেই আমার সার্থকতা। জীর্ণ শরীর, ভগ্নচিত্ত, ক্লান্ত বাবার কাছে ফিরতে চেয়ে বলছেন, ‘দোষ যত গুরুতর হউক না কেন, ক্ষমার নিকট সকলই তুচ্ছ, তাতে আবার বাপ মায়ের কাছে। আমাকে চরণে আশ্রয় দিলে কেহ দোষ দিবে না, বরং মহাপুরুষেরই মহত্ত্বেরই পরিচয় দেওয়া হইবে। …আমার জন্য একবার শেষ পরীক্ষা করুন, সাহস করিয়া বলিতে পারি, একক্ষণের জন্য, কোন বিষয়ে অণুমাত্রও আপনার অসন্তোষের কাজ করিব না।”
এই চিঠি পেয়ে কোন বাবা আর সন্তানকে দূরে ফেলে রাখতে পারে! বিদ্যাসাগরও পারেননি। ফিরিয়ে নিয়েছিলেন নারায়ণচন্দ্রকে। তবে এই অনুভবী চিঠির সঙ্গে নেপথ্যে কাজ করেছিল তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রী দীনময়ী দেবীর কাতর প্রার্থনাও।
তথ্যসূত্র
- জীবন সন্ধানী বিদ্যাসাগর; রামরঞ্জন রায়, পৃ. ১৬৪।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙ্গালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, সুবর্ণ, ২০১৬।
- বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা, আনিসুজ্জামান, অন্যপ্রকাশ, ২০১৮।
- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত), ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬।
- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩শে জুন ২০১৯ সাল।
- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/vidyasagar-and-narayanchandra