পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত একটি অন্যতম প্রধান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এবং পর্যটনকেন্দ্র হেনরি আইল্যান্ড (Henry Island)। সুন্দরবনের দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের কাছে অবস্থিত ‘হেনরি আইল্যান্ড’ এক কথায় সমুদ্র ও জঙ্গল একত্রে উপভোগ করার জন্য আদর্শ জায়গা। বকখালির নাম যদি শুনে থাকেন তাহলে তার সঙ্গেই চলে আসে হেনরি আইল্যান্ডের নাম। এমনকি বকখালি ঘুরতে গেলেও এই হেনরি আইল্যান্ড টুক করে দেখে নেওয়া যায়। ব্যস্ত জীবনের সামান্য অবসর ভালোভাবে কাটাতে সমুদ্রপ্রেমী পর্যটকদের কাছে হেনরি আইল্যান্ড যেন এক স্বপ্নজগৎ।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নামখানা ব্লকের অন্তর্গত ‘হেনরি আইল্যান্ড’ বিশেষত মৎস্যজীবীদের দ্বীপ। কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপ পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত বকখালি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। নামখানার হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরোলেই চোখে পড়ে যাবে এই হেনরি আইল্যান্ড ।

উনিশ শতকের এক ইউরোপীয় সাহেব হেনরি একটা সময়ে এই অঞ্চলের সার্ভেয়ার ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই এই দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছে হেনরি আইল্যান্ড।
সমুদ্র আর জঙ্গল দুই ভিন্ন প্রকৃতির অনুভূতি একত্রে উপভোগ করতে চাইলে হেনরি আইল্যান্ড একেবারে উপযুক্ত জায়গা। গঙ্গার ব-দ্বীপগুলির মধ্যে অন্যতম সুন্দর এই হেনরি আইল্যাণ্ডে সাদা বালি, নির্জনতা আর কাচের মতো স্বচ্ছ সমুদ্রের জল একসঙ্গে মিলে যেন এক স্বপ্নজগৎ তৈরি করে। ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের আলো সাদা বালিতে পড়ে চিকচিক করে। আবার ভরা জ্যোৎস্নায় জীবনানন্দের কবিতার মতো কৃষ্ণা দ্বাদশীর চন্দ্রালোক মরে যায় সেই বালির চড়ায়। রিসর্ট থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার ইঁটের রাস্তার দুদিকে গাছের সমারোহ অভ্যর্থনা জানায় পর্যটকদের। বর্ষায় আকাশ জুড়ে মেঘ করলে মনে হয় যেন মেঘ আর সমুদ্র একই দিগন্তরেখায় মিলেমিশে গেছে। অজস্র লাল কাঁকড়া যখন বালি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে, তখন মনে হয় লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত। সমুদ্র ছাড়াও এখানে রয়েছে সবুজ ম্যানগ্রোভ অরণ্য যা চোখকে অনাবিল তৃপ্তি দেয়। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যায়। সমুদ্রের তীরে সাদা বালির উপরে সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে পরিবারের সঙ্গে বা একান্তেই নিজের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এত কাছে থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করার এর থেকে ভালো সুযোগ কমই পাওয়া যায়।
হেনরি আইল্যান্ড যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল বা নামখানা লোকাল ধরে নামখানা স্টেশন নামতে হবে প্রথমে। তারপর সেখান থেকে টোটো বা অটো করে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় বকখালি এবং সেখান থেকেই রিকশায় বা ট্রেকারে চেপে হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়া যায়। ২০২০ সাল পর্যন্ত নামখানা স্টেশন থেকে জেটিঘাট পর্যন্ত এসে ভেসেলে করে নদী পার হয়ে হেনরি আইল্যান্ডে পৌঁছাতে হতো। কিন্তু এখন নামখানা থেকে বকখালিকে যুক্ত করেছে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজ আর সেই কারণেই এখন নামখানা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে সহজেই চলে যাওয়া যায় হেনরি আইল্যান্ড। বকখালি থেকেও টোটো বা ভ্যান বুকিং করে হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়া যায়। টোটো বা ভ্যান যাই হোক হেনরি আইল্যান্ড পোঁছাতে কমবেশি চল্লিশ টাকা খরচ পড়ে। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী শিয়ালদা থেকে দুপুর ১ টা ৩০ মিনিটে এবং রাত ৯টা ৩০ মিনিটে দুটি নামখানাগামী ট্রেন ছাড়ে যা যথাক্রমে বিকেল ৪টে ২ মিনিট এবং রাত ১২টা ১৫ মিনিটে নামখানা পৌঁছায়। তবে সাধারণত ভোর ৪টে থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দেড় থেকে দুই ঘন্টা অন্তর শিয়ালদা-নামখানা লোকাল চলে। এছাড়া রেলপথে আসতে না চাইলে ধর্মতলা থেকে বকখালিগামী যে কোনো বাসে উঠে বকখালিতে নেমে সেখান থেকে টোটো ভাড়া করে নেওয়া যেতে পারে হেনরি আইল্যান্ডে পৌঁছানোর জন্য। ধর্মতলার বকখালিগামী বাস ভোর ৬টা থেকে শুরু করে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলে সাধারণ সময়ে। বিলাসবহুল বাসের ভাড়া কমবেশি চারশো টাকা। কেউ ইচ্ছে করলে নিজস্ব গাড়িতেও আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে কলকাতা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের এই হেনরি আইল্যান্ড যাওয়ার জন্য সড়কপথে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে জোকা, আমতলা, ডায়মন্ড হারবার পেরিয়ে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হয়ে সোজা বকখালি হয়ে এখানে পৌঁছে যাওয়া যাবে। হেনরি আইল্যান্ডের প্রবেশদ্বারে দশ টাকা করে প্রবেশমূল্য লাগে যা কিনা বাইক বা গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

হেনরি আইল্যান্ডে থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য দপ্তরের দুটি সুন্দর ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে এখানে – সুন্দরী ও ম্যানগ্রোভ ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স। ২০২০ সালের তথ্যানুসারে সুন্দরী ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের ভাড়া নন-এসির জন্য মাথাপিছু ১০০০ টাকা এবং আর এসি ঘরের জন্য ভাড়া ১২০০ টাকা। মূল ভাড়ার সঙ্গে ১২ শতাংশ জি.এস.টি অতিরিক্ত দিতে হয়। অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের ঘর ভাড়া এসির জন্য ১৬০০ টাকা আর নন-এসি রুমের জন্য ভাড়া ১৪০০ টাকা। এর সঙ্গেও একইভাবে ১২ শতাংশ জি.এস.টি দিতে হয়। দুটি কমপ্লেক্সই অনলাইনে ৫৯ দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য দপ্তর থেকে বুকিং করা যায়। স্পট-বুকিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো। এছাড়া কেউ চাইলে বকখালিতেও বিভিন্ন হোটেলে থেকে হেনরি আইল্যান্ড ঘুরে আসতে পারেন।
হেনরি আইল্যাণ্ডে গেলে দেখা যাবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সমুদ্র সৈকত আর পরিযায়ী পাখিদের। এই দ্বীপের বিশেষ দ্রষ্টব্য এগুলিই।
সমুদ্র সৈকত : বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দ্বীপ হেনরি আইল্যান্ড নিরিবিলি শান্ত একটি সমুদ্র সৈকত। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় দ্বীপের সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল সৈকতের একেবারে সামনে চলে আসে। আবার ভাটার সময় সমুদ্র সরে যায় অনেক দূরে। কাচের মতো পরিস্কার সমুদ্রের জলে ঝিনুক, কাঁকড়ারও দেখা মিলতে পারে। কিন্তু এখানে সমুদ্রে স্নান করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এমনকি সন্ধ্যেবেলায় সমুদ্রের ধারে না থাকার পরামর্শই দেওয়া হয়।
ম্যানগ্রোভ অরণ্য : হেনরি আইল্যান্ড সুন্দরবনেরই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ হওয়ায় এখানে ৬০০ একর জায়গা জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া গাছের সমারোহ রয়েছে। কাদা থেকে শ্বাসমূলগুলি জমির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই অফুরন্ত সবুজের সমারোহ মনকে কোথাও শান্ত করে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। শীতকালে এখানে নানা দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে।

