পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত বকখালি। দীঘা, মন্দারমনির একঘেয়েমি কাটাতে মানুষ ভিড় করে এখানে। বকখালিতে কী দেখবেন সেই সমস্ত স্থানগুলোর বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হল।
.
বকখালির দর্শনীয় স্থান
বকখালিতে কী দেখবেন বলতে বকখালির বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত, বনবিবির মন্দির এবং ইকো পার্ক বোঝায়। আগে এখানে কুমির ও হরিণ প্রজনন প্রকল্প ছিল যেটা এখন বন্ধ। ইকো পার্ক বাদে বাকি তিনটে জায়গাই পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।

বকখালির সমুদ্র সৈকত – এখানকার সমুদ্র সৈকত আসলে একটি সক্রিয় বদ্বীপের অংশ। এখানে প্রকৃতির নিয়মে জোয়ার-ভাঁটার মাধ্যমে পলি সঞ্চয় ও ক্ষয়ের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটে। তাই এই সৈকত ক্রমনির্মীয়মান। দীঘা বা মন্দারমনির সাথে এই সৈকতের পার্থক্য হল সৈকতের ব্যাপ্তি। সমুদ্রকে ছুঁতে হলে সৈকতের ওপর দিয়ে অন্তত কুড়ি মিনিট হেঁটে আসতে হবে। সামনে একটি পঞ্চাশ মিটার সরু খালের সৃষ্টি হয়েছে যেখানে জোয়ারের সময় জল পরিপূর্ণ থাকে আর ভাঁটার সময় তাতে নানা ধরনের মাছ ও কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায়। এই খাল পেরিয়ে সমুদ্রের কাছে যেতে হয়। জোয়ারের সময় বা বর্ষার সময় এই খাল পেরনো খুবই বিপদজনক। এখানে সমুদ্রের ঢেউ অপেক্ষাকৃত ছোট। সমুদ্র সৈকতের পাড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সৈকত ফাঁকা হওয়ার ফলে এখানে কাঁকড়ার চলাফেরা দেখতে পাওয়া যায়।

বনবিবির মন্দির – সমুদ্রতট থেকে প্রায় কুড়ি মিনিট হেঁটে দেখে আসতে পারেন বনবিবির মন্দির। স্থানীয়দের মতে এই মন্দিরটি তিনশো বছরের পুরোনো। এখানকার স্হানীয় অধিবাসীরা অধিকাংশই মৎস্যজীবি। তারা সমুদ্রে যাওয়ার আগে বনবিবিকে পুজো দিয়ে যান। তাদের বিশ্বাস যে, দেবী সন্তুষ্ট থাকলে সব বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন তারা। সমুদ্র থেকে কিছুটা ভেতরে এবং উঁচুতে রয়েছে এই মন্দির। মন্দিরে বনবিবির সাথে আরও অন্যান্য দেবতার মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের সামনে আছে একটি পুকুর। মন্দির খোলা ও বন্ধের সময় স্থানীয় মানুষদের কাছে জেনে নিতে হবে।

কুমির প্রকল্প – সমুদ্র সৈকতের খুব কাছেই বাস স্ট্যান্ডের পাশে রয়েছে কুমির প্রকল্প। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগের তরফ থেকে এখানে একটি কুমির প্রজনন প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল যা আসলে একটি উন্মুক্ত চিড়িয়াখানা। এখানে প্রবেশের রাস্তা ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভেতর দিয়ে। বড় শিংওয়ালা হরিণ, বাঁদর, নানা প্রজাতির পাখি ও কাঁকড়া দেখা যেত এখানে। কুমিরের পাশাপাশি এখানে হরিণেরও প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সমস্ত কিছুই ২০২০ সালের আমফান ঝড়ের আগে অবধি ছিল। কিন্তু ঝড়ের প্রভাবে জায়গাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেইসময় এখানের প্রাণীদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বর্তমানে তাই দেখার কিছুই নেই এবং সেই কারণেই বর্তমানে কুমির প্রকল্পের কোনও প্রবেশ মূল্যও নেই।
পিকনিকের মাঠ – কলকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলি থেকে সারা বছর ধরেই পর্যটকেরা এখানে থাকার পাশাপাশি পিকনিক করতেও আসেন। বকখালি সৈকতের ওপরে পার্কিং এর পাশেই পিকনিকের জন্য একটি মাঠ রয়েছে। ওই মাঠে রান্না করে খাওয়া বা আলাদাভাবে পিকনিকের খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। পিকনিকের জন্য মাঠ ভাড়া দিতে হয় ৫০ টাকা, যদি রান্না করেন তার জন্য ভাড়া দিতে হয় ৫০ টাকা এবং গাড়ি পার্কিং এর ভাড়া ছোট গাড়ির জন্য ৬০ টাকা ও বড় গাড়ির জন্য ১০০ টাকা। মাঠের বাইরে একটিমাত্রই শৌচাগার আছে এবং সেটি ব্যবহার করতে গেলে অনেক সময়েই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। পিকনিকের পর সেখানে প্লাস্টিকের থালা, গ্লাস, চায়ের কাপ, মদের বাক্স ইত্যাদি ফেলে যাবেন না।
.
বকখালির সাইটসিইং
টোটো বা ভ্যানে করে বকখালির সাইটসিইং করা যায়। এছাড়া নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে তো কোন অসুবিধা নেই। বকখালির সাইটসিইং বলতে লালগঞ্জ সৈকত, হেনরি আইল্যাণ্ড, ফ্রেজারগঞ্জ সৈকত, কার্গিল সৈকত, জম্বুদ্বীপ ইত্যাদি ঘুরতে যাওয়া বোঝায়। টোটো করে এর জন্য খরচা মোটামুটি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পড়বে। কোন কোন জায়গা এই ট্রিপের অন্তর্গত হবে এবং একটি জায়গায় কতক্ষণ থাকবেন সেই অনুযায়ী টোটোর ভাড়া নির্ধারিত হবে এবং সেগুলো ভাল করে কথা বলে নেবেন।

লালগঞ্জ সৈকত – বকখালির নবীনতম এবং নির্জনতম আকর্ষণ হল লালগঞ্জ সৈকত। এই সৈকত আক্ষরিক অর্থেই জনমানবশূন্য থাকে। শুধু এখানের কয়েকজন গ্রামবাসীকে দেখতে পাবেন এখানে। আর নির্জন হওয়ার কারণে দেখতে পাবেন লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ। এটা মূলত একটি গ্রাম এবং সৈকতের উলটো দিকেই গ্রামের ঘরগুলো দেখতে পাবেন। বন্যা হলে সমুদ্রের জল এই ঘরগুলো ভেঙ্গে দেয়। এখানে যাওয়ার রাস্তা খুবই সরু। তাই টোটো করে এখানে যাওয়া গেলেও নিজের গাড়ি নিয়ে এখানে যাবেন না। এখানে হেঁটে বেশিদূর যাবেন না বা জলে নামবার চেষ্টা করবেন না। নির্জন হওয়ার কারণে বিপদে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে কাউকে নাও পেতে পারেন। তাই এখানে সাবধানতার সাথে ঘুরতে হবে।

হেনরি আইল্যাণ্ড – সমুদ্র আর জঙ্গল দুই ভিন্ন প্রকৃতির অনুভূতি একত্রে উপভোগ করতে চাইলে হেনরি আইল্যান্ড একেবারে উপযুক্ত জায়গা। গঙ্গার ব-দ্বীপগুলির মধ্যে অন্যতম সুন্দর এই হেনরি আইল্যাণ্ডে সাদা বালি, নির্জনতা আর কাচের মতো স্বচ্ছ সমুদ্রের জল একসঙ্গে মিলে যেন এক স্বপ্নজগৎ তৈরি করে। রিসর্ট থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার ইটের রাস্তার দু’দিকে ম্যানগ্রোভের সমারোহ অভ্যর্থনা জানায় পর্যটকদের। বর্ষায় আকাশ জুড়ে মেঘ করলে মনে হয় যেন মেঘ আর সমুদ্র একই দিগন্তরেখায় মিলেমিশে গেছে। তবে সমুদ্রে নামা যায় না এখানে কারণ এখানের জলে চোরাস্রোত এবং সৈকতে চোরাবালি রয়েছে। হেনরি আইল্যাণ্ডে থাকতে চাইলে বা এখানে ভ্রমণের সমস্ত বিস্তারিত তথ্য জানতে পড়ুন এখানে।

বকখালি ইকো পার্ক – বকখালি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বকখালি ইকো পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে বাচ্চাদের জন্য দোলনা, স্লিপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পশুপাখির মডেল রয়েছে যা বাচ্চাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। পরিবারের সঙ্গে বকখালি গেলে একবার এই পার্কে যাওয়া যায়। শুধু ছোটদের জন্য নয়, বড়দের জন্য দোলনা, বসার সুন্দর বেঞ্চি করা আছে। এখানে বসে সমুদ্রের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। পার্কে প্রবেশের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। বিকেল চারটের পর পার্ক বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসের কয়েকদিন জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল পার্কে ঢুকে যায়। সেই সময় পার্কটি প্রায় একচেটো জলে ডুবে থাকে। তবে শুধু বিনোদনের জন্যই নয়, বকখালি ইকো পার্কে থাকার জন্য টেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে এই টেন্ট পরিষেবা শুরু হয়েছে। টেন্টে থাকলে সারাদিনই পার্কের ভেতরে ঘোরা যায়। শুধু রাত সাড়ে সাতটার পর সমুদ্রে যাওয়া যায় না। থাকা খাওয়া নিয়ে টেন্টের ভাড়া ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। জোয়ারের সময় পার্কটি জলে ভরে গেলেও উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় টেন্টে জল ঢোকার সম্ভাবনা কম।

ফ্রেজারগঞ্জ সৈকত – বকখালি ইকো পার্ক থেকে পায়ে হাঁটা দুরত্বে নির্জন একটি সৈকত রয়েছে যার নাম ফ্রেজারগঞ্জ সৈকত। স্থানীয় সূত্রের খবর অনুযায়ী ফ্রেজার সাহেব এলাকাটিতে রিসর্ট গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ এসে তাঁর নির্মীয়মাণ রিসর্টগুলো ভেঙ্গে দিত। সেই রিসর্টের ধ্বংসাবশেষ এখনও এখানে দেখা যায়। সৈকতে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফ্রেজার সাহেবের রিসর্টের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া নারকেল গাছ আর সৈকতের পিছনে উইন্ড এনার্জি ফার্মের বড় বড় উইন্ড টার্বাইন গুলো নিয়ে যে ভিউ তৈরি হয়েছে এখানে তা অন্যান্য সৈকতের থেকে একে আলাদা করে। প্রকৃতির এক আদিম রূপ যেন বিরাজ করছে এখানে। সারা সৈকত জুড়েই রিসর্টের ইতস্তত ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে থাকার জন্য এখানে সাবধানে চলবেন।

কার্গিল বিচ – বকখালি থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে একটি কম জনবহুল সৈকত রয়েছে যা কার্গিল বিচ নামে পরিচিত। মুলত সূর্যাস্ত দেখতেই ভিড় জমায় লোকে এখানে। সূর্যাস্তের সময় এই সৈকতকে অপূর্ব লাগে। স্থানীয় সূত্রের খবর অনুযায়ী কার্গিল যুদ্ধের সময় এখানে শুঁটকী মাছচাষকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল ঝামেলা হয়। সেই থেকে এই সৈকত কার্গিল বিচ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। এখানে ঢালু বাঁধানো সিমেন্টের পাড় নেমে গেছে সমুদ্রে। সমুদ্র এসে আছড়ে পড়ে সেই পাড়ে। সমুদ্রের স্রোতে বেশ কিছু পাড় ভেঙ্গে গেছে। সেই পাড় বেয়ে খুব ধীরে সাবধানে সমুদ্রের কাছে যেতে হবে নইলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তবে সঙ্গে বাচ্চা থাকলে পাড় থেকেই সমুদ্র উপভোগ করা বেশি ভাল।
জম্বু দ্বীপ – বকখালি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হল জম্বুদ্বীপ। মাছ ধরার মরশুম অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় এই দ্বীপ জনবসতিশূন্য থাকে। অতীতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকা থেকে জেলেরা মাছ ধরার জন্য এখানে আসত। নৌকা করে এই দ্বীপ আসতে হয় তবে এখানে নামতে দেওয়া হয় না। ফ্রেজারগঞ্জের কাছেই একটি জেটি ঘাট আছে, যার পোশাকি নাম এডওয়ার্ড ক্রিক। এখান থেকেই জম্বু দ্বীপের জন্য নৌকা ছাড়ে। তবে নৌকা করে জম্বু দ্বীপ না ঘুরতে গেলেও এই জেটি ঘাটেই ঘণ্টাখানেক সময় কেটে যায়। এখানে মাছ ধরার বড় বড় নৌকা পাড়ে এসে মাছ নামায়। রংবেরঙের নৌকার যাওয়া আসা দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়।
সর্বশেষ সম্পাদনার সময়কাল – ২০২৩