
সপ্তাহের শেষে এক কিংবা দুইরাত কোন সমুদ্রসৈকতে থাকার জন্য কলকাতা থেকে ১৫০ কিমি দুরত্বে মন্দারমনি বোধহয় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সারাবছর ধরেই এখানে পর্যটকের আনাগোনা। দিঘা থেকে কাছেই এবং অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এই সৈকতে একটু নির্জনে সমুদ্র উপভোগ করা, রিসোর্ট থেকেই সমুদ্র দেখা বা লাল কাঁকড়ার সাথে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলা মানুষ উপভোগ করে এখানে।
মন্দারমনি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত দীঘা থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে একটি অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল সমুদ্রসৈকত। যদি আমরা মন্দারমনি অঞ্চলের ম্যাপ বুঝতে চাই, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশার দিকে পরপর সমুদ্রের জায়গাগুলো হল যথাক্রমে বাঁকিপুট, জুনপুট, মন্দারমনি, তাজপুর মোহনা, তাজপুর, চাঁদপুর, শঙ্করপুর, দীঘা মোহনা, ওল্ড দীঘা, নিউ দীঘা, উদয়পুর, তালসারি (এটি ওড়িশার সমুদ্রসৈকত)। বকখালি এবং সেই সংলগ্ন সমুদ্রসৈকত গুলো আলাদাভাবে যেতে হয় বলে সেই তালিকায় এদের সাথে জোড়া হল না।
দীঘা থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে মন্দারমনি সমুদ্রসৈকতের জনপ্রিয়তা দীঘার পরেই। দীঘা বহুদিন ধরেই বাঙালীর প্রিয় সমুদ্রসৈকতের তালিকায় আছে। তবে ভিড় বাড়ার সাথে সাথে বাঙালি অপেক্ষাকৃত শান্ত,নিরিবিলি সমুদ্রের খোঁজ করেছে। আর তখনই মন্দারমনির মত শান্ত জায়গার দিকে তারা ঝুঁকেছে। মন্দারমনি সমুদ্রসৈকত যে কারণে বাকিদের থেকে আলাদা তা হল সব হোটেলগুলোই সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রের এত কাছে হোটেল থাকার জন্য পর্যটকদের কাছে মন্দারমনি যেমন অন্যতম প্রিয় একটা গন্তব্য, তেমনি বলা হয় প্রচুর হোটেল নাকি নিয়ম লঙ্ঘন করে সমুদ্রের এত কাছে হোটেল তৈরি করতে পেরেছে। এটা নিয়ে যদিও পর্যটকদের সরাসরি মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আরও একটা বিষয় যেটাও মন্দারমনিকে আকর্ষণীয় করে তোলে তা হল প্যারাসেইলিং বা বিভিন্ন বিপজ্জনক ওয়াটার স্পোর্ট। এটা নিয়ে পর্যটকদের সরাসরি মাথাব্যথা থাকা উচিত কারণ এইগুলো পুরোপুরি বেআইনি।

কলকাতা থেকে মন্দারমনির দুরত্ব মোটামুটি ১৫০ কিমি এবং বাস, গাড়ি বা ট্রেন তিনভাবেই যাওয়া যায়। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ট্রেনে করে আসতে চাইলে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন। তবে মন্দারমনি যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন ট্রেন নেই। মন্দারমনির কাছাকাছি স্টেশন হল কাঁথি। স্টেশনে নেমেই গাড়ি বা ভ্যান রিক্সা পেয়ে যাবেন। বাসে করে গেলে ধর্মতলার শহীদ মিনারের কাছ থেকে দীঘাগামী যেকোনও বাসে চেপে চাউলখোলা আসতে হবে। তারপর সেখান থেকে অটো বা ভ্যান রিক্সা ধরে সোজা মন্দারমনি। তবে মন্দারমনির জন্য সবচেয়ে ভালো হবে গাড়ি করে আসা। প্রচুর পর্যটক নিজেদের গাড়ি বা গাড়ি ভাড়া করে কলকাতা থেকে চলে আসেন মন্দারমনি। কলকাতা থেকে গাড়ি করে মন্দারমনির এই যাত্রাপথ খুব উপভোগ্য, বিশেষ করে যাদের নিজেদের গাড়ি আছে। মোটামুটি চার থেকে বড়জোর পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা। গাড়ি করে এলে সবচেয়ে বেশি সুবিধার কারণ ট্রেন হোক বা বাস আপনাকে সেই গাড়ি ভাড়া করতেই হবে বারবার, সঙ্গে যতবার কোন জায়গায় যাবেন, ততবার ভাড়া করে যেতে হবে। তার থেকে নিজের গাড়ি থাকলে সব দিক থেকেই সুবিধা।
এখানের হোটেল গুলো দিঘার মত ঘিঞ্জি নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই দাম একটু বেশি পড়ে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভিড় এখানেও বেড়েছে। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মন্দারমনিতে হোটেলের খরচ গড়ে প্রতিদিন প্রতিদিন ২০০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত।
মন্দারমনির সকালের সমুদ্রের ধারে হাঁটতে ভালো লাগবে। হাঁটতে হাঁটতে খিদে পেলে সৈকতের ওপর ছোট দোকানগুলোয় খেতে পারেন। সেটা ভালো অভিজ্ঞতা। তবে অনেক দোকানগুলোতে বেআইনি ভাবে মদ সহজলভ্য। অনেকেই মদ্যপান করে সমুদ্রে নেমে পড়ছে আর তার ফলেও কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে। এইসমস্ত কিছু থেকে দূরে থাকুন। এই সমস্ত কিছুই কিন্তু বেআইনি। বিশ্বাস করুন মন্দারমনির মজা এইসবেতে একদমই নয়। বরং গাড়ি বা ভ্যানবিহীন সৈকতে ভোরবেলা হাঁটতে হাঁটতে সামনে অসীম সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা। এখানের হোটেলগুলো সৈকতের অনেক কাছে। তাই সন্ধ্যে বা রাতের বেলাতেও হোটেল বা রিসোর্ট থেকে এখানে সমুদ্র দেখার মজা অন্যরকম। সকালবেলা ঘুরে আসতে পারেন কাছাকাছি তাজপুর মোহনায়। সেখানে লাল কাঁকড়ার সারি দেখতে বেশ ভাল লাগবে। তবে তাদের ধরতে যাবেন না। মোহনায় স্নান করবেন না। মন্দারমনির সমুদ্রে স্নান করতেই পারেন তবে খুব বেশিদূর না যাওয়াই ভালো। এখানের জল দিঘার মতই ঘোলাটে।

