পশ্চিমবঙ্গের খুব কম জায়গাই রয়েছে যার সঙ্গে ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত নেই। মালদা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বীরভূম এমনকি উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, কোচবিহারও ইতিহাসের আখড়া বলা চলে। আর এই ইতিহাসের গন্ধ খুঁজতে ভালো লাগে যাদের, তাদের কাছে মালদার জগজীবনপুর একটি অন্যতম আদর্শ ভ্রমণ স্থান। মালদার গৌড়, আদিনা কিংবা পাণ্ডুয়ার মত জগজীবনপুরও পাল রাজাদের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক অনুষঙ্গের কারণে সমগ্র বাংলায় বিখ্যাত। তাছাড়া বহু বিখ্যাত পাল রাজাদের তাম্রশাসনপত্রও এখানে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সেই কারণেই জগজীবনপুরের খ্যাতি ক্রমবর্ধমান। তাই পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন বিভাগ এবং ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে দপ্তরের পক্ষ থেকে জগজীবনপুরের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ ও তৎসংলগ্ন প্রাঙ্গণের সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে।
মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের অন্তর্গত কেন্দপুকুর স্ট্যান্ড থেকে ১০ কিলোমিটার গ্রামের লাল মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে জগজীবনপুর। অন্যদিকে মালদার ইংরেজবাজার থেকে জগজীবনপুরের দূরত্ব প্রায় ৪১ কিমি.। মালদা স্টেশন থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে এই জগজীবনপুরের অদূরেই বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার সীমান্ত। এর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহানন্দা আর টাঙ্গন নদী।
নবম শতাব্দীর শুরুর দিকে সমগ্র উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশে পাল বংশের শাসন কায়েম ছিল। গাঙ্গেয় সমভূমিতেও পাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। শুধু সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপাল নয়, বরং ইতিহাসের পাতায় পাল রাজা হিসেবে মহীপাল, নয়পাল, বিগ্রহপাল এবং রামপালের নামও সমান গুরুত্ব সহকারে লেখা আছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এর কাহিনীতেই নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল এবং রাজা কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর প্রণয়-পরিণয়ের কথা পাওয়া যায়। তবে পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালের কথা সেভাবে কোথাও উল্লিখিত হয়নি। ১৯৮৭ সালেই একমাত্র এই সম্রাটের ব্যাপারে জানা যায় জগজীবনপুর থেকে এবং তারপর ইতিহাসের আরও এক অনাবিষ্কৃত দিক উন্মোচিত হয়। মহেন্দ্রপালের একটি তাম্রশাসনপত্র, শিলালিপি এবং নন্দদীর্ঘিকা মহাবিহারের প্রাচীন ভগ্নাবশেষ এখান থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। নবম শতাব্দীতে সমগ্র ভারতের মধ্যে এই নন্দদীর্ঘিকা মহাবিহার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হত। ৮৫৪ সালে লিপিবদ্ধ রাজা মহেন্দ্রপালের একটি তাম্রশাসনপত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে তাঁর মহাসেনাপতি বজ্রদেবকে তিনি নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহার সংলগ্ন জমি দান করছেন এবং এতে মহাসেনাপতির নিজেরও সম্মতি রয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ মালদার এক অখ্যাত গ্রামের এক কৃষক জগজীবনপুরের এই অঞ্চলেই চাষ করতে করতে কোদাল মাটিতে আটকে যাওয়ায় খুঁড়তে খুঁড়তে এক প্রাচীন তাম্রশাসনপত্র আবিষ্কার করেন। সেই তাম্রশাসনপত্রে খোদিত ছিল পাল রাজবংশের প্রতীকটিও – একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের ভিতর বৌদ্ধ ধর্মচক্র আর তার উপরে রাজছত্র এবং দুদিকে দুটি হরিণ রয়েছে। সুধীন দে-র তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের একটি দল ১৯৯২ সালে তুলাভিটা ঢিবিতে খনন শুরু করে। তারপরে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালে অমল রায়ের অধীনে ব্যাপক খননকার্যের ফলে ইঁটের তৈরি মহাবিহারের কিছু অংশ আবিষ্কৃত হয় যেখানে মনে করা হয় প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শিক্ষার্থীদের থাকার ঘর, স্নানাগার ইত্যাদি ছিল। যে কৃষক প্রথম এই তাম্রশাসনপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নাম জগদীশচন্দ্র গাঁই। সেই তাম্রশাসনপত্রের পাঠোদ্ধারের ফলে জানা গেছে যে সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে লেখা সেই তাম্রশাসনপত্র আসলে শ্রী মহেন্দ্রপাল দেবের। গৌতম বুদ্ধের উপাসনা এবং ভিক্ষুদের বসবাসের জন্যেই তিনি সেনাপতি বজ্রদেবের সম্মতিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এই জমিটি দান করেছিলেন। কিছুদিন আগে পর্যন্তও ঐতিহাসিকদের ধারণা ছিল নবম শতাব্দীতে পাল সম্রাট দেবপালের পরে বিগ্রহপালই রাজত্ব করতেন বাংলায়, কিন্তু এই তাম্রশাসনপত্র আবিষ্কারের পরে প্রমাণিত হয় যে বিগ্রহপালের আগে মহেন্দ্রপালই ছিলেন পাল রাজবংশের অন্যতম শাসক সম্রাট।
মালদা টাউন স্টেশন থেকে জগজীবনপুরের দূরত্ব মাত্র ৪৬ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও প্রান্ত থেকে মালদাগামী যে কোনও ট্রেনে চেপে মালদা টাউন স্টেশনে নেমে তারপর স্টেশনের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করে জগজীবনপুরে পৌঁছানো যায়। তবে যেহেতু সকালের ট্রেনগুলিতে যেতে গেলে মালদা পৌঁছাতে অনেকটাই বেলা হয়ে যায়, ফলে সেদিন আর ভাল করে ঘোরার সুযোগ থাকে না। তাই যদি রাতের ট্রেন ধরা যায়, তাহলে অনেক ভোরবেলায় মালদা টাউন স্টেশনে নেমে পড়া যায় এবং ঘোরার জন্য একটা গোটা দিন হাতে পাওয়া যায়। স্টেশন থেকে জগজীবনপুর সরাসরি কোনও টোটো বা অটো করে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এখানকার হোটেলগুলির নিজস্ব বাস পরিষেবা রয়েছে যার সাহায্যে সহজেই জগজীবনপুর পৌঁছান যায়। এছাড়া নিজের গাড়ি থাকলে তো খুবই ভাল কথা। তাছাড়া কলকাতা থেকে বাসে করেও মালদা আসা যায়। সেক্ষেত্রে বাসের ভাড়া কমবেশি ৫০০ টাকা মত পড়ে। আর নিজের গাড়ি থাকলে ১২ নং জাতীয় সড়ক দিয়ে কমবেশি ৯ ঘন্টার মধ্যেই মালদা টাউন পৌঁছানো যায়, তারপর নালাগোলা-পাকুয়াহাট মালদা রোড ধরে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জগজীবনপুর চলে আসা যায়।
মালদায় থাকার হোটেলের অভাব নেই। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের অধীনে ‘আম্রপালী ট্যুরিজম প্রপার্টি’ জগজীবনপুরের একটি বিখ্যাত হোটেল। এসির ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। এছাড়াও জগজীবনপুরের আশেপাশে বহু হোটেল আছে বিভিন্ন বাজেটের মধ্যে। তবে স্টেশন থেকে যেহেতু জগজীবনপুরের দূরত্ব খুব বেশি নয়, তাই কেউ চাইলে স্টেশনের আশেপাশেও থাকতে পারেন হোটেলে বা লজে।
জগজীবনপুর ভ্রমণে এলে বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়বে এখানকার খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ভগ্নাবশেষ, বিশালাকার কুয়ো, স্নানাগার এবং ঘরের কাঠামো। জগজীবনপুরের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট টিলা, এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল ৫ মিটার উঁচু তুলাভিটা বা সালাইডাঙা। এছাড়াও অন্যান্য ঢিবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আখড়িডাঙা, নিমডাঙা, রাজার মায়ার ঢিপি এবং নন্দগড়। কিন্তু জগজীবনপুরের এই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সবথেকে আকর্ষণীয় উপাদান হল এখানে খুঁজে পাওয়া একটি বিশালাকার কুয়ো যার নাম মহেন্দ্রপালের শিলালিপিতে পাওয়া যায়, সেটি হল ‘নন্দদীর্ঘিকা’। তুলাভিটা টিলাটি আকারে ৯৪৩২ বর্গমিটার ক্ষেত্রবিশিষ্ট। এখানে মোট ২৬২টি পরিখা রয়েছে