
পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ জঙ্গল হল সুন্দরবন। এই জঙ্গলে অবস্থিত ‘সুন্দরী’ গাছের নাম থেকেই এই জঙ্গলের নাম হয়েছে বলে অনুমান করা হয় ৷ এখানেই সেই মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের (Royal Bengal tiger) দর্শন মেলে। এই বাঘের সন্ধানেই দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এসে ভিড় জমায় এখানে। আমরা সাধারণভাবে সুন্দরবন বললেও ইউনেস্কোর সাইটে এই জায়গাটি “সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান” নামেই লিপিবদ্ধ করা আছে।
দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের দুই ২৪ পরগণা জেলায় সুন্দরবনের অবস্থান৷ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বলেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সুন্দরবনের সীমানা। সুন্দরবনের নদীগুলোয় একাধারে নোনা জল ও মিষ্টি জল দুইই দেখা যায়।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মুঘল আমলে আনুমানিক ১২০৩ সাল থেকে ১৫৩৮ সালে স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নিয়েছিলেন৷ পরে যখন নতুন নিয়ম আসে, তখন বিশ্বের প্রথম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে স্বীকৃতি পায় । ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরি হয়। ১৯৮৪ সালের ৪ মে এটি জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়। ১৯৮৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (UNESCO World Heritage Site) হিসাবে ঘোষিত হয়।
জঙ্গল আর নদী বা সাগরের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী আর খাল। ধারে জঙ্গল। এই জঙ্গলের গাছে বিভিন্ন বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান কেওড়া। সুন্দরী ও গেওয়া এর প্রাধান্যের পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে ধুন্দল এবং কেওড়া। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে শন, নল খাগড়া, গোলপাতা রয়েছে সুবিন্যস্তভাবে। এখানের ‘সুন্দরী’ গাছের নাম থেকেই এই জঙ্গলের নাম সুন্দরবন হয়েছে বলে অনুমান করা হয় ৷ সুন্দরবনের চারপাশে রয়েছে ঘন ম্যানগ্রোভ। সেখানে এসে ঝড় ধাক্কা খায়। ফলে সুন্দরবনের ভিতরে ঝড়ের গতিবেগ থাকে না। ঘূর্ণিঝড়ের হামলা ঠেকাতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য কলকাতা-সহ গোটা বঙ্গীয় উপকূলের ঢাল হিসেবে কাজ করে।

এখানেই মানুষখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বাস। তবে বিভিন্ন নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়ায় বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর খবর বর্তমানে শোনা যায়না। সুন্দরবনে বাঘ দক্ষিনরায় দেবতা নামে পূজিত হয়। আবার বাঘের আক্রমণের থেকে বাঁচতে স্থানীয় মানুষেরা বনবিবির পূজা করে। হিন্দু-মুসলমান ধর্ম নির্বিশেষে বনবিবির পূজা করে এখানে। বাঘ যেহেতু সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে সেহেতু জেলে এবং কাঠুরেরা মাথার পেছনে মুখোশ পরে। তবে স্থানীয় মানুষদের থেকেই জানা যায় এই ব্যবস্থা স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও পরে বাঘ এ কৌশল বুঝে ফেলে।
সুন্দরবনে শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি বাগদা, গলদা ও কাঁকড়া প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তবে এখানে সবচেয়ে পরিচিত মাছ পারশে মাছ। সুন্দরবনের খাঁড়িতে নানা জাতের মাছ ধরে জীবিকা চালায় অসংখ্য মৎস্যজীবী। বাঘ ছাড়াও এখানে বিচরণ করে কুমির, কাছিম, শুশুক, এবং নানাবিধ পরিযায়ী পাখি।
২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবন যেতে গেলে প্রথমেই আসতে হবে গদখালি। সেখান থেকে লঞ্চে করে যেতে হবে সুন্দরবনে। কলকাতা থেকে যদি ট্রেনে করে আসতে হয়, তাহলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ক্যানিংগামী ট্রেন ধরতে হবে। ক্যানিং এ নেমে টোটো, অটো বা ট্যাক্সি করে গদখালি। সেখান থেকে লঞ্চে করে আপনি ঘুরতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আগে থেকে লঞ্চ ভাড়া করে রাখা ভালো। কলকাতা থেকে সড়কপথে এলে এসপ্ল্যানেড বাস ডিপো থেকেও ক্যানিং আসা যায়, তারপর সেখান থেকে আগের মতই গদখালি। কেউ যদি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসতে চান তাহলে গদখালি অবধি গাড়িতে যেতে পারেন৷
সুন্দরবনের পাখিরালয়, দয়াপুর এলাকায় প্রচুর বেসরকারি লজ,হোটেল এবং বর্তমানে রিসোর্টও গড়ে উঠেছে। এছাড়া সজনেখালিতে আছে সরকারি পর্যটন আবাস এখানে সেখানে থাকতে হলে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের ওয়েবসাইটে আগে বুকিং করতে হবে ৷ তবে সুন্দরবনে বেড়াতে আসা অনেক মানুষেরাই সমুদ্রের বুকে লঞ্চ ভাড়া করে থাকতে ভালোবাসেন৷ সেই ব্যবস্থাও এখানে আছে৷ তবে লঞ্চ ভাড়া করতে গেলে আগে বুকিং করে রাখতে হবে৷ পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসাই যায় তবে খুব বেশী বয়স্ক এবং শিশুদের জন্য একটু সমস্যা দেখা যেতে পারে৷ যেসব মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী তাদের জন্য খুবই উপভোগ্য জায়গাটি। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধব সহযোগে দলবদ্ধ ভাবে মানুষজনকে ঘুরতে দেখা যায়। সাধারণ থেকে দামি সব রকমের থাকার জায়গা এখানে পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী তিন দিন সুন্দরবনে ঘুরতে মাথা পিছুত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।

এখানে আগত পর্যটকেরা মূলত এখানের বাঘ মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখতে আসেন৷ যদিও বাঘ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। এখানের দর্শনীয় স্থানগুলি হল, গোসাবায় হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলো, বেকন বাংলো, পাখিরালয়, সজনেখালি ওয়াচ টাওয়ার, মিউজিয়াম, কচ্ছপ পুকুর, কুমীর পুকুর, সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার, দোবাঁকি ওয়াচ টাওয়ার, নেতিধোপানি ওয়াচ টাওয়ার, গাজিখালি, পিরখালি,সোনাখালি, পঞ্চমুখানি, বনবিবি ভারানি সহ আরও একাধিক দ্রষ্টব্য স্থান। বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ারে এসে চুপচাপ বসে দুরের জঙ্গল দেখা যায়। এখানে এসে পর্যটকেরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে থাকেন, যদি কোন জন্তু এসে তাঁদের চোখে বা ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
সুন্দরবন সফর মানে বেশিরভাগটাই কিন্তু লঞ্চে করে নদীর বুকে ভ্রমণ। এই নদীর বুকে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটাই সুন্দরবন ভ্রমণের রোমাঞ্চের বিশাল জায়গা। বিশেষ করে মাতলা নদীর বুকে যখন লঞ্চ ছুটে চলে, তখন মাতলার ব্যাপ্তি এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ জোগায় মনে। দূর দূর অবধি জলের সে কি ব্যাপ্তি, আর চারপাশে সবুজ অরণ্য। এর মাঝ দিয়েই ছুটে যাবে লঞ্চ। ভয় আর ভালো লাগা মিশিয়ে এই অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্যরকম। কোন বন্য পশুর দেখা না মিললেও শুধু এইটুকু অভিজ্ঞতার জন্যই সুন্দরবনে আসা যায়, কারণ এই অভিজ্ঞতা লিখে বোঝানো যায় না। আর এই যাওয়া-আসার পথেই নদীর পাড়ে জঙ্গলের ধারে যদি বাঘের দেখা মেলে তাহলে তো কথাই নেই। দেখা মিলতে পারে কুমীরেরও। আর হরিণ, বন্য শূকর, গোসাপ বা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা তো সব সময়েই মেলে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা মেলে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের, তবে এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। এখানে এসেই চেঁচামিচি করবেন না। পাখিরালয়তে বিকেল বেলায় ভিড় জমায় কত পাখি। লঞ্চে করে ঘুরে আসুন।

সুন্দরবন অঞ্চলের শোভা বিকশিত হয়ে ওঠে বর্ষাকালে৷ বর্ষায় সমুদ্র এবং জঙ্গল অন্য রূপে ধরা পরে৷ তবে জঙ্গল অঞ্চলে বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো৷ ২০১৫ সালের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্ষাকালের সময় জঙ্গল বন্ধ থাকে। শীতকাল এখানে ভ্রমণের জন্য বিশেষ উপযোগী। পর্যটকেরা এই সময়ই ঘুরতে আসেন।
খাওয়ার জন্য আলাদা কোন হোটেল নেই। যে হোটেল বুক করবেন সেখানেই খাওয়া দাওয়া করুন। হোটেলে আগে থেকে পছন্দের খাবার বলে রাখতে পারেন। বিভিন্ন মাছের রান্না খুব ভালো করে। তবে সঙ্গে নিজের জল রাখলে ভালো হয়। এই অঞ্চলের জল ঘোলাটে হয়ে থাকে।
এই অঞ্চলে কখনই গাইড ছাড়া বা দলছুট হয়ে একা না ঘোরাই শ্রেয়৷ বন্য জন্তুর আনাগোনা সর্বদাই এখানে লক্ষ করা যায়৷ সকলে দলবদ্ধ হয়ে ঘুরতে যাওয়া উচিত। এবং ঘোরার পর হোটেলে বা লজে ফিরে সেখানেই থাকা উচিত। একা হোটেলের বাইরে যাওয়া উচিত না। সুন্দরবনে ঘোরার জন্য নদীর বুকে লঞ্চে করে ঘোরানো হয়। কখনই লঞ্চে করে ঘোরার সময় জলে পা ডোবাবেন না। আবার লঞ্চে করে ঘোরার সময় কখনই নৌকার একদিকে সকলে এসে দাঁড়াবেন না। লঞ্চ উল্টে যেতে পারে।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেন – সুন্দরবন যেতে গেলে প্রথমেই আসতে হবে গদখালি। সেখান থেকে লঞ্চে করে যেতে হবে সুন্দরবনে। ট্রেনে করে আসলে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ক্যানিংগামী ট্রেন ধরতে হবে। ক্যানিং এ নেমে টোটো, অটো বা ট্যাক্সি করে গদখালি। সেখান থেকে লঞ্চে করে আপনি ঘুরতে পারেন। সড়কপথে এলে এসপ্ল্যানেড বাস ডিপো থেকেও ক্যানিং আসা যায়, তারপর সেখান থেকে আগের মতই গদখালি। কেউ যদি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসতে চান তাহলে গদখালি অবধি গাড়িতে যেতে পারেন৷
- কোথায় থাকবেন – সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের অনেকেই লঞ্চে রাত্রি যাপন করতে পছন্দ করেন। এ ছাড়াও সুন্দরবনের পাখিরালয়, দয়াপুর এলাকায় প্রচুর বেসরকারি হোটেল, লজ রয়েছে।
- কি দেখবেন – সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকা, পাখিরালয়, সজনেখালি ওয়াচ টাওয়ার, মিউজিয়াম, কচ্ছপ পুকুর, কুমীর পুকুর, সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার, দোবাঁকি ওয়াচ টাওয়ার, নেতিধোপানি ওয়াচ টাওয়ার, গাজিখালি, পিরখালি, পঞ্চমুখানি, বনবিবি ভারানি সহ আরও একাধিক দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে৷
- কখন যাবেন – বর্ষাকাল অবশ্যই বাদ দিন। শীতকাল এখানে ভ্রমণের জন্য বিশেষ উপযোগী।
- সতর্কতা-
- কখনোই একা ঘুরতে বেরোবেন না। সবসময় দলে ঘুরতে বেরনো ভালো।
- লঞ্চে করে ঘোরার সময় জলে পা ডোবাবেন না।
- লঞ্চে করে ঘোরার সময় কখনই নৌকার একদিকে সকলে এসে দাঁড়াবেন না। লঞ্চ উল্টে যেতে পারে।
- বিশেষ পরামর্শ – এখানের পরিবেশ উপভোগ করতে চাইলে প্রথমেই অযথা হইহল্লা বন্ধ করতে হবে। তা না করে বরং গাইউ এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বললে অনেক অজানা রোমাঞ্চকর তথ্য জানতে পারবেন।
তথ্যসূত্র
- নিজস্ব প্রতিনিধি
- https://ebela.in/
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://whc.unesco.org/
- https://sundarbanhouseboat.com/
One comment