উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের এক অন্যতম দীপ্তিমান নক্ষত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ (Kaliprasanna Singha)। বিশালাকায় মহাভারতের বঙ্গানুবাদ এবং বিদ্যোৎসাহিনী সভা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে আজও তিনি বাঙালি জনমানসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ যাকে বাংলা উপন্যাস রচনার প্রস্তুতি-রূপ বলা হয়। উনিশ শতকের কলকাতার বাবুদের লাম্পট্য, সংযাত্রা, গাজন গান এমনকি সুপ্রাচীন দুর্গাপূজার প্রকৃতি অসাধারণ নৈপুণ্যে বর্ণনা দিয়েছেন কালীপ্রসন্ন তাঁর এই বইতে। তার পাশাপাশি হুতোমী ভাষা বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র স্থান করে নিয়েছিল। মাত্র তিরিশ বছরের জীবনে সামাজিক ভণ্ডামি দূর করার জন্য তাঁর প্রয়াস সত্যই অনস্বীকার্য ছিল।
১৮৪০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জোড়াসাঁকো অঞ্চলের বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের বিখ্যাত প্রতিপত্তিশালী সিংহ পরিবারে কালীপ্রসন্ন সিংহের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত নন্দলাল সিংহ যিনি ‘সাতু সিংহ’ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল ত্রৈলোক্যমোহিনী দাসী। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন বিখ্যাত দেওয়ান শান্তিরাম সিংহ এবং তাঁর ঠাকুরদাদার নাম ছিল জয়কৃষ্ণ সিংহ। কালীপ্রসন্নের জন্মের ছয় বছরের মধ্যেই ১৮৪৬ সালে কলেরায় নন্দলালের মৃত্যু হয়। আদালতের নির্দেশানুযায়ী কালীপ্রসন্নের অভিভাবকত্ব ও তাঁর বিপুল সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্ব নেন পারিবারিক বন্ধু হরচন্দ্র ঘোষ যিনি নিম্ন আদালতের একজন সম্মানীয় বিচারক ছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের তখন মাত্র ছয় বছর বয়স। ছোটবেলায় অত্যন্ত ডাকাবুকো স্বভাবের ছিলেন কালীপ্রসন্ন। একইসঙ্গে তাঁর অদ্ভুত এক স্মৃতিশক্তি ছিল, যা একবার শুনতেন তা হুবহু বহুদিন মনে রাখতে পারতেন তিনি। ঐ ১৪ বছর বয়সেই বেণীমাধব বসুর কন্যা ভুবনমোহিনী দাসীকে বিবাহ করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভুবনমোহিনী দাসীর মৃত্যু হয়। পরে রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেবের নাতনি শরৎকুমার দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
তাঁর বাবা নন্দলাল সিংহ হিন্দু কলেজের একজন অন্যতম পরিচালক হওয়ার সুবাদে হিন্দু কলেজেই জীবনের প্রাথমিক পাঠ নেওয়া শুরু করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। পরে ১৮৫৭ সালে হিন্দু কলেজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেন তিনি। বাড়িতেই উইলিয়াম কার্কপ্যাট্রিক নামে এক সাহেবের কাছ থেকে তিনি বাল্যকালে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা সমাপ্ত করেন। সেই সঙ্গে টোলে পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃতও শিখেছেন তিনি। বাড়িতে মা-ঠাকুরমার মুখে মুখে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত শুনে শুনে পয়ার ছন্দ শিখে নিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং জাস্টিস অফ পীস পদে আসীন হন কালীপ্রসন্ন সিংহ। আশ্চর্যজনকভাবে বিচারকের পদে বসে প্রথমে টেরিটি বাজার অপরিস্কার করার দায়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বর্ধমানের মহারাজ মহতাপ চাঁদকে ময়লা পরিস্কার না করা পর্যন্ত প্রতি দিন ৫০ টাকা করে জরিমানা জমা করার রায় দেন। পরে কলকাতার বাজারে কম ওজনের বাটখারা দিয়ে জালিয়াতি করার অপরাধে আটজন দোকানদারকে ২৫ টাকা জরিমানা করেন তিনি। তাঁকে নিয়ে একটি কাল্পনিক কাহিনি প্রচলিত আছে যে তিনি নাকি ব্রাহ্মণদের টিকি কেটে তা নিজের আলমারিতে সযত্নে সাজিয়ে রাখতেন। যদিও এই কথা সর্বাংশে সত্য নয়। জমিদার হিসেবে তিনি কখনই অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। প্রজার অধিকারের সপক্ষে কথা বলেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, এমনকি প্রজার বাড়ি ধান লুট হলে তারও বিরোধিতা করেছেন তিনি। ১৪ বছর বয়সেই বাংলা ভাষা চর্চার জন্য বিতর্কসভার আদলে তিনি গড়ে তোলেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’। পরে এখান থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ পায় ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’। সবই তিনি নিজের অর্থে চালাতেন, এমনকি নিজের টাকা খরচ করে কালীপ্রসন্ন প্রকাশ করেছিলেন ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা’, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ ইত্যাদি বইও। জগন্মোহন তর্কালঙ্কার এবং মনমোহন গোস্বামীর ‘পরিদর্শক’ পত্রিকার সম্পাদনার ভারও নিয়েছিলেন তিনি। ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র পক্ষ থেকে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ যা সেকালের সমাজে মধুসূদনের প্রতিষ্ঠায় প্রভূত সাহায্য করেছিল। বিধবা বিবাহের লড়াইয়ে বিদ্যোৎসাহিনী সভাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল, কালীপ্রসন্ন নিজে ঘোষণা করেছিলেন যে বিধবা বিবাহ করলেই এক হাজার টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, কৌলিন্য প্রথা, বাল্য বিবাহ রদ করতেও বিদ্যাসাগরের পাশে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। সমাজের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনহিতকর কাজে তিনি এগিয়ে এসেছেন এবং উদার-হস্তে ও অকুণ্ঠচিত্তে দান-ধ্যান করেছেন। নিজের অর্থেই বিদ্যোৎসাহিনী পাঠশালা, কয়েকটি অবৈতনিক স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি করেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। কলকাতার পানীয় জলের অভাব মেটাতে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে প্রায় হাজার তিনেক টাকা খরচ করে ধারাযন্ত্র এনেছিলেন তিনি।
কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বাংলা সাহিত্যের একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি। এতে কলকাতার নব্য সমাজ এবং তার প্রায় সব ধরনের মানুষের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। অপরদিকে তিনি শুধু মহাভারতের বঙ্গানুবাদই করেই ক্ষান্ত থাকেননি, মহাভারতের বঙ্গানুবাদ খণ্ডে খণ্ডে জনতাকে বিলিয়েও দিয়েছেন তিনি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। মোট ৫১ হাজার কপি বিতরণ করা হয়েছিল এই মহাভারতের আর তাতে খরচ হয়েছিল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। তত্ত্ববোধিনী সভার মুদ্রণযন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছিল কালীপ্রসন্ন সিংহের এই মহাভারত। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় এই দুঃসাহসিক কাজের প্রশংসাও করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, এই মহাভারত বিতরণের জন্যেই ধীরে ধীরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। দেনার দায়ে ভিটে-মাটিও বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। কালীপ্রসন্নের অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে পড়ে ‘বাবু’, ‘মালতী মাধব নাটক’ অনুবাদ, ‘সাবিত্রী সত্যবান’ ইত্যাদি রচনা। এছাড়া কালিদাসের ‘বিক্রমোর্ব্বোশীয়’ নাটকও তিনি অনুবাদ করেছেন। মধুসূদনের অনেক আগেই এই নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের আভাস দিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। পরবর্তীকালে এই নাটক যখন অভিনীত হয় মঞ্চে, সেখানে পুরুরবার চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। অভিনয়ের প্রসঙ্গে বলতে হয়, কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজের বাড়িতেই একটি নাট্যশালা গড়ে তোলেন যার নাম দেন ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’। রামনারায়ণ তর্করত্নের অনুদিত ‘বেণীসংহার’ নাটকের মধ্য দিয়েই এই রঙ্গমঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। শুধু সাহিত্য নয়, এই অনন্য প্রতিভাধর কালীপ্রসন্ন সিংহ সঙ্গীতেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কালীপ্রসন্ন একটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন বলেও জানা যায়। তিনি ভালবাসতেন হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকে। সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। নিজের বাড়িতে ‘সঙ্গীতসমাজ’ নামে একটি সভারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। অজস্র গান লিখেছেন তিনি আর নিজে যে সব নাটক লিখতেন সে সব নাটকের গানে সুরও বসাতেন তিনি নিজেই।
নিজের খরচে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপার বন্দোবস্ত করেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। পরে এই নাটকটি প্রকাশের অপরাধে রেভারেন্ড জেমস লং অভিযুক্ত হলে তার জরিমানার টাকা মিটিয়েছিলেন স্বয়ং কালীপ্রসন্ন। শেষজীবনে তাঁরই বিরুদ্ধে রুজু হয়েছিল ২০টি মামলা এবং তা থেকে পালাতে বাধ্য হয়ে বরানগরের গঙ্গার ধারে ‘সারস্বতাশ্রম’ নামের একটি বাড়িতে অনেকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘সেই সময়’ উপন্যাসে একটা বড়ো অংশ জুড়ে তাঁর চরিত্রকেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, উপন্যাসে কালীপ্রসন্নের নাম হয়েছে নবীনকুমার।
১৮৭০ সালের ২৪ জুলাই বেলা ৩টে নাগাদ মাত্র ৩০ বছর বয়সে কালীপ্রসন্ন সিংহের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- শ্রী মন্মথনাথ ঘোষ, 'মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ, ১৩২২ বঙ্গাব্দ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১-৩০, ৭২-৮৮
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kaliprasanna_Singha
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.telegraphindia.com/
3 comments