যার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৭৮টি পরিখা আবিষ্কৃত হয়েছে। মোট ছয়টি স্তরে এখানে খননকার্য চলেছে। তুলাভিটা ঢিবির খননকার্যের ফলে এর মাঝামাঝি অংশে একটি পোড়া-ইঁটের তৈরি বৌদ্ধবিহারের ভগ্নাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে সেই বিহারের কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকটিই আবিষ্কৃত হয়েছে এখনও পর্যন্ত। এখানে উত্তর-পূর্ব দিকে তিন ধাপ সহ একটি ৩ মিটার প্রশস্ত সিঁড়িও পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গেছে ৬ মিটার পরিধি বিশিষ্ট একটি ইঁটের স্তূপও। এছাড়া এখান থেকে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৭৫ সেমি. উচ্চতার একটি মারীচির ব্রোঞ্জের মূর্তি, শতাধিক পোড়ামাটির সীলমোহর, পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি। স্থানীয় অঞ্চল থেকে খননকার্যের মাধ্যমে ভূমিস্পর্শমুদ্রায় স্থিত বুদ্ধের মূর্তিটিও পাওয়া গিয়েছে। জগজীবনপুর থেকে প্রাপ্ত সকল ঐতিহাসিক উপাদানগুলি কলকাতার বেহালাতে অবস্থিত রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালার জগজীবনপুর গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। তাছাড়া মালদা সংগ্রহশালায় ঘুরে আসতে পারেন যেখানে জগজীবনপুর থেকে আবিষ্কৃত সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সংরক্ষিত রয়েছে। শান্ত, নির্জন বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝে যেন ইতিহাস নিশ্চুপে শুয়ে আছে। পায়ের নীচে ইতিহাসের উষ্ণতা অনুভব করতে করতে শিহরিত হতে পারেন। বেশ কিছুক্ষণ জগজীবনপুরে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন মালদার অন্যান্য বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থানগুলিতে সাইটসিইং করতে। গৌড়, রামকেলি, আদিনা, পাণ্ডুয়া ইত্যাদি সর্বত্রই মসজিদের ছড়াছড়ি। তাই শুধুমাত্র জগজীবনপুর দেখে মালদা থেকে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না, হাতে দু দিন সময় নিয়ে এলে প্রথম দিন জগজীবনপুর আর পরের দিন অন্য সব সাইটসিইং সহজেই করা যায়।
বর্ষাকাল বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময় জগজীবনপুর ভ্রমণে আসা যায়।
ট্রিপ টিপস
- কীভাবে যাবেন – ট্রেনে করে আসতে হলে মালদা টাউন স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা জগজীবনপুরে পৌঁছানো যায়। জগজীবনপুর ঘোরার জন্য বেশ কিছু হোটেলের নিজস্ব গাড়ি পরিষেবা রয়েছে।
- কোথায় থাকবেন – জগজীবনপুরে থাকার জন্য সরকারি, বেসরকারি প্রচুর হোটেল, লজ ইত্যাদি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন বিভাগের অধীনে আম্রপালী ট্যুরিজম প্রপার্টি এক্ষেত্রে একমাত্র সরকারি হোটেল।
- কী দেখবেন – বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে জগজীবনপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, বিশালাকায় কুয়ো, প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ভগ্নাবশেষ, পরিখা ইত্যাদি দেখতেই হবে। এছাড়া কেউ চাইলে মালদার প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা থেকে জগজীবনপুরে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি দেখে আসতেই পারেন। সাইটসিইং করার জন্য গৌড়, পাণ্ডুয়া, আদিনা এবং রামকেলি আদর্শ স্থান।
- কখন যাবেন – বর্ষাকাল বাদে বছরের যে কোনও সময় জগজীবনপুরে আসা যায়।
- সতর্কতা –
- ঘুরতে আসার আগেই হোটেল বুক করে রাখা ভাল।
- নিজে যদি ঘোরার গাড়ির বন্দোবস্ত করতে দ্বিধা থাকে, সেক্ষেত্রে হোটেল বুকিং-এর সময় গাড়ির ব্যাপারে হোটেলের সঙ্গেই কথা বলে নিতে হবে।
- জগজীবনপুর ঘোরার সময় কোনওভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পিকনিক করতে বসে পড়া যাবে না কিংবা কোনওভাবে সেই জায়গা নোংরা করা যাবে না।
- আড়ালে-আবডালে গিয়ে দেওয়ালে খোদাই করে নাম লিখে আসার চেষ্টা করা একেবারেই অনুচিত।