গাইবান্ধা জেলা

গাইবান্ধা জেলা

বাংলাদেশ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। বেশিরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেইরকমই একটি জেলা হল গাইবান্ধা জেলা (Gaibandha)।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত রংপুর জেলার একটি অংশ হল গাইবান্ধা জেলা। একসময় এই জেলা ভবানীগঞ্জ মহকুমা নামে পরিচিত হলেও আশির দশকে এই নাম পাল্টে হয় গাইবান্ধা জেলা। ব্রিটিশ আমলে এই জেলার পাতিলাদহ অঞ্চলটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির আওতাধীন ছিল। গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্যই কেবল বিখ্যাত নয়, রসমঞ্জরী নামক একটি অতি সুস্বাদু মিষ্টির জন্যও এই জেলা প্রসিদ্ধ।

এই জেলার উত্তরে কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলা, দক্ষিণে বগুড়া জেলা, পশ্চিমে  জামালপুর, কুড়িগ্রাম জেলা ও রংপুর জেলা এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ অবস্থিত। এই জেলার মধ্যে দিয়ে যেসমস্ত নদী প্রবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ঘাঘট এবং ব্রহ্মপুত্র। গাইবান্ধা জেলার আয়তন ২১৭৯.২৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে, গাইবান্ধা জেলার জনসংখ্যা ২৫, ৬২,২৩২, যার মধ্যে ১২,৩৮,৬২১ জন পুরুষ, ১৩,১৭,৯৪৪ জন মহিলা এবং ১৯৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। গ্রাম এবং শহরের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, গ্রামের জনসংখ্যা ২১,৬০,৮৬২ যেখানে শহরের জনসংখ্যা ৩,৯৫,৮৯৮।

গাইবান্ধা জেলার নামকরণ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। একটি মতানুসারে, প্রাচীনকালে রাজা বিরাট নামের এক হিন্দু রাজার রাজধানী ছিল অধুনা গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায়। মহাভারতে এই বিরাট রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে রাজা বিরাটের নাকি প্রায় ষাট হাজার গরু ছিল যাদের মধ্যে থেকে অনেক গরুই ডাকাতরা লুট করে নিয়ে যেত। ডাকাতদের হাত থেকে তাঁর গরুদের রক্ষা করার জন্য রাজা বিরাট একটি বিশাল গো-শালা  স্থাপন করেন। এই গো-শালাটি নদী তীরবর্তী স্থানে তৈরি করা হয়েছিল যাতে গরুগুলির খাদ্য ও জলের অভাব না হয়। গরুগুলিকে এখানে বেঁধে রাখা হত যাতে তারা পালিয়ে না যেতে পারে। গরু অর্থাৎ ‘গাই’, বেঁধে রাখা অর্থাৎ বাঁধা অবস্থা সেখান থেকে ‘বান্ধা’। এই দুই শব্দ মিলেই এই জেলার নাম গাইবান্ধা হয়েছে বলে জনশ্রুতি প্রচলিত। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা এই জনশ্রুতিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের মতে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ‘গাইবান্ধা’ নামে কোনো এলাকার উল্লেখ নেই। যার অর্থ ষোড়শ শতক অবধিও এই জেলার নাম গাইবান্ধা হয়নি। সুতরাং গরু বাঁধা থেকে গাইবান্ধা নামকরণ হয়েছে এই যুক্তি নিতান্তই মনগড়া বলে তাঁদের দাবী। সেই হিসেবে গাইবান্ধা নাম কীভাবে হল সে সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়না।

গাইবান্ধা নামের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এই জেলার সঙ্গে ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না। এই বিবৃতিটি বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং এবং টলেমির জ্যোতির্বিদ্যা বইয়ে এই এলাকার  উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি জলের নীচে ছিল যা সময়ের সাথে সাথে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর পলি দ্বারা ভরাট হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনে রংপুরের কালেক্টর ই.জি গ্লেজিয়ারের ১৮৭৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, আজকের গাইবান্ধায় তিনটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে দুইটি গোবিন্দগঞ্জ এবং সাদুল্লাপুর ইদ্রাকপুর পরগণায় এবং অন্যটি পাতিলাদহ পরগণায় ভবানীগঞ্জ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই জেলার পাতিলাদহ অঞ্চলটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির আওতাধীন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতিও জড়িয়ে আছে এই জেলার সাথে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ইতিহাস গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। 

১৯৮৪ সালে গাইবান্ধা জেলা হিসেবে স্বীকৃত হয়। মোট যে সাতটি উপজেলা নিয়ে এই জেলাটি গঠিত। সেগুলি হল – ফুলছড়ি উপজেলা, গাইবান্ধা সদর উপজেলা, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা, পলাশবাড়ী উপজেলা, সাদুল্লাপুর উপজেলা, সুঘাটা উপজেলা এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। 

গাইবান্ধা জেলার আয়ের প্রধান উৎসই হল কৃষি। এখানে উৎপাদিত প্রধান ফসলগুলি হল, ধান, গম, পাট, আখ, আলু, বেগুন, সরিষা, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন এবং অন্যান্য কয়েকপ্রকার শাকসবজি। পাট প্রধানত গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী এবং এই জেলার উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আউশ ধান ও তামাকের উৎপাদন অনেক কমে গেলেও গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে কলার উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এছাড়াও এখানে কৃত্রিম গবাদি পশু প্রজনন কেন্দ্রও রয়েছে আটটি।

গাইবান্ধা জেলার ভ্রমণস্থানের তালিকা অপূর্ণই থেকে যায় যদি তালিকার শুরুতেই রাজাবিরাট প্রাসাদের উল্লেখ না থাকে। এটিকে একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন বলা চলে। এছাড়াও অন্যান্য ভ্রমণের স্থানের মধ্যে রয়েছে নলডাঙ্গা জমিদার বাড়ি, বামনডাঙ্গা জমিদার বাড়ি,রামপাল নির্মিত বর্ধন কুঠি, সৈয়দ ওয়াজেদ আলী নির্মিত শাহ সুলতান গাজীর মসজিদ, ইত্যাদি।

বহু কৃতী মানুষের জন্ম এই গাইবান্ধা জেলায়। এই জেলার তেমনই কয়েকজন বিখ্যাত মানুষ হলেন, শাহ আবদুল হামিদ (বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার), আহমেদ হোসেন (রংপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কৃষি, বন ও মৎস্যমন্ত্রী), আবু হোসেন সরকার (১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৫৬ সালে সম্মিলিত পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী) প্রমুখ।

লোকসংস্কৃতির বিবিধ ধারা আজও এই জেলার চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। পল্লী গীতি, ভাওয়াইয়া, জারিগান, সারিগান, ছরাগান এবং বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিভিন্ন লোকসংগীত এখানে প্রচলিত। এছাড়াও এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায় বিবাহ অনুষ্ঠান, সন্তানের জন্ম ইত্যাদি উপলক্ষে বিভিন্ন গান ও নৃত্য প্রদর্শন করে থাকে। 

গাইবান্ধা জেলার খাবারের মধ্যে বিখ্যাত হল এখানকার রসমঞ্জরী মিষ্টি।

One comment

আপনার মতামত জানান