কাছাকাছি ঘুরে আসতে চাইলে সবচেয়ে কাছেই তাজপুরে ঘুরে আসতে পারেন। তবে দীঘার মত এখানে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রচুর গাড়ি পাওয়া যাবে না। হোটেলের সাথে কথা বললে ওরাই ব্যবস্থা করে দেবে। নিজেদের গাড়ি থাকলে তো সবচেয়ে ভালো। এছাড়াও দীঘা, উদয়পুর, শঙ্করপুর, তালসারি, দীঘা মোহনা, তাজপুর মোহনা বা চাঁদপুর সৈকতেও ঘুরে আসতে পারেন।
সারা বছর ধরেই মন্দারমনি ঘুরে আসা যায়। বিশেষ করে গাড়ি করে যাওয়ার সুবিধার জন্য পর্যটকেরা তো সারা বছর ধরেই ভিড় জমায় এখানে। তবে গরম একটু কমলে সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে মনোরম পরিবেশ থাকে। আবার বর্ষাকালেও সমুদ্র বেশ ভালো লাগে তবে সেই সময় না যাওয়াই ভালো।
সমুদ্রের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দোকান আছে, যেখান থেকে কাঁকড়া খেতে পারেন। এছাড়াও অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের মতোই এখানেও বিশেষ খাবার বলতে পমফ্রেট, চিংড়ির মত সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদির সুস্বাদু রেসিপি রসনা তৃপ্তি ঘটাবেই। সামুদ্রিক মাছের বিভিন্ন রান্নাও খেতে পারেন, তবে সেগুলো রাস্তার দোকানে খুব বেশি থাকে না।
কেনাকাটি যদি করতে চান তাহলে অবশ্যই দীঘা। এখানে দোকান খুবই কম। যে কটা দোকান আছে সেগুলোতে জিনিস অবশ্যই দীঘার মত নেই।

নিয়মের তোয়াক্কা না করেই এখানে প্যারাসেইলিং বা বিভিন্ন বিপজ্জনক ওয়াটার স্পোর্ট হয়। এগুলো একেবারেই করতে যাবেন না কারণ এইগুলো পুরোপুরি বেআইনি। এছাড়াও পর্যটকেরা গাড়ি নিয়ে সৈকতের ওপর রেস করেছে বহুবার। এর ফলে ২০১৫ থেকে ২০১৭ এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। তারপর থেকে সমুদ্রসৈকতের ওপর গাড়ি চালানো একেবারেই নিষেধ। এইসব আইন নিয়ে এখানে বেশ কড়াকড়ি এসেছে। অতএব এগুলো খেয়াল রাখবেন।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেন- কলকাতা থেকে বাসে করে গেলে ধর্মতলার শহীদ মিনারের কাছ থেকে দীঘাগামী যেকোনও বাসে চেপে চাউলখোলা। তারপর অটো বা ভ্যান রিক্সা ধরে সোজা মন্দারমনি। ট্রেনে যেতে হলে হাওড়া স্টেশন থেকে রামনগর বা কাঁথি স্টেশনে নেমে অটো বা ভ্যান রিক্সা ধরে সোজা মন্দারমনি। নিজের গাড়ি হলে সবচেয়ে সুবিধা,যখন ইচ্ছা ঘুরে আসতে পারেন কাছাকাছি জায়গাতেও।
- কোথায় থাকবেন- এখানে প্রচুর হোটেল আছে। আগে থেকে বুক করে যাওয়া ভালো। রাত প্রতি মোটামুটি ২০০০ টাকার মধ্যে ভালো হোটেল বা রিসোর্ট পাওয়া যায়।
- কি দেখবেন- কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে দিঘা, তাজপুর, চাঁদপুর, উদয়পুর, শঙ্করপুর, তালসারি,দিঘা মোহনা, তাজপুর মোহনা।
- কখন যাবেন- সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ঘুরে আসতে পারেন। তবে সারাবছরই যাওয়া যায় এখানে।
- সতর্কতা-
- ঢেউ এখানে খুব বেশি না হলেও খুব বেশি দূরে স্নান করতে যাওয়ার কোনই দরকার নেই। মদ খেয়ে সমুদ্রে একেবারেই নামবেন না। এর আগেও এখানে এই নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
- সমুদ্রের পাড়ে গাড়ি চালাবেন না। এর আগেও এখানে এই নিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।প্যারাসেইলিং বা কোনরকম ওয়াটার স্পোর্ট এড়িয়ে চলাই ভালো। এর আগেও এখানে এই নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
- মন্দারমনির সৈকতে সন্ধ্যের পর দীঘার মত ভিড় থাকে না। হোটেলের কাছাকাছি থাকতে পারেন কিন্তু বেশিদূর যাবেন না।
- বিশেষ পরামর্শ- জিনিসপত্র কেনাকাটির জন্য দিঘা আসতে পারেন, মন্দারমনিতে দোকান প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাম অনেক বেশি পড়ে।
6 comments