
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অন্যতম সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত বকখালি (Bakkhali)। বাঙালির ভ্রমণের তালিকায় থাকা চিরাচরিত দীঘা –পুরী–দার্জিলিংয়ের ছক ভেঙে অন্যরকমভাবে ছুটি কাটানোর ঠিকানা হতে পারে এই বকখালি। সমুদ্র সৈকতের ঝাউবন, লাল কাঁকড়ার দল আর অখণ্ড নির্জনতায় মোড়া বকখালির সৈকতে জ্যোৎস্নার সৌন্দর্যের কাছে অন্য যা কিছু পৃথিবীর সবই ম্লান মনে হয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার কাকদ্বীপ মহকুমার নামখানা সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকের নামখানা থানার অন্তগর্ত বকখালি দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের একটি সমুদ্র সৈকত। সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থিত এই সৈকতটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় তিনি বঙ্গোপসাগরে এই সৈকতটি আবিষ্কার করেন। তখন এই জায়গাটি কতগুলি মৎস্যজীবিদের গ্রাম ছিল মাত্র। তাঁর আবিষ্কারের সম্মানার্থে বর্তমানে একটি গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ‘ফ্রেজারগঞ্জ’। এমনকি গভর্নর ফ্রেজারের বাসস্থানটি বর্তমানে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে যা ফ্রেডরিক আইল্যাণ্ডে গেলে দেখতে পাওয়া যায়।
বকখালি একটি শান্ত সুন্দর সৈকত। বকখালিতে এলে সমুদ্রের এক শান্তরূপ উপভোগ করতে পারবেন। দীর্ঘ আট কিলোমিটার ব্যাপী পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকতে পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলো আর সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া মিলেমিশে এক অপার্থিব অনুভূতি সৃষ্টি করে। সৈকত লাগোয়া ঝাউবন আর একদিকে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী কিংবা রূপনারায়ণ নদীর মোহনা মিলে মিশে যেন এক অন্য রূপ দিয়েছে বকখালিকে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র হিসেবে সমুদ্র সৈকতে কাঁকড়ার স্বাভাবিক বাস এখানে লক্ষ্য করা যায়। দীঘা, মন্দারমণি বা তাজপুরের মতো জনসমাগম এখানে হয় না, বরাবরই ভিড় কম থাকে।

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে নামখানা লোকালে করে প্রথমে নামখানা স্টেশনে নেমে পড়তে হবে আর সেখান থেকেই টোটো বা অটো করে সোজা পৌঁছানো যাবে বকখালি। এটাই বকখালি যাওয়ার সবথেকে সহজতম উপায়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নামখানা স্টেশন থেকে জেটিঘাট পর্যন্ত এসে ভেসেলে করে নদী পার হয়ে বকখালি পৌঁছাতে হত। গাড়ি, বাস সমস্তই এই ভেসেলে করেই পাড় হত। বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হত এখানেই। কিন্তু পরে নামখানা থেকে বকখালি পর্যন্ত হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজ তৈরি হওয়ার কারণে খুব সহজে নামখানা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে চলে যাওয়া যায় বকখালি। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী শিয়ালদা-নামখানা কোভিড স্পেশাল ট্রেন তিনটি পৃথক সময়ে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ছাড়ে। প্রথমটি বেলা ১টা ২০তে, তারপর আবার রাত সাড়ে ৮টায় এবং সবশেষে রাত সাড়ে নটায় যেগুলি যথাক্রমে বিকেল ৪টে বেজে ২মিনিটে, রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে এবং রাত ১২টা ১৫ মিনিটে নামখানায় পৌছায়। তবে সাধারণ সময়ে শিয়ালদহ থেকে ভোর ৫টা ১০ মিনিটের নামখানা লোকাল ধরে মোটামুটিভাবে সকাল ৯টার মধ্যেই বকখালি পৌঁছানো যায়। এছাড়াও ধর্মতলা থেকে এসি বা নন-এসি বাসও আসে সোজা বকখালি পর্যন্ত। কেউ ইচ্ছে করলে নিজস্ব গাড়িতেও আসতে পারেন বকখালি। সেক্ষেত্রে কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার সড়কপথে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে জোকা, আমতলা পেরিয়ে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যাবে বকখালি।
