ভৌগোলিক দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে মরুভূমি ছাড়া প্রায় সবই আছে। উত্তরে দার্জিলিং বা ডুয়ার্স থেকে শুরু করে দক্ষিণে সুন্দরবন বা বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত, কী নেই এখানে! পাহাড় থেকে জঙ্গল, নদী থেকে সমুদ্র, ঐতিহাসিক স্থান থেকে ধর্মস্থান সবকিছু দেখতে পাওয়া যায় এই বাংলায়। যে কারণে তাকে ভারতের ছোট সংস্করণ বলাই যায়। বেশ কিছু স্থান গরমে তপ্ত হয়ে ওঠে আবার বেশ কিছু স্থান বর্ষাকালে যাবার অযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সারাবছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেখানে নির্দ্বিধায় ঘুরতে যায় তা হল এখানকার সমুদ্রসৈকত। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দশের বেশি সমুদ্রসৈকত রয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত (5 most popular sea beaches in west bengal) নিয়ে আলোচনা করা হল। সেই সৈকতে কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এইসব বিস্তারিত জানতে উল্লিখিত লিঙ্কে ক্লিক করুন।
দীঘা – পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রসৈকত বললে প্রথমেই যে নামটা মনে আসে, তা নিঃসন্দেহে দীঘা। কেউ কেউ বলে দীঘা হল “বাঙালির গোয়া”, আবার ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর একটি চিঠিতে দীঘাকে “প্রাচ্যের ব্রাইটন” বলে উল্লেখ করেছিলেন। কথাতেই আছে, বাঙালির ঘোরার তিনটে জায়গা হল দীপুদা, অর্থাৎ দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং। দীঘা বাঙালির কাছে কখনও পুরনো হয় না। তাই সারা বছর ধরেই এখানে প্রচুর ভিড় থাকে। বিশেষ করে স্কুলগুলোয় গ্রীষ্ম এবং পুজোর ছুটিতে এখানে প্রচুর মানুষ ঘুরতে যায়। একা হোক বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে হোক কিংবা পরিবার নিয়ে হোক, সকলের জন্যই দীঘা ঘোরবার একটি আদর্শ জায়গা। এছাড়া স্থানীয় লোকেরা এখানে পিকনিক করতেও আসে।
এখানে ট্রেনে, বাসে বা গাড়িতে তিনভাবেই যাওয়া যায়। বিশেষ করে দীঘা যাওয়ার জন্য বাস খুবই সহজলভ্য। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে সরকারী এবং বেসরকারী বাস ছাড়ে। দীঘাতে সমস্ত মূল্যের হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়। অনেক কম মূল্যের হোটেল যেমন আছে, আবার অনেক বেশি মূল্যের খুব ভালো হোটেলও ভাড়া পাওয়া যায়। দীঘাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ওল্ড দীঘা এবং নিউ দীঘা। ওল্ড দীঘাতে অবস্থিত দীঘা মোহনা থেকে দীঘার সীমা শুরু হয় এবং নিউ দীঘার ওসিয়ানা সৈকতে গিয়ে দীঘার সীমা শেষ হয়। সমুদ্র ছাড়াও এখানে দেখবার জন্য আরও অনেক জায়গা রয়েছে যেমন নিউ দীঘা সায়েন্স সেন্টার, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম অ্যান্ড রিজিওনাল সেন্টার, অমরাবতী পার্ক, কাজল দীঘি, ঢেউসাগর পার্ক ইত্যাদি। দীঘাতে কোথায় থাকবেন, কী দেখবেন, কী করবেন সেই সব বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখানে।
মন্দারমনি – দীঘার পরেই পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত এর মধ্যে যে সৈকতটির নাম উঠে আসে তা হল মন্দারমনি। মূলত কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে মানুষ সপ্তাহের শেষে ছুটিতে ঘুরতে যান এখানে। প্রায় সব হোটেল থেকেই সমুদ্র দেখা যায় কারণ হোটেলগুলো সৈকতের ওপরেই তৈরি হয়েছে। সাধারণত বন্ধুবান্ধব নিয়ে বা অফিসের সহকর্মীদের সাথে কিংবা নবদম্পতিরা মধুচন্দ্রিমার জন্য এখানে ঘুরতে যান। হোটেলে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে সময় কাটানোর জন্য এটা আদর্শ জায়গা।
ট্রেনে বা বাসের সুবিধা থাকলেও সাধারনত নিজের গাড়ি বা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেই বেশিরভাগ মানুষ এখানে ঘুরতে যান। ট্রেনে বা বাসে গেলেও হোটেল অবধি পৌঁছতে গাড়ি লাগবেই। সব হোটেলের দামই অন্য সৈকতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে এখানে বেশি। দীঘার থেকে এই সৈকত অপেক্ষাকৃত নির্জন হলেও সপ্তাহের শেষ দুই দিন সারাবছর ধরেই এখানে ভিড় থাকে। যে কারণে সপ্তাহের শেষে মন্দারমনি যাবার প্ল্যান করলে একটু আগে থেকে হোটেল বুক করুন। মন্দারমনিতে কোথায় থাকবেন, কী দেখবেন, কী করবেন সেই সব বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখানে।
