শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে যে সমস্ত সাহিত্যিক তাঁদের নিরন্তর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম যথাযথ গোয়েন্দা কাহিনীর প্রবর্তক। গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অসাধারণ সৃষ্টি। ব্যোমকেশ বক্সীর সৃষ্টিকর্তা হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অধিক পরিচিত।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর নামে এক ছোট্ট শহরে। তিনি মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আদি নিবাস উত্তর কলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চলে। তাঁর পিতার নাম ছিল তারাভূষণ।তারাভূষণ ছিলেন ডাকসাইটে উকিল ।তিনি পূর্ণিয়ায় ওকালতি করতেন। তারাভূষণ বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তারাভূষণ ও সরলা দেবী এক সঙ্গে গান শিখতেন।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পূর্ণিয়া থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর ১৯১৫ সালে তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে শিক্ষক হিসেবে পান। কলকাতায় থাকার সময় তিনি হোস্টেল ও মেসে থেকেছেন। এই সময় অজিত সেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যচর্চার অন্যতম দোসর এই অজিত সেন। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, ভলিবল খেলায় তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। কলকাতা থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি পাটনা যান আইন পড়তে। কিন্তু কখনোই পাকাপাকিভাবে ওকালতি করেননি । এর মাঝেই তাঁর বিয়ে হয়। রুজি রোজগারের জন্য পিতার সহকারি হিসেবে ওকালতি করলেও পরবর্তীকালে তিনি সাহিত্যসাধনাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর বয়সে।‌ কলেজে পড়াকালীন তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি চরিত্র হল গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী। ১৯৩২ সালের ‘পথের কাঁটা’ উপন্যাসে ব্যোমকেশের আত্মপ্রকাশ। এরপর তিনি ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে দশটি গোয়েন্দা কাহিনী রচনা করেন। কিন্তু রুজি-রোজগারের প্রয়োজনে ১৯৩৮ সালে তিনি মুম্বাই চলে যান এবং হিমাংশু রায়ের বোম্বে টকিজে যোগদান করেন চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে। ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’র লেখক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের উদ্যোগেই চিত্রনাট্যকার হিসেবে শরদিন্দু মুম্বাইয়ে পাড়ি দেন। তিনি  ১৪ বছর মুম্বাইয়ে ছিলেন চিত্রনাট্যকার হিসেবে। চিত্রনাট্যকার হিসেবে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল ‘দুর্গা’, ‘কঙ্কন’, ‘নবজীবন’ ইত্যাদি। মুম্বাইয়ের মালাদ অঞ্চলে একটি বাগান ঘেরা বাড়ি ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দিকপাল সব ব্যক্তিত্বরা যেমন শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এখানে আড্ডা জমাতেন। এই আড্ডার মধ্যে গড়ে উঠল নতুন খেলা, নাম  ‘অন্তাক্ষরী’। বর্তমানে বহুল প্রচলিত এই খেলাটির সৃষ্টিকর্তা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নামটিও তাঁরই দেওয়া। হিমাংশু রাই ও দেবিকা রানির বম্বে টকিজের ‘কম্পন’, ‘পুনর্মিলন’, ‘ঝুলা’ ইত্যাদির সিনেমার চিত্রনাট্যে তাঁর হাত ছিল। তিন বছর পরে বম্বে টকিজের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়। ১৯৪৭ সালে যোগ দিলেন আচারিয়া আর্ট প্রোডাকশনের সঙ্গে। ‘আগে কদম’, ‘উলঝন’ ইত্যাদি ছবির ভাবনার সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন। দু’বছর পর অন্য একটি প্রোডাকশন হাউজ থেকে তৈরি হয় তাঁর ‘বিষের ধোঁয়া’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘ভাবি’। সেই সময়ের জনপ্রিয় ছবি ছিল এটি। এরপর তিনি ফ্রীল্যান্স করেন, প্রথমে চিত্রনাট্য বানান এবং কয়েক মাস পরে সেটিকে গল্পের আকারে লিখতে থাকেন। তাঁর ‘মনচোরা’ গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় যে সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন সেই গল্প লেখার আগে ‘কানামাছি’ নাম দিয়ে সেটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়। ঠিক সেই রকমই প্রথমে চিত্রনাট্যে লিখলেন ‘যুগে যুগে’, পরে সেই কাহিনী নিয়ে উপন্যাস হল ‘রাজদ্রোহী’। বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় ছবি ছিল এটি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এমনই এক লেখক যিনি নিজের