সববাংলায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankimchandra Chattopadhyay) একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক যিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্য সম্রাট হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন। কেবল অসামান্য এক লেখক নয় সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তিনি বিশেষভাবে খ্যাত। জীবিকা সূত্রে ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শনে’র প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই স্নাতকের একজন ছিলেন তিনি। তাঁর রচিত ‘বন্দে মাতরম’ ১৯৩৭ সালে ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

১৮৩৮ সালের ২৭ জুন  উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের কাছে কাঁঠালপাড়া গ্রামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম দুর্গাসুন্দরী দেবী। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর দুই দাদার নাম যথাক্রমে শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে। স্কুল শিক্ষা শেষে তিনি প্রথমে হুগলী মহসীন কলেজ এবং পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এখান থেকে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়া দুই ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি অন্যজন যদুনাথ বসু। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় এই ঘটনার কথা লিখেছিলেন। ১৮৬৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র আইনে ডিগ্রি অর্জন করেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের কর্মজীবন শুরু হয় ১৮৫৮ সালে যশোরে ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে। পরবর্তীকালে তিনি ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেট হিসেবে পদন্নোতি করেন এবং ১৮৯১ সালে এই পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৮৯১ সালে ‘রায় বাহাদুর’ এবং ১৮৯৪ সালে ‘কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ খেতাবে ভূষিত করে।

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক। তাঁর রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস। তিনি মোট ১৫টি উপন্যাস লিখেছিলেন যার মধ্যে একটি ইংরেজি ভাষায় রচিত। তাঁর রচনা ‘বঙ্কিমী শৈলী’ বা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে পরিচিত। ঈশ্বরগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সংবাদ প্রভাকর’- সংবাদপত্রে বঙ্কিমচন্দ্র নিয়মিত লিখতেন। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস Rajmohan’s Wife ইংরেজি ভাষায় লিখিত। কেবল ঔপন্যাসিক হিসেবে নয় ‘বঙ্গদর্শন’-এর মাসিক চাহিদা মেটানোর জন্য তাঁকে প্রাবন্ধিকের ভূমিকাতেও আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র সমকালীন লেখকদের মানসিক জড়তা থেকে বেরিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্য তাঁর হাত ধরে নতুন আলোর দিশা দেখেছিল।  বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান, সাহিত্য,সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস সমস্ত বিষয়েই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর লেখা প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লোকরহস্য,  বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর,  বিবিধ সামালোচনা, সাম্য, কৃষ্ণ চরিত্র ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় তুলনামূলক সমালোচনার প্রথম সাহিত্যিক প্রয়াস হিসেবে তাঁর ‘শকুন্তলা মিরান্দা দেসদিমোনা’ প্রবন্ধটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন:  আর্থার সি ক্লার্ক

বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘কমলাকান্তের দপ্তর ‘ গ্রন্থের সব রচনাই কৌতুকরসের আবরনে  সমসাময়িক দেশীয় রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম ও সাহিত্যের পর্যালোচনা।  ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ – এর অধিকাংশ রচনাই বঙ্কিমের মনন সমৃদ্ধ। দেশপ্রীতি,  মানবপ্রীতি,  রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি,  মানবদর্শন তাঁর এই রচনাগুলিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘লোকরহস্য’ ও ‘ কমলাকান্তের দপ্তর-এর গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে একেবারে নতুন। আবার তাঁর ‘বিবিধ প্রবন্ধের’ গদ্যরীতি সহজ, সাবলীল ও গতিময়।

ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ” বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন।” উপন্যাসের জগতে বঙ্কিমচন্দ্র যে দুটি ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছিলেন তার একটি হল ইতিহাস অপরটি সমকালীন সমাজ। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস রচনার প্রেক্ষাপট ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। তাঁর উপন্যাসে ধরা পড়ে বাঙালী জীবনের নিখুঁত চিত্র। তাঁর লেখা চোদ্দোটি উপন্যাসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় -ইতিহাস ও রোমান্স,  পারিবারিক ও সামাজিক,  তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক। তাঁর রচিত ‘রাজসিংহ’ একটি বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস।

১৮৬৫ সালে রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বাংলা উপন্যাস। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় এক নতুন যুগ প্রবর্তিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে উড়িষ্যা অধিকারকে কেন্দ্র করে মুঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে এই উপন্যাসটি রচিত। ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো ‘Ivanhoe ‘ বা ভূদেবের ‘অঙ্গুরী বিনিময়’ উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসের  কিছু মিল থাকলেও রসসৃষ্টি ও নির্মাণ কৌশল বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব।  ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে কপালকুণ্ডলার চরিত্র তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। আকৃতি ও প্রকৃতিতে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি যেন পাশ্চাত্য রোমান্সের বাংলা সংস্করণ।  এই উপন্যাসে তিনি শেক্সপীয়ার, বায়রণ,  মেকলে,  ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস ও লীটনের রচনা থেকে উদ্ধৃতি নিয়েছেন। কপালকুণ্ডলার চরিত্র চিত্রন ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের  মিরান্ডা চরিত্রকে মনে করিয়ে দেয়। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুকরণ নিজ প্রতিভায় ভাস্বর বরং সেক্ষেত্রে একে অনুসরণ বলা যেতে পারে ৷