বকখালি – দীঘা বা মন্দারমনির মত অতটা জনপ্রিয় না হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে বকখালি কোনও অংশে কম নয়। দীঘা বা মন্দারমনির সাথে এই সৈকতের পার্থক্য হল এখানের সৈকতের সাদা বালি এবং এই সৈকতের ব্যাপ্তি । সমুদ্রকে ছুঁতে হলে সৈকতের ওপর দিয়ে অন্তত কুড়ি মিনিট হেঁটে আসতে হবে। এখানে সমুদ্রের ঢেউ অপেক্ষাকৃত ছোট। সমুদ্র সৈকতের পাড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মূলত কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে মানুষ দুই থেকে তিনদিনের জন্য পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে যান এখানে। এছাড়া স্থানীয় লোকেরা এখানে পিকনিক করতেও আসে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত নামখানা স্টেশন থেকে জেটিঘাট পর্যন্ত এসে ভেসেলে করে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী পার হয়ে বকখালি পৌঁছাতে হত। গাড়ি, বাস সমস্তই এই ভেসেলে করেই পাড় হত। বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হত এখানেই। যাতায়াতের এই অসুবিধা এই সৈকতের জনসমাগম কম হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। সে সময় এখানে হোটেলও ছিল কম। বর্তমানে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর ওপর নামখানা ব্রিজ তৈরি হওয়ায় খুব সহজেই বকখালি যাওয়া যায়। এখন হোটেলের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে। ট্রেনে, বাসে বা গাড়িতে তিনভাবেই এখানে যাওয়া যায়। তবে এখানে যাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হল শিয়ালদহ-নামখানা লোকালে করে নামখানা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে বকখালি যাওয়া। বকখালিতে কোথায় থাকবেন, কী দেখবেন, কী করবেন সেই সব বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখানে।
শঙ্করপুর – দীঘা এবং তাজপুর সৈকতের মধ্যে অবস্থিত শঙ্করপুর দীঘার থেকে কম জনপ্রিয় হলেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যারা ভিড় পছন্দ করেন না এবং একটি নিরিবিলি সৈকতে ঘুরতে চান তাদের জন্য এটি একটি ভাল জায়গা। জোয়ার একটু বেশি হওয়ায় এই সৈকত স্নানের জন্য উপযুক্ত নয়। মূলত কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পর্যটকেরা ঘুরতে যান এখানে।
এখানে ট্রেনে, বাসে বা গাড়িতে তিনভাবেই যাওয়া যায়। দীঘার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় দীঘাতে পৌঁছে সেখান থেকে টোটো, ভ্যান বা গাড়িতে শঙ্করপুর যেতে হয়। এখানে বিভিন্ন মূল্যের হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়।
তাজপুর – নিরিবিলিতে সমুদ্রের কাছে সময় কাটানোর দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রথম পছন্দ তাজপুর। হোটেল আর সমুদ্রের মাঝে এখানে সবুজের সমাহার। সেই সবুজ পেরিয়ে হলুদ সৈকতের মধ্যে যাওয়ার পর লাল কাঁকড়ার খেলা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তবে মানুষের ভিড় বাড়ার সাথে এই কাঁকড়ার ভিড় ক্রমশ কমছে। মূলত কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চল থেকে মানুষ সপ্তাহের শেষে ছুটিতে ঘুরতে যান এখানে। সাধারণত বন্ধুবান্ধব নিয়ে বা অফিসের সহকর্মীদের সাথে কিংবা দম্পতিরা এখানে ঘুরতে যান।
ট্রেনে বা বাসের সুবিধা থাকলেও সাধারনত নিজের গাড়ি বা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেই বেশিরভাগ মানুষ এখানে ঘুরতে যান। গাড়ি করে গেলে সবচেয়ে বেশি সুবিধার কারণ ট্রেন হোক বা বাস আপনাকে সেই গাড়ি ভাড়া করতেই হবে বারবার, সঙ্গে যতবার কোন জায়গায় যাবেন, ততবার ভাড়া করে যেতে হবে। বিশেষ করে তাজপুরের হোটেল গুলো এতই ভেতরে যে সমুদ্রে যেতেও গাড়ি চাই। তাই নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়াই পছন্দ করে মানুষ। তাজপুরে কোথায় থাকবেন, কী দেখবেন, কী করবেন সেই সব বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখানে।
এই পাঁচটি সমুদ্র সৈকত ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য সৈকত বা ভ্রমণস্থান নিয়ে জানতে এখানে পড়ুন।
সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩
তথ্যসূত্র
- নিজস্ব সংকলন