বকখালিতে থাকার জন্য কম খরচ ও বেশি খরচের ছোটো-বড় অনেক রকম হোটেল রয়েছে। এখানে হোটেল ভাড়া ন্যূনতম পাঁচশো টাকা থেকে শুরু। এখানকার ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজ লজে ড্রাইভারের থাকার জন্য এবং গাড়ি রাখার জন্য সুবন্দোবস্ত থাকায়, নিজস্ব গাড়ি নিয়ে এলে এখানে থাকা সুবিধাজনক হবে। তবে এজন্য কলকাতার ডালহৌসিতে এই সংস্থার অফিস থেকে আগাম বুকিং করে নিতে হয়।
বকখালিতে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে প্রধানত এখানকার বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি আরো কিছু জায়গা রয়েছে।

সমুদ্র সৈকত : এখানকার সমুদ্র সৈকত আসলে একটি সক্রিয় বদ্বীপের অংশ। এখানে প্রকৃতির নিয়মে জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে পলি সঞ্চয় ও ক্ষয়ের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটে। তাই এই সৈকত ক্রমনির্মীয়মান। সমুদ্র সৈকতের পূর্ব দিকে রয়েছে প্রাকৃতিক ঝাউবন। সেখান থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে রূপনারায়ণ নদের মোহনা। বকখালির পশ্চিম দিকে জলের গভীরতা ও সমুদ্রের ঢাল তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় পর্যটকদের সংখ্যা কম। এই অঞ্চলে সমুদ্রের তরঙ্গের আঘাতে উপকূল বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই দিকের সমুদ্র সৈকত ‘লক্ষ্মীপুর সৈকত’ নামে পরিচিত। বকখালি সমুদ্র লাগোয়া অংশে চর পড়ে যাওয়ায় সমুদ্রের কাছে পৌঁছাতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়। চরের সামনে একটি পঞ্চাশ মিটার সরু খালের সৃষ্টি হয়েছে যেখানে জোয়ারের সময় জল পরিপূর্ণ থাকে আর ভাটার সময় তাতে নানা ধরনের মাছ ও কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায়। এখানে সমুদ্রের ঢেউ অপেক্ষাকৃত ছোট। তাই সমুদ্র স্নানের আনন্দ সেইভাবে উপভোগ করা যায় না।
কুমির প্রকল্প : সমুদ্র সৈকতের খুব কাছেই এই কুমির প্রকল্প দেখে আসা যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগের তরফ থেকে এখানে একটি কুমির প্রজনন প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে যা আসলে একটি উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা। এখানে প্রবেশের রাস্তা ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভেতর দিয়ে। বড় শিংওয়ালা হরিণ, বাঁদর, নানা প্রজাতির পাখি ও কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায় এখানে। কুমিরের পাশাপাশি এখানে হরিণেরও প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুমির প্রকল্পে ঢুকতেই বিশালাক্ষী মাতার মন্দির আছে একটি, রয়েছে বাচ্ছাদের জন্য একটি ছোট পার্ক। বর্তমানে কুমির প্রকল্পের কোনও প্রবেশ মুল্য নেই। এখানে কুমীরও নেই।

বনবিবির মন্দির : সমুদ্রতট থেকে কুড়ি মিনিট হেঁটে দেখে আসতে পারেন বনবিবির মন্দির। স্থানীয়দের মতে এই মন্দিরটি তিনশো বছরের পুরোনো। এখানকার স্হানীয় অধিবাসীরা অধিকাংশই মৎস্যজীবি। তারা সমুদ্রে যাওয়ার আগে বনবিবিকে পুজো দিয়ে যান। তাদের বিশ্বাস যে, দেবী সন্তুষ্ট থাকলে সব বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন তারা।
সবশেষে সাইটসিইং-এর কথায় আসা যাক। বকখালিতে সাইটসিইং-এর জায়গার অভাব নেই। কাছেপিঠেই দেখে আসা যায় নিকটবর্তী হেনরি দ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জের সৈকত এবং ফ্রেজারগঞ্জ ফিশিং হারবার। এই ফ্রেজারগঞ্জ সৈকতেই দেখতে পাওয়া যাবে স্যার অ্যাণ্ড্রু ফ্রেজারের ভগ্নপ্রায় বাড়িটি। হেনরি দ্বীপে একটি ওয়াচ টাওয়ার থেকে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাটির খুব সুন্দর একটি দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এর সঙ্গে নৌকা করে জম্মু দ্বীপটিও এক ঝলক দেখে নিতে পারেন। তবে মাথায় রাখতে হবে এই জম্মু দ্বীপে নামা যায় না। দ্বীপের চারপাশে ঘুরে নামতে হবে সেই ফ্রেজারগঞ্জ ফিশিং হারবারে।
