অমিতাভ ঘোষ

অমিতাভ ঘোষ

একবিংশ শতাব্দীর ভারতে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে যে সকল বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিশ্বের দরবারে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে অমিতাভ ঘোষ (Amitava Ghosh) অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার। ইতিহাস ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি তাঁর রচনায় এক বলিষ্ঠতার ছাপ রেখেছেন। একাধারে সমালোচক, কথাসাহিত্যিক এবং ইতিহাসবেত্তা অমিতাভ ঘোষ আদ্যন্ত বাঙালি হয়েও ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিক কালের লেখকদের মধ্যে এক অনন্য নজির তৈরি করেছেন। আর. কে. নারায়ণ, মুলক্‌রাজ আনন্দ এমনকি বিতর্কিত কথাকার সলমন রুশদির উত্তরসূরি হিসেবেই অমিতাভ ঘোষের সাহিত্যচর্চা তাঁকে এনে দিয়েছে ৫৪তম জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের সম্মান।

১৯৫৬ সালের ১১ জুলাই কলকাতায় অমিতাভ ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর বাবা শৈলেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ ছিলেন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। চাকরি থেকে অবসরের পরে তাঁর বাবা ভারত সরকারের কূটনীতিবিদ হিসাবে কাজ করেন। সেই সুবাদে অমিতাভর ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, বার্মা, ইরান প্রভৃতি দেশে ভ্রমণ করে।

‘দুন স্কুল অফ বয়েজ’ থেকে অমিতাভর বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এই স্কুল থেকেই তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট স্টিফেন কলেজে ভর্তি হন। দুন স্কুলে সহপাঠী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এবং বিশিষ্ট লেখক বিক্রম শেঠকে। এই দুন স্কুলে পড়াকালীন বিক্রম শেঠের সম্পাদিত ‘দ্য দুন স্কুল উইকলি’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত গল্প-কবিতা লেখা শুরু করেন। পরে সুহৃদ রামচন্দ্র গুহের সহায়তায় উভয়ে মিলে ‘হিস্ট্রি টাইমস’ বলে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে ইতিহাসে স্নাতক হন অমিতাভ ঘোষ এবং এখান থেকেই ১৯৭৮ সালে সমাজবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৮২ সালে তিনি মাত্র ২২ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। অক্সফোর্ডের সেন্ট এডমুণ্ড হল থেকে সামাজিক নৃতত্ত্বে (Social Anthropology) ব্রিটিশ সামাজিক নৃতাত্ত্বিক পিটার লেনার্তের তত্ত্বাবধানে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দিল্লিতে কলেজে পড়াকালীন ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর সাংবাদিক হিসেবে অমিতাভ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘দ্য ন্যু ইয়র্কার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন। অমিতাভ ভারতসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৯৯ সালে নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুইন্স কলেজে অমিতাভ ঘোষ তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এছাড়াও তিনি কায়রোতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে, নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮২ সালে ভারতে ফিরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার শুরু করেন তিনি। ২০০৪ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের বহিরাগত অধ্যাপক ছিলেন তিনি। এই সময় থেকেই তিনি পূর্ণমাত্রায় সাহিত্যের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। ২০০৯ সালে অমিতাভ ঘোষ ‘রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার’-এবং ২০১৫ সালে ‘ফোর্ড ফাউন্ডেশন আর্ট অফ চেঞ্জ’-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

অমিতাভ ঘোষের লেখায় ইতিহাস, সমাজবিদ্যা ও নৃতত্ত্বের এক অসামান্য মিশেল রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে সেই দেশের লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজ নিয়ে তিনি প্রবন্ধ ও উপন্যাস লিখে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন ইংরেজি সাহিত্য জগতকে।

অমিতাভ ঘোষের সাহিত্য জীবন শুরু হয় ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সার্কেল অফ রিজন’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তিনি তখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। প্রথম উপন্যাসটিই পাঠকদের মননে জায়গা করে নেয়। ইতিহাসের ব্যাপ্তি আর বিস্তৃত ভূগোলের পরিসীমা নিয়ে এই উপন্যাসের চরিত্র আর ঘটনাক্রম আবর্তিত হয় ‘সত্ত্বঃ (যুক্তি)’, ‘রজঃ (উদ্দীপনা)’ আর ‘তমঃ (বিনাশ)’ এই তিনটি পর্বে। এরপর ১৯৮৮ সালে তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘শ্যাডো লাইনস’ প্রকাশ পায়। একটি শিশুর স্মৃতি ও তাঁর পারিপার্শ্বিক চরিত্রদের নিয়ে উপন্যাসটি রচিত। ১৯৯২ সালে প্রকাশ পায় অমিতাভ ঘোষের তৃতীয় উপন্যাস ‘ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড’ । এই উপন্যাসটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রায় চারশো ঐতিহাসিক দলিলের উল্লেখ রয়েছে এই উপন্যাসটিতে। গবেষণার কাজে দীর্ঘদিন মিশরে থাকাকালীন অমিতাভ ঘোষ এই উপন্যাসটি লেখেন। পাশ্চাত্যের পরাক্রমের ফলাফল হিসেবে আধুনিক সভ্যতার জন্ম এবং যুগের পরিবর্তনই এই উপন্যাসটির মূল বিষয়। ১৯৯৬ সালে ‘দ্য ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’ প্রকাশিত হয় যা আদপে একটি কল্পবিজ্ঞানকেন্দ্রিক রহস্য উপন্যাস। ২০০০ সালে অমিতাভ ঘোষের ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হল বার্মার (অধুনা মায়ানমার) কয়েকটি পরিবারের ছিন্নমূল হয়ে বার্মা থেকে ভারতে চলে আসা এবং তাঁদের কেন্দ্র করে দুই দেশের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের নৃশংস ফলাফলের কাহিনিও উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। সুন্দরবনের পটভূমিতে লেখা অমিতাভ ঘোষের একটি অনবদ্য উপন্যাস ‘দ্য হাংরি টাইড’ । এটি তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি সুন্দরবনের অসাধারণ রূপ ও লোককথার নানা আখ্যান ও মরিচ ঝাঁপি গণহত্যার প্রসঙ্গে অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

অমিতাভ ঘোষের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘আইবিস ট্রিলজি’। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারত ও চীনের মধ্যে চালানো আফিম বাণিজ্য এবং মরিশাস দ্বীপে কুলি-কামিনদের পাচার সেটিই এই ট্রিলজির বিষয়বস্তু। ‘আইবিস ট্রিলজি’র মধ্যে রয়েছে – ‘সী অফ পপিস’ (২০০৮), ‘রিভার অফ স্মোক’ (২০১১) এবং ‘ফ্লাড অফ ফায়ার’ (২০১৫)। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’ উপন্যাসের বিষয় আধুনিক বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন।

অমিতাভ ঘোষ শুধু সাহিত্যই রচনা করেননি। তিনি তাঁর নন ফিকশন অর্থাৎ প্রকৃত সাহিত্য নির্ভর প্রবন্ধের জন্যও সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর নন ফিকশন কিছু প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ড্যান্সিং ইন কম্বোডিয়া, অ্যাট লার্জ ইন বার্মা’ (১৯৯৮), ‘কাউন্টডাউন’ (১৯৯৯), ‘দ্য ইমাম অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান’ (২০০২), ‘ফান্ডামেন্টালিজম ইজিপ্শিয়ান কালচার’ ইত্যাদি। ১৯৯৮ সালে ভারত রাজস্হানের পোখরাণে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায় । এই ঘটনার কয়েক মাস পরে পাকিস্তানও পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যে দল পাকিস্তানের সীমানা ঘেঁষে সিয়াচেনে যায়, তার সঙ্গে গিয়েছিলেন অমিতাভও। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ‘কাউন্টডাউন’ প্রবন্ধটি লেখেন। তাঁর ‘ফান্ডামেন্টালিজম ইজিপ্‌শিয়ান কালচার’ প্রবন্ধটি মিশরে থাকাকালীন সেখানকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখা।

অমিতাভ ঘোষ তাঁর রচনার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি দুটি লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট আ্যওর্য়াড ও চারটি সাম্মানিক ডক্টরেট পেয়েছেন। ‘দ্যা শ্যাডো লাইনস’ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে। সেই বছরই ‘আনন্দ পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি। ‘দ্য ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’ উপন্যাসটির জন্য ‘আরথার সি ক্লার্ক’ পুরস্কার, ‘দ্য হাংরি টাইড’ উপন্যাসের জন্য ‘হাচ ক্রসওয়ার্ড বুক’ পুরস্কার ও২০০৭ সালে ভারত সরকার দ্বারা ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২০০৮ সালে ‘ম্যান বুকার পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁর লেখা ‘সী অফ পপিস’ উপন্যাসের জন্য তিনি ৫৪তম ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কার পান। এটি ভারতের সাহিত্য জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে প্রথম কোনো ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন। ঐ একই বছর ‘কমনওয়েলথ রাইটার পুরস্কারেও সম্মানিত হন তিনি।

বর্তমানে অমিতাভ ঘোষ নিউইয়র্কে তাঁর স্ত্রী ডেবোরা বেকার ও তাঁদের দুই সন্তানের সাথে থাকেন।

3 comments

  1. এখানে একটি তথ্য ভুল দেওয়া হয়েছে।কেবল হিন্দিতে সাহিত্য চর্চার জন্য জ্ঞানপীঠ সম্মান প্রদান করা হয়। এই পুরস্কার মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকরা পেয়েছিলেন।

    1. জ্ঞানপীঠ কেবল হিন্দি ভাষায় সাহিত্য চর্চার জন্য দেওয়া হয়না, ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্গত বাইশটি ভাষার যেকোন ভাষায় এবং ইংরেজিতে উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য রচনার জন্যই দেওয়া হয়ে থাকে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই বিষয়টি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমরা তথ্যটি সংশোধন করে নিয়েছি আমাদের সাইটে।

আপনার মতামত জানান