১৮৪০ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব স্মৃতিধর কালীপ্রসন্ন হিন্দু কলেজে কিছু দিন পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে দিইয়েছিলেন। সংস্কৃত আর ইংরিজি শিখেছিলেন গৃহ শিক্ষকের কাছে। বাংলা ভাষায় কালীপ্রসন্নের অসামান্য দখলের পেছনে কারিগর মূলত দুইজন। মা ও ঠাকুমা। তাঁর অনন্য কীর্তির মধ্যে পড়ে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ও মহাভারতের বাংলা অনুবাদ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবদান বিচার করতে বসলে তা কেবল ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ও মহাভারতের বাংলা অনুবাদের নিরিখে করলে এই অসামান্য মানুষটির প্রতিভা ও তার কর্মকাণ্ডের প্রতি এক প্রকার অবিচার হবে ধরে নেওয়া যায় কারণ কেবল সাহিত্যিক হিসেবে নয়, কালীপ্রসন্নের মূল্যায়নের অভীক্ষাপত্রে তাঁর বাংলা ভাষার উন্নতিকল্পে কৃত বিপুল কর্মকাণ্ডের দিকটিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন একটি ‘ডিবেটিং ক্লাব’। পরে যার নাম হয় ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’। এই সভা থেকেই পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় কালীপ্রসন্ন সম্পাদিত ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা স্বরূপ এই সভা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করেছিল সেই সময়। কেবল প্রতিযোগিতার আসর বসিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের পুরস্কার মূল্য তিনশো টাকা ও রেখেছিলেন সেই সময়ে! ওরিয়েন্টাল সেমিনারির চার জন ছাত্রকে ভাল বাংলা লেখার জন্য মেডেল দেওয়া হয়েছিল। এই সমস্ত খরচের ব্যয়ভার কিন্তু একাই বহন করেছিলেন কালীপ্রসন্ন।
কেবল কি প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে বাংলার তরুণ সম্প্রদায়কে আরও বেশী করে বাংলা ভাষা প্রতি আগ্রহী করে তোলা, নিজের খরচে অন্যের লেখা প্রকাশেও উদ্যোগী হন কালীপ্রসন্ন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নূতন পুস্তক’, হরিমোহন গুপ্তের ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ ইত্যাদি। এ ছাড়া ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা’ প্রকাশ, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’, দৈনিক খবরের কাগজ ‘পরিদর্শক’ সম্পাদনা এবং নানা ভাষার পত্রপত্রিকা প্রকাশে আর্থিক সাহায্য… রয়েছে সে সবও।
বাংলা সাহিত্যে এবং ভাষায় মাইকেল মধুসূদনের অবদান এই কালীপ্রসন্নই সবার আগে বুঝেছিলেন। আর বুঝেই শুধু ক্ষান্ত থাকেননি একেবারে প্রকাশ্য সভা করে সেই প্রথম কোনও বাঙালি কবিকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। মাইকেলকে ওই সভায় প্রথম ‘মহাকবি’ আখ্যা তিনিই দিয়েছিলেন। মাইকেলের বিলেত যাত্রা ও তৎপরবর্তী তাঁর পুনরায় বাংলায় ফিরে আসা ও বাংলা সাহিত্যে মনোনিবেশ তৎকালীন গোঁড়া পণ্ডিতকূল ভালো চোখে নেয়নি। রামগতি ন্যায়রত্নের মতো পণ্ডিতও ‘সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’-এ মাইকেলকে চরম সমালোচিত করেন। সেই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কালীপ্রসন্ন। ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। সর্বত্র বলতে লাগলেন, ভবিষ্যতের বাংলা কবিতা এই ছন্দেই লেখা হবে। শুধু তাই নয়, ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’র সমালোচনায় তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখলেন,‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যে এইপ্রকার কাব্য উদিত হইবে বোধ হয় স্বয়ং সরস্বতীও জানিতেন না। হায়! এখনও অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয়কে চিনিতে পারেন নাই।’’ কালীপ্রসন্ন মাইকেলকে ইংরেজ মহাকবি জন মিলটনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন যা তৎকালীন বিদ্ব্জনেরা একেবারেই মেনে নিতে তো পারেননি উলটে কালীপ্রসন্নকে মাইকেলের ‘পেটোয়া চামচে’ বলতেও ছাড়েননি। কালীপ্রসন্ন অবশ্য নিরুত্তর থাকেননি। জবাবে লিখেছিলেন হিন্দু প্যাট্রিয়টে ,‘‘মাইকেল মধুসূদনের পক্ষ নিয়ে ঢাল তলোয়ার হাতে লড়াই করা আমাদের কাজ নয়। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁরা লিখেছেন গ্রীক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার সাহিত্য না পড়েই মাইকেলের কবিতার প্রশংসা করা হচ্ছে, হয় তাঁরা নিজেরাই সেইসব পড়েননি কিংবা ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে আমাদের দেশের অসামান্য সাহিত্যগুলি শোনেননি অথবা শুনলেও ভুলে গেছেন। তা না হলে বুঝতে পারতেন মাইকেল মধুসূদন দত্তর কাব্যপ্রতিভা কতখানি খাঁটি এবং দেশজ।” প্রকৃত জহুরী সত্যিই জহর চেনে।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ হল কালীপ্রসন্নের জীবনে ম্যাগনাম ওপাস। সাহিত্যে চলিত ভাষার যে চল প্রথম শুরু করেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইতে, সেই আলালী ভাষাকেই আরও কথ্য আরও সমকালীন করে তুললেন কালীপ্রসন্ন তাঁর এই বইয়ে। প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া মাত্রই তুমুল আলোড়ন পড়ে গেল মহানগরের বাবু সম্প্রদায়ের মধ্যে। নাম বদলে শহরের সমস্ত খ্যাতনামা বাবুদের আসল চরিত্র সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। এমনকি নিজেকেও বাদ রাখেননি তিনি। নকশার প্রথম ভূমিকায় হুতোম লিখলেন, ‘‘সত্য বটে অনেকে নকশাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন তা বলাই বাহুল্য, তবে কেবল এইমাত্র বলতে পারি যে আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমনকী স্বয়ংও নকশার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।’’
কালীপ্রসন্নের রোষানল থেকে বাদ যাননি সেই সময়ের ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরাও। শাণিত কলমে লিখলেন ‘’আজকাল ব্রাহ্মধর্মের মর্ম বোঝা ভার, বাড়িতে দুর্গোৎসবও হবে আবার ফি বুধবার সমাজে গিয়ে চক্ষু মুদ্রিত করে মড়াকান্না কাঁদতেও হবে।’’
দ্বিতীয় ভূমিকায় সগর্বে লিখেছিলেন, ‘‘তবে বলতে পারেন ক্যানই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তবর্ত্তী হলেন, কি দোষে বাগাম্বর বাবুরে প্যালানাথকে পদ্মলোচনকে মজলিসে আনা হলো, ক্যানই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহদুর ও বর্ধমানের হুজুর আলী আর পাঁচটা রাজা রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন?’’
লেখা পড়ে রে রে করে আক্রমণ করলেন শহরের বাবুরা। ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ বইয়ে কালীপ্রসন্নকে উদ্দেশ্য তীব্র আক্রমণ করলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ছেলে চুনীলাল মিত্রও অনেকদিন ধরে ক্ষেপে ছিলেন কালীপ্রসন্নর ওপর। এইবার সুযোগ পেয়ে তিনিও লিখলেন ‘কলিকাতার নুকোচুরি। সেখানে তিনি লিখলেন,‘‘হুতোম নিজে বজ্জাত হয়ে অন্যের খুঁত ধরছেন। হুতোম জীবনে যা করেছেন সবই খারাপ কাজ। ভালর মধ্যে শুধু ওই মহাভারত।’’
কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ পড়ে প্রচণ্ড রেগে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় নকশার বিরুদ্ধে তিনি লিখলেন, ‘‘লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্তসঞ্চালন। এই মহৎ উদ্দেশ্য হুতোমি ভাষায় কখনো সিদ্ধ হইতে পারে না। হুতোমি ভাষা দরিদ্র; ইহার তত শব্দধন নাই; ইহার তেমন বাঁধন নাই, হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতা শূন্য। হুতোমি ভাষায় কখনো গ্রন্থ প্রণীত হওয়া উচিত নহে।’’
বঙ্কিমচন্দ্রের এমন আক্রমণের বিরুদ্ধে হুতোম কোনও পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে বঙ্কিম নিজে বোধ হয় পরে সেই রাগ মনে পুষে রাখেননি।কালীপ্রসন্নের মৃত্যুতে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত’ বইয়ের বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন, ‘‘সর্ব্বাপেক্ষা আমার ঋণ মৃত মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের নিকট গুরুতর। যেখানে মহাভারত হইতে উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, আমি তাঁহার অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি।”
জীবনের প্রথম নাটকটি লিখেছিলেন মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে। নাটকের নাম ছিল ‘বাবু’। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল নাটকটি। প্রকাশের মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সব কপি শেষ হয়ে যায় বইটির। পরবর্তীকালে ‘মালতী মাধব নাটক’ অনুবাদ করেন। এছাড়াও ‘সাবিত্রী সত্যবান’ মৌলিক নাটকও রচনা করেছিলেন তিনি।মাত্র ষোলো বছর বয়সে নিজের বাড়িতে ‘বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার’ তৈরি করেছিলেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের অনুবাদ কৃত ‘বেণীসংহার’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল সেই থিয়েটারে এবং সেখানে নিজে অভিনয় করে বিপুল প্রশংসাও পেয়েছিলেন। এছাড়াও কালীদাসের ‘বিক্রমোর্ব্বোশী’ নাটক অনুবাদ করলেন।মাত্র সতেরো বছর বয়সে ‘বিক্রমোর্ব্বশী’তে তিনিই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধারণা দিয়েছিলেন! এই নাটকে রাজা পুরূরবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়া মাত্রই তুমুল জনপ্রিয় হল। জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে অনেকে বিশ্বাসই করেনি এই নাটক কোন কিশোরের লেখা।তাই বোধ হয় ইংলিশম্যান পত্রিকা মন্তব্য করেছিল, বিক্রমোর্ব্বোশীয় আসলে পণ্ডিত দীননাথ শর্মার অনুবাদ যা কালীপ্রসন্ন নিজের নামে চালাচ্ছেন। প্রতিবাদ জানিয়ে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ লিখেছিল,“পণ্ডিত মহাশয় স্বয়ং সম্মুখে উপস্থিত থাকিয়া এই মিথ্যা নির্দ্দেশ অস্বীকার করিতেছেন।” আরও লিখেছিল ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ কালীপ্রসন্নের অভিনয় প্রসঙ্গে, “হিজ মিন ওয়াজ রাইট রয়্যাল, অ্যান্ড হিজ ভয়েস ট্রুলি ইম্পিরিয়াল।”
সম্পাদক হিসেবেও কিন্তু তিনি একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন।তাই তো ‘পরিদর্শক’- পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথেই কালীপ্রসন্ন তিনটি অনন্য প্রতিজ্ঞা বাঙালি পাঠকের কাছে করেছিলেন যা সম্পাদনা এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। এক, ‘সত্যপথ হইতে বিচলিত’ না হওয়া, দুই ‘কোন বিষয়ের অতি বর্ণনা না’ দেওয়া এবং তিন ‘পক্ষপাতদোষে’র ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা।
অনেকেই জানে না এক বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কর্তাও ছিলেন এই কালীপ্রসন্ন। হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি ছিল অসীম টান। আর তাছাড়া সংগীত সম্পর্কে জ্ঞানও ছিল প্রগাঢ়। প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকেই জানা যায়, কালীপ্রসন্ন কাগজ দিয়ে এক ধরনের কলাবতী বীণাও তৈরি করেছিলেন।বাংলায় সঙ্গীতচর্চ্চার জন্য নিজের বাড়িতে সঙ্গীতসমাজ নামে একটি সভারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। এছাড়া লিখেছিলেন অজস্র গান। নিজের লেখা সব নাটকের গানে সুরও বসাতেন নিজেই।
এবার আসা যাক মহাভারত প্রসঙ্গে। কালীপ্রসন্ন যখন সংস্কৃত মহাভারতকে বাংলায় অনুবাদ করবেন ঠিক করলেন তখন তাঁর বয়স সবে আঠেরো।অনুবাদ যে একার পক্ষে সম্ভব নয় তা অনুবাদ শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরে পণ্ডিত হরচন্দ্র ঘোষের পরামর্শ অনুযায়ী বিদ্যাসাগরের কাছে যান সমাধান খুঁজতে। বিদ্যাসাগরের পরামর্শে সাত জন পণ্ডিত সহ কালীপ্রসন্ন প্রায় আট বছর ধরে এই অনুবাদটি করেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এ অভিনন্দন জানালেন এই অসাধ্য সাধন করার জন্য। পাশাপাশি, ‘কৃষ্ণচরিত্র’র প্রথম ভাগের বিজ্ঞাপনে কালীপ্রসন্নের এই অনুবাদের প্রতি ‘গুরুতর’ ঋণ স্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু এই কাজেরও নিন্দে করতে কিছু লোক নেমে পড়লেন। খবর রটল কালীপ্রসন্ন নাকি টাকা দিয়ে পণ্ডিত কিনে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নিজেকে অমর করার প্রয়াস করেছেন। উত্তরে কালীপ্রসন্ন লিখেছিলেন, ‘‘আমি যে দুঃসাধ্য ও চিরজীবনসেব্য কঠিন ব্রতে কৃত সঙ্কল্প হইয়াছি, তাহা যে নির্বিঘ্নে শেষ করিতে পারিব, আমার এ প্রকার ভরসা নাই। মহাভারত অনুবাদ করিয়া যে লোকের নিকট যশস্বী হইব, এমত প্রত্যাশা করিয়াও এ বিষয়ে হস্তার্পণ করি নাই। যদি জগদীশ্বর প্রসাদে পৃথিবী মধ্যে কুত্রাপি বাঙ্গালা ভাষা প্রচলিত থাকে, আর কোন কালে এই অনুবাদিত পুস্তক কোন ব্যক্তির হস্তে পতিত হওয়ায় সে ইহার মর্ম্মানুধাবন করত হিন্দুকুলের কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ ভারতের মহিমা অবগত হইতে সক্ষম হয়, তাহা হইলেই আমার সমস্ত পরিশ্রম সফল হইবে।”
বোধকরি এই আদর্শ বুকে নিয়ে লিখতে নেমেছিলেন বলেই ঠিক করলেন বই পাঠকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন একেবারে বিনামূল্যে।
বইয়ের এক আশ্চর্য বিজ্ঞাপন প্রকাশের ইতিহাস পাওয়া যায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়।—
‘‘শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় কর্ত্তৃক গদ্যে অনুবাদিত বাঙ্গালা মহাভারত
মহাভারতের আদীপর্ব্ব তত্ত্ববোধিনী সভার যন্ত্রে মুদ্রিত হইতেছে। অতি ত্বরায় মুদ্রিত হইয়া সাধারনে বিনামূল্যে বিতরিত হইবে। পুস্তক প্রস্তুত হইলেই পত্রলেখক মহাশয়েরদিগের নিকট প্রেরিত হইবে।
ভিন্ন প্রদেশীয় মহাত্মারা পুস্তক প্রেরণ জন্য ডাক স্ট্যাম্প প্রেরণ করিবেন না।
কারণ, প্রতিজ্ঞানুসারে ভিন্ন প্রদেশে পুস্তক প্রেরণের মাসুল গ্রহণ করা যাইবে না। প্রত্যেক জেলায় পুস্তক বন্টন জন্য এক এক জন এজেন্ট নিযুক্ত করা যাইবে, তাহা হইলে সর্ব্বপ্রদেশীয় মহাত্মারা বিনাব্যয়ে আনুপূর্ব্বিক সমুদায় খণ্ড সংগ্রহকরণে সক্ষম হইবেন।
—শ্রীরাধানাথ বিদ্যারত্ন, বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক ’’
পুরো আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই মহাভারত বিতরণে কালীপ্রসন্নের।
শেষ জীবনে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার। ‘বঙ্গেশ বিজয়’ নামের সেই উপন্যাসের দুই ফর্মা জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ছাপাখানায় ছাপাও হয়। তবে উপন্যাসটি অসমাপ্ত রয়ে যায় শেষ অবধি।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kaliprasanna_Singha
- বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ’: পরেশচন্দ্র দাস।
- ‘মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ’: মন্মথনাথ ঘোষ।
- ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’: সম্পাদনা— অরুণ নাগ।
- ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’: বিনয় ঘোষ।
- ‘দি ইন্ডিয়ান স্টেজ’ (দ্বিতীয় খণ্ড): হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে আগস্ট ২০১৬ সাল।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা আগস্ট ২০১৯ সাল।
2 comments