বকখালি বা তৎসংলগ্ন জায়গাগুলি সারাবছরই ঘোরা যায়। তবে যে কোন সমুদ্র সৈকত শীতকালেই বেশি আরামদায়ক হয় ঘোরার জন্য। এই সময়ে পরিযায়ী পাখিদেরও দেখা পাওয়া যায় খুব সহজে। আর গরমে সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলে গেলে তেমন আরাম পাওয়া যায় না। ফলে বকখালিতে শীতকালেই যাওয়া শ্রেয়। তবে বর্ষাকালে এলে বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্র দেখার আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে যাবে।
মৎস্যবন্দর থাকায় এবং কাছেই ফ্রেজারগঞ্জ ফিশিং হারবারে সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া ধরা হয় বলে এখানকার হোটেলে মাছের বিভিন্ন উপাদেয় পদ তো খেতেই হবে। কাঁকড়া, পমফ্রেট, চিংড়ি ছাড়াও নানা ধরনের শুঁটকি মাছ পাওয়া যায় এখানে। সমুদ্রের ধারে মাছভাজার দোকানে ইচ্ছে হলেই গরম গরম মাছ ভাজার স্বাদ নেওয়া যায়। তবে ভাল মানের ভাল স্বাদের খাবার পেতে স্থানীয় ভাল হোটেলেই খাওয়া উচিত।
বকখালিতে ঘর সাজাবার অনেক জিনিস পাওয়া যায়। সমুদ্রের ধারের দোকানগুলিতে অন্যান্য সমুদ্র সৈকতের মতো ঝিনুকের তৈরি নানাবিধ মনগ্রাহী পুতুল, সিঁদুর কৌটা, পেনদানি, মুক্তার মালা, খেজুর পাতার আসন, মাদুর, টুপি ছাড়াও অনেক কিছু কেনাকাটা করা যায়। আপনি যদি মাছ খেতে ভালোবাসেন আর সস্তায় মাছ কেনার মজা উপভোগ করতে চান তবে ফ্রেজারগঞ্জের বন্দরে বিভিন্ন রকমের মাছ মেশানো এক থালা বা এক প্লেট নির্দিষ্ট দরে কিনে ফেলতে পারেন বাড়ি ফিরেও যা আপনাকে বকখালির গন্ধটা ফিরিয়ে দিতে পারে খাবারের পাতে।
ট্রিপ ট্রিপস
- কিভাবে যাবেন : ট্রেনে এলে শিয়ালদা থেকে নামখানা লোকালে চেপে নামখানা স্টেশনে নেমে টোটো ধরে বকখালিতে আসা যায়। নিজের গাড়িতে এলে ডায়মণ্ড হারবার রোড ধরে আমতলা, জোকা পেরিয়ে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যাবে বকখালি।
- কোথায় থাকবেন : বকখালিতে থাকার জন্য নানা বাজেটের হোটেল আছে। নিজের গাড়ি নিয়ে এলে ওয়েস্ট ট্যুরিস্ট লজে থাকা সুবিধেজনক, এখানে গাড়ি রাখার এবং ড্রাইভারের থাকার আলাদা বন্দোবস্ত আছে। মাথাপিছু প্রতি রাতের হোটেল ভাড়া এখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা থেকে শুরু।
- কি দেখবেন : বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে অবশ্যই থাকবে বকখালির বিস্তীর্ণ নির্জন সমুদ্র সৈকত। তাছাড়া রয়েছে কুমির ও হরিণ প্রজনন প্রকল্প, বনবিবির মন্দির। সাইটসিইং করতে গেলে নিকটস্থ উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা, জম্বুদ্বীপ, হেনরি আইল্যাণ্ড, ফ্রেজারগঞ্জ সৈকত ও মৌসুনী দ্বীপ ঘুরে আসা যায়।
- কখন যাবেন : বছরের যে কোনো সময়ই যাওয়া যায়। তবে গরমকাল আর বিশেষত বর্ষাকাল বাদ দিয়ে গেলেই ভালো হয়। শীতকাল আর্দশ সময়।
- সতর্কতা –
- গাড়ি ভাড়া করার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে। ওদের তালিকায় বেশ কিছু পয়েন্ট ধরা থাকে। অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু কোন দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে দেখিয়ে সেটাকে তারা গুনতির মধ্যে ধরে। তাই আগে থেকে কথা গাড়ি ভাড়া করার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন কোন কোন স্থান তারা দেখাবে।
- বকখালিতে সমুদ্র সৈকতে চড়া পড়েছে এবং চড়া সংলগ্ন একটি পাঁচ মিটার সরু খাল তৈরি হয়েছে। জোয়ারের সময় এই খালটি জলে ভরে যায়। ফলে পর্যটকরা ভাটার সময় খাল পেরিয়ে সমুদ্রের কাছে গেলেও জোয়ারের সময় খালটিকে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এই বিষয়ে সাবধানতা প্রয়োজন।
- সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নিতে হলে সমুদ্রের ধারে মাছ ভাজা কিনে না খাওয়াই ভালো, তার থেকে ভালো কোনো হোটেলে খেতে পারেন।
- পিকনিকের পর সেখানে প্লাস্টিকের থালা, গ্লাস, চায়ের কাপ, মদের বাক্স ইত্যাদি ফেলে যাবেন না।
- পিকনিক স্পটে একটিমাত্রই শৌচাগার এবং সেটি ব্যবহার করতে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়।
- বিশেষ পরামর্শ –
- বকখালি যদিও একদিনে ঘুরে আসা যায় কিন্তু যদি একটি রাত থাকা যায় তাহলে খুব ভালো করে উপভোগ করা পূর্ণিমার সৌন্দর্য আর আশেপাশের জায়গাগুলিও সময় নিয়ে দেখে আসা যায়।
বকখালি নিয়ে একটি ভিডিও দেখুন এখানে
4 comments