মীরকাশিম ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় লিখিত উপন্যাস ‘ চন্দ্রশেখর’- এর মূল কাহিনী কাল্পনিক। প্রতাপ এবং শৈবলিনীর একে অপরের প্রতি আকর্ষণ এবং চন্দ্রশেখরের আদর্শ চরিত্র এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ রাজসিংহ ‘- উপন্যাসের কাহিনী ও প্রধান চরিত্রগুলি ঐতিহাসিক। ‘আনন্দমঠ’  ও ‘দেবীচৌধুরানী’ তাঁর রচিত তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস। ‘সীতারাম’  তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস।

আরও পড়ুন:  উৎপল দত্ত

বঙ্কিমচন্দ্রের  ‘রাধারাণী’ উপন্যাসটি শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রার পটভূমিতে লেখা। ১৮৭৫ সালে রথের মেলায় একটি মেয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও মেলার মধ্যে মেয়েটির অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলেন। এর ঠিক দুমাস পরেই উনি লেখেন ‘রাধারাণী’।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ দেশাত্মবোধের এক অসামান্য মহাকাব্য। এখানেই তিনি লিখেছিলেন – ‘বন্দে মাতরম’ গানটি।  ‘দেবীচৌধুরানী’ উপন্যাসটি পুরনো বাংলা সমাজ ও পরিবারের পটভূমিতে রচিত হলেও এর অন্তরালে ধর্মীয় তাত্ত্বিক অনুভূতির কথা লিখেছেন। পারিবারিক ও সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘বিষবৃক্ষ’,  ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও ‘রজনী’। বিষবৃক্ষ উপন্যাসে মূলত সেই সময়ের প্রধান সামাজিক সমস্যা বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহের কথা বলা হয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘রজনী’ ( ১৮৭৭) উপন্যাসটিতে লিটন রচিত ‘ The Last Days of Pompeii ‘ – উপন্যাসের ছায়া দেখা যায়। মূল উপন্যাসে  ফুলওয়ালী নিদিয়া চোখে ভালো দেখতে পায় না। নিদিয়া চরিত্রের আংশিক প্রভাবেই জন্মান্ধ রজনীকে তিনি এঁকেছেন বলে মনে করা হয়।  ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের মতে, “রজনী বাংলা ভাষায় প্রথম মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণমূলক উপন্যাস।” প্রমথনাথ বিশীর মতো সমালোচকরাও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যের সেরা ঔপন্যাসিক হিসাবে বিবেচনা করেন।  বিশ্বসাহিত্যে খুব কম লেখকই বঙ্কিমের মতো দর্শন ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতা অর্জন করেছেন।

ভারতীয় ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার অন্যতম স্রষ্টা। তাঁর এই জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেছিল বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিকে নিয়েই তিনি জাতীয়তার ধারণাটি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। বাঙালির ইতিহাস চেতনার অভাব নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল।  রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথমশিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইটির সমালোচনায় তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীন্‌লণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, স্টুয়ার্ট্ প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র।’’

আরও পড়ুন:  অমিতাভ ঘোষ

বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনদর্শনের মূল কথা হল মানব কল্যাণ ও মানবপ্রীতি। এই মানবপ্রীতির সঙ্গে সমাজপ্রীতির কোন বিরোধ নেই। তাঁর জীবনদর্শন কখনই নেতিবাচক ছিল না। তিনি সর্বদা ইতিবাচক জীবনদর্শনের কথা বলেছেন।  কেবল সাহিত্যিক হিসেবে নয়, প্রশাসক হিসেবেও বঙ্কিমচন্দ্রের গুরুত্ব খুব কম নয়। মুর্শিদাবাদে বেরা নামক এক স্থানীয় উৎসবে নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর থাকাকালীন আমন্ত্রিত হয়েও সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি এটা জানতে পেরে যে আমন্ত্রিতদের মধ্যে কেবল সাহেবরাই উৎসব মঞ্চে থাকার অধিকার পাবেন। পরে নবাব পরিবার থেকে এই বৈষম্যমূলক আচরণ প্রত্যাহার করে বঙ্কিমচন্দ্রকে পুনরায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রাচীন স্কুল, কাঁথি হাইস্কুল যে জমিতে গড়ে উঠেছে সেটি বঙ্কিমচন্দ্রেরই দানকৃত জমি।

১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – ড. দেবেশ কুমার আচার্য্য ( ৪০২ পৃঃ)
  2. https://www.anandabazar.com/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. https://www.anandabazar.com/

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন