চাঁদপুর

পশ্চিমবঙ্গের চাঁদপুর ভ্রমণ

 চাঁদপুর সমুদ্রসৈকত
চাঁদপুর সমুদ্রসৈকত

সমুদ্র নাকি পাহাড় এই দ্বন্দ্ব ভ্রমণপিপাসু বাঙালিকে চিরকাল ভাবিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রকে বেছে নিলে সনাতন দীঘা-পুরী তো হাতের তালুর মত চেনা প্রত্যেক বাঙালির। কথায় আছে দী-পু-দা অর্থাৎ দীঘা, পুরী, দার্জিলিং বাঙালির ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। এখন দিঘা পুরী ছাড়াও আরো কিছু সমুদ্র সৈকতে বাঙালির ভিড় বেড়েছে, ভ্রমণের লিপ্সায় বাঙালি খুঁজে নিয়েছে দীঘার সমান্তরালে মন্দারমনি, তাজপুর, শংকরপুরের মত মনোরম সমুদ্রসৈকত। তবে এই তালিকায় চাঁদপুর একেবারে অভিনব। গোধূলিবেলার রক্তিম সূর্য আর নীচে শালকাঠের খুঁটি দিয়ে ঘেরা সজীব সমুদ্র যে কোনো মানুষকে রোম্যান্টিক করে তুলবে। নিত্যদিনের রুটিন ভেঙে এক-দুদিনের ছোট্ট ট্রিপে সোজা চাঁদপুরে নামলেই ভিড় থেকে মুক্তি। নোনা জলের ডাক উপেক্ষা করে কার সাধ্যি!

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম নতুন এবং অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল সমুদ্র সৈকত হল চাঁদপুর। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমায় দীঘার অনতিদূরেই তাজপুর এবং শংকরপুরের ঠিক মাঝখানে চাঁদপুর সমুদ্রসৈকতের অবস্থান। কলকাতা থেকে ১৭০ কিমি দূরের এই চাঁদপুর সমুদ্রসৈকত একেবারেই কোলাহল বর্জিত। যদি আমরা চাঁদপুর অঞ্চলের ম্যাপ বুঝতে চাই, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশার দিকে পরপর সমুদ্রের জায়গাগুলো হল যথাক্রমে বাঁকিপুট, জুনপুট, মন্দারমনি, তাজপুর মোহনা, তাজপুর, চাঁদপুর, শঙ্করপুর,  দীঘা মোহনা, ওল্ড দীঘা, নিউ দীঘা, উদয়পুর, তালসারি (এটি ওড়িশার সমুদ্রসৈকত)। বকখালি এবং সেই সংলগ্ন সমুদ্রসৈকত গুলো আলাদাভাবে যেতে হয় বলে সেই তালিকায় এদের সাথে জোড়া হল না।

 সমুদ্রের ভাঙন আটকাতে একাধিক স্তরে গাছের গুঁড়ি ও পাথর দিয়ে  তৈরি  বাঁধ
সমুদ্রের ভাঙন আটকাতে একাধিক স্তরে গাছের গুঁড়ি ও পাথর দিয়ে তৈরি বাঁধ

শোনা যায় বিখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর থাকাকালীন চাঁদপুর পরিদর্শক বাংলোতে আসতেন তাঁর ঘোড়ায় চেপে। কিন্তু সেই বাংলো এখন সমুদ্রের গহ্বরে। ক্রমাগত ভাঙনের ফলে প্রায় ৩ কিমি সমুদ্রতট জলের গভীরে চলে গেছে৷ খুব সামান্য ঐতিহাসিক সংযোগ থাকলেও সেই ইতিহাসের অভিজ্ঞতা লাভের কোনো সুযোগ আর এখন নেই ৷ তবে এই কথা লোকমুখে প্রচলিত।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তবে সমুদ্র ভাঙনের তথ্য অবশ্যই সত্য। সেই ভাঙনকে আটকাতে একাধিক স্তরে বড় বড় বোল্ডার আর শালকাঠের খুঁটি দিয়ে তটভূমির ভাঙন রোধ করা হচ্ছে এই সৈকতে। সমুদ্রে জোয়ার থাকাকালীন সৈকত বলে আলাদা কিছু থাকেও না। সবকটা স্তরই জলে ভরে থাকে। তবু এটাই যেন এর স্বাভাবিক লাবণ্য। সৈকতের ধার ঘেঁষে সুন্দর সড়ক চলে গেছে। সড়কের একপাড়ে যেমন বোল্ডার দিয়ে ঘেরা নীল সমুদ্র, অন্যপাড়ে তেমন সবুজের সমাহার। এই দৃশ্যই কার্যত মন্দারমনি, তাজপুর বা দীঘা থেকে চাঁদপুরকে আলাদা করেছে। একদিকে ঘন সবুজের সমাহার আর অন্যদিকেই অসীম লবণাক্ত জলরাশি – এই দুয়ের সমাহার এই চাঁদপুরেই দেখতে পাওয়া যাবে। সর্বোপরি অতিরিক্ত জনসমাগম চাঁদপুরের সমুদ্রসৈকতকে এখনো কলুষিত করেনি। নির্জন সৈকতে জ্যোৎস্নার শোভা উপভোগ করতে চাঁদপুরে আসতেই হবে।

 সমুদ্রের ভাঙন আটকাতে একাধিক স্তরে গাছের গুঁড়ি ও পাথর দিয়ে  তৈরি  বাঁধ
সমুদ্রের ভাঙন আটকাতে একাধিক স্তরে গাছের গুঁড়ি ও পাথর দিয়ে তৈরি বাঁধ

ট্রেন হোক বা বাস কিংবা নিজের গাড়ি তিনভাবেই চাঁদপুর যাওয়া যায়। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ট্রেনে করে আসতে চাইলে নামতে পারেন দিঘা বা রামনগর স্টেশনে। চাঁদপুরের নিকটবর্তী রেল স্টেশন রামনগর। রামনগর থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব মাত্র ৮ কিমি। তারপর ট্রেকারে চেপে কয়েক কিলোমিটারের পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যাবে চাঁদপুর। হাওড়া স্টেশন থেকে দিঘাগামী ট্রেন পাওয়া যায়। হাওড়া-দিঘা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস বাদে বাকি সব দিঘাগামী ট্রেনেই রামনগর আসা যায়। তবে ২০২০ সালের কোভিড-পরিস্থিতিতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র হাওড়া-দীঘা কোভিড-স্পেশাল ট্রেন চালু ছিল। ফলত বাস কিংবা গাড়িই ভরসা। ধর্মতলা থেকে দিঘা যাবার অনেক বাস পাওয়া যায়। বাসে এলে নেমে পড়তে হবে বালিসাই মোড়ে। সেখান থেকে টোটোয় চড়ে চাঁদপুর পৌঁছানো যায়। এই পথেই বোল্ডার নিয়ে যাওয়া হয় বলে এই পথ একটু ভাঙাচোরা। গাড়ি থাকলে বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে ধরতে হবে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে। তারপর বালিসাই মোড় পেরিয়ে যেতে যেতে তাজপুর ছাড়ালেই পাওয়া যাবে চাঁদপুর। গাড়িতে কলকাতা থেকে ১৭০ কিমি পথ যেতে কম বেশি চার ঘন্টা লাগে।

এখানে যেহেতু লোকজনের আনাগোনা তুলনায় কম তাই হোটেল বা হোম স্টে খুব বেশি নেই। সাধারণত তাজপুর থেকে চাঁদপুরে ভ্রমণে আসে লোকজন। কিন্তু শুধুমাত্র চাঁদপুরের আস্বাদ পেতে থাকতে হবে চাঁদপুরেই। সেজন্য এখানে কিছু কিছু ভালো হোটেল আছে যেমন হোটেল মুন, হোটেল রাই ইত্যাদি। এছাড়াও চাঁদপুরের পরিচিত একটি রিসর্ট হল চাঁদপুর ভিলেজ ইকো রিসর্ট। এছাড়া বিচের কাছে তাঁবু খাটিয়ে অভিযাত্রীর উপলব্ধি পেতে চাইলে থাকতে হবে চাঁদপুর ইকো ক্যাম্পে। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হোটেল ভাড়া মোটামুটি প্রতিদিন ১০০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।

নির্জন সৈকতে একান্তে সময় কাটানোর মুহূর্তগুলি চাঁদপুরে এসে চূড়ান্তভাবে উপভোগ করবেন। বন্ধুবান্ধব মিলেও এখানে এসে বেশ উপভোগ করা যায় সমুদ্র। সকালবেলায় সমুদ্রতটের বালিরাশির উপর দিয়ে পায়ের ছাপ ফেলে নোনা হাওয়া গায়ে মেখে হেঁটে আসা যায় আশেপাশে। সমুদ্রের পাড়ে প্রচুর ঝিনুকের খোলা পড়ে থাকে, সেগুলোও অনেকে কুড়োতে পছন্দ করে। ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতেই সময় কেটে যায় অনেকসময়। সৈকতের ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া সুদৃশ্য রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যায় শঙ্করপুর। এ এক আলাদা আনন্দ। সমুদ্রের জল জোয়ারের সময় বোল্ডার পেরিয়ে উপচে পড়ে। ভাটার সময় কাঠের গুঁড়ি পেরিয়ে চলে যায় বেশ কিছু দূরে। তখনই সমুদ্রসৈকতের দেখা মেলে। এখানে সমুদ্রে স্নান করতে হলে সেই সময় স্নান করাই ভালো।

জোয়ার থেকে ভাটায় সমুদ্রের জলের অবস্থান

জোয়ার থেকে ভাটায় সমুদ্রের জলের অবস্থান

চাঁদপুর থেকে ৩০ কিমির মধ্যেই ঘুরে আসা যায় দীঘা, তাজপুর কিংবা শঙ্করপুর। চাঁদপুর থেকে গাড়িতে দীঘা মাত্র ৩০ মিনিটের পথ। চাঁদপুরের কাছাকাছি অবস্থিত শঙ্করপুরের কাছেই রয়েছে বিরাট মাছের বাজার, সস্তায় টাটকা সামুদ্রিক মাছ পেতে গেলে শঙ্করপুর আসা যায়। চাঁদপুরের সমুদ্রসৈকতের বিপরীতে সড়কপথ ধরে চলে যাওয়া যায় মন্দারমণি, চাঁদপুরের অনতিদূরে বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভ দ্বীপও সময় করে ঘুরে আসা যায়। সুবর্ণরেখার মোহনায় তালসারি ব-দ্বীপ আর উদয়পুরের অপূর্ব সূর্যাস্তের শোভা উপভোগ করা যায়। চাঁদপুর থেকে খুবই কাছে তাজপুরের সমুদ্রসৈকত যেখানে এসেও অনেকে সমুদ্রস্নানের আমেজ নেয়।

যেকোনো সময়েই চলে আসা যায় চাঁদপুর। তবে বর্ষায় এলে বৃষ্টির আতিশয্যে সমুদ্র দেখার মজাটা মাটি হতে পারে। উপরন্তু বোল্ডার পেরিয়ে যাওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই বৃষ্টির সময়টা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

অন্যান্য সমুদ্রসৈকতের মতোই এখানেও বিশেষ খাবার বলতে পমফ্রেট, চিংড়ির মত সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদির সুস্বাদু রেসিপি রসনা তৃপ্তি ঘটাবেই। হোটেল রাইয়ের কাছেই একটি ঝুপড়ি দোকানে প্রাতরাশ হিসেবে চা ম্যাগি ইত্যাদি পাওয়া যায়। তবে চাঁদপুরের হোটেলগুলিতে খাবার পাওয়া গেলেও লাঞ্চের জন্য তাজপুর চলে আসাই ভালো।

গোধুলিবেলায় চাঁদপুর সমুদ্র
গোধুলিবেলায় চাঁদপুর সমুদ্র

চাঁদপুরে কেনাকাটার আলাদা দোকান বলে কিছুই নেই। কেনাকাটা করতে হলে চলে যেতে হবে সোজা দিঘার সৈকতে। 

চাঁদপুরের সমুদ্র স্নানের জন্য উপযুক্ত নয়। জোয়ার থাকাকালীন যখন জল বোল্ডারগুলো ছাপিয়ে যায়, তখন বোল্ডার আর কাঠের গুঁড়ির বেড়া পেরিয়ে সমুদ্রে নামা মারাত্মক বিপজ্জনক। বোল্ডারে পা পিছলে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে যেকোনো সময়। ভাটার সময়ে সমুদ্র অনেকটা দূরে চলে গিয়ে যখন সমুদ্রসৈকত উন্মুক্ত হয়, সেক্ষেত্রেও সমুদ্রে না নামাই উচিত। প্রথমত এখানের জলে ময়লা অত্যন্ত বেশি। দ্বিতীয়ত এখানে সেইভাবে কেউ স্নান করে না তাই জানাও সম্ভব না কোথাও চোরাবালি আছে কিনা। তাই চাঁদপুরে এসে শুধু সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করাই শ্রেয়। স্নানের আমেজ নিতে চাইলে আসা যেতে পারে মন্দারমনি বা তাজপুরে। হোটেলের বুকিং আগেভাগে করে রাখাই ভালো। যেহেতু বোল্ডার আর কাঠের গুঁড়ির বেড়া পেরিয়ে সমুদ্রসৈকতে যেতে হয় তাই বয়স্ক মানুষ বা বাচ্চাদের জন্য সেটি বিপ্পজ্জনক। দিনের বেলায় সৈকতে গেলেও রাত্রে সমুদ্রের ধারে যাওয়া সমীচীন নয়। এখানে হোটেলের সংখ্যা যেহেতু হাতে গোনা, তাই হোটেল আগে থেকে বুক করে রাখলে সুবিধে হবে। 


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ট্রেনে করে আসতে চাইলে নামা যায় দীঘা বা রামনগর স্টেশনে। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কোভিড পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র হাওড়া-দিঘা কোভিড স্পেশাল ট্রেনই চলছিল। ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বালিসাই মোড়ে নেমে টোটোয় চেপেও আসা যায়। অথবা নিজের গাড়িতে এলেও বালিসাই মোড় থেকেই তাজপুরের রাস্তা ধরতে হবে।
  • কোথায় থাকবেন – চাঁদপুরে হোটেল খুব বেশি নেই। সমুদ্রসৈকতের কাছেই হোটেল মুন, হোটেল রাই রয়েছে। তাছাড়া আছে চাঁদপুর ভিলেজ ইকো রিসর্ট।
  • কি দেখবেন – চাঁদপুর সৈকতের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত অত্যন্ত মনোরম। আর চাঁদপুরের অনতিদূরে তাজপুর, মন্দারমণি কিংবা দিঘা তো আছেই দেখার জায়গা। 
  • কখন যাবেন – মোটামুটিভাবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে চাঁদপুর ঘুরে আসা যায়। তবে সারাবছরই যাবার সুযোগ রয়েছে। বর্ষায় না যাওয়াই ভালো। 
  • সতর্কতা – 
    • স্নানের জন্য চাঁদপুরের সমুদ্র উপযুক্ত নয়৷
    • যেহেতু বোল্ডার আর কাঠের গুঁড়ির বেড়া পেরিয়ে সমুদ্রসৈকতে যেতে হয় তাই বয়স্ক মানুষ বা বাচ্চাদের জন্য সেটি বিপ্পজ্জনক।  
    • হোটেল আগে থেকে বুক করে রাখলে সুবিধে হবে। 

চাঁদপুর নিয়ে একটি ভিডিও দেখুন এখানে

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. http://weekenddestinations.info/
  3. https://tourplannerblog.com/chandpur/
  4. https://www.nomadicweekends.com

One comment

আপনার মতামত জানান