মৎস্য প্রকল্প : এই দ্বীপের খ্যাতির কারণ মূলত এখানকার মৎস্য প্রকল্প। এখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৮০টি মাছের ভেড়ি আছে যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের চাষ করা হয়।
ওয়াচ টাওয়ার : দুটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে এখানে যার মধ্যে একটি সুন্দরী রিসর্ট সংলগ্ন এবং এর উচ্চতা ১১৫০ ফুট। এখান থেকে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সবুজের সমারোহ খুব ভালো করে উপভোগ করা যায়। সমস্ত দ্বীপটিকে পাখির নজরে দেখতে হলে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
এছাড়া সাইটসিইং করতে গেলে এখান থেকে খুব কাছেই ঘুরে আসা যায় জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত বকখালি, মৎস্য বন্দর ফ্রেজারগঞ্জ ও জম্বুদ্বীপ।
হেনরি আইল্যান্ড ঘোরার আর্দশ সময় শীতকাল। এই সময় পরিযায়ী পাখিরাও এখানে আসে। আবহাওয়া সেই সময় খুবই মনোরম থাকে। যদিও সারা বছরই এখানে আসা যায়। কিন্তু গরমকালে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে পর্যটকদের অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়।
এখানে যেহেতু মাছের ভেড়ি রয়েছে সেই কারণে এখানকার হোটেলে বিভিন্ন ধরনের মাছের পদগুলি ভীষণ লোভনীয়। মাছ ছাড়াও কাঁকড়ার নানা পদ এখানকার ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে পাওয়া যায়। শীতকালে এই অঞ্চলের মানুষেরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে খেজুর গুড় তৈরি করেন। ইচ্ছে করলে এদের থেকে টাটকা খেজুর গুড় সংগ্রহ করতে পারেন।
ট্রিপ ট্রিপস
- কীভাবে যাবেন – সবথেকে সহজে ট্রেনে আসতে চাইলে শিয়ালদা থেকে নামখানা লোকাল ধরে নামখানা স্টেশনে নেমে অটো বা টোটো করে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজ ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় হেনরি আইল্যান্ড। ধর্মতলা থেকে বাসও আছে এখানে আসার, তবে বাসে এলে নামতে হবে বকখালি। তারপর টোটো বা অটোয় চেপে হেনরির দ্বীপ। সড়কপথে নিজস্ব গাড়িতে গেলে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে জোকা, আমতলা এবং সবশেষে ডায়মন্ড হারবার পেরিয়ে হাতানিয়া দোয়ানিয়া ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হয়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যাবে হেনরি আইল্যান্ড।
- কোথায় থাকবেন – হেনরি আইল্যান্ডে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের সুন্দরী ও ম্যানগ্রোভ ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স নামে দুটি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স রয়েছে। । তাছাড়া বকখালিতেও কোন হোটেলে থাকা যেতে পারে।
- কী দেখবেন – সবুজ ম্যানগ্রোভ অরণ্য, মৎস্য প্রকল্প, হেনরি আইল্যান্ডের সমুদ্র সৈকত, ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমস্ত দ্বীপের মনোরম শোভা এই দ্বীপের বিশেষ দ্রষ্টব্য। তাছাড়া আশেপাশের ফ্রেজারগঞ্জ, জম্মু দ্বীপ কিংবা বকখালির সমুদ্র সৈকতও ঘুরে আসা যায় সাইটসিইং হিসেবে।
- কখন যাবেন – বছরের যে কোনো সময় হেনরি দ্বীপ যাওয়া যায়। তবে গরমকাল বাদ দিয়ে গেলেই ভালো। শীতকাল আদর্শ সময়।
- সর্তকতা –
- হেনরি আইল্যান্ড নির্জন একটা দ্বীপ।
- বিকেল চারটের পরে সমুদ্র সৈকতে যাওয়া নিষিদ্ধ। যারা আগে থেকেই সৈকতে থাকবেন তাদের বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে হোটেলে চলে আসতে হবে।
- খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো হোটেল ছাড়া অন্য কোথাও মাছের কোনো পদ বা সমুদ্রের ধারে মাছ ভাজা না খাওয়াই ভালো।
- বিশেষ পরামর্শ
- বকখালি থেকেও হেনরি আইল্যান্ড ঘুরে আসা যায়। তবে এখানে একটা গোটা দিন থেকে ঘুরলে ভালোভাবে ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করা যায়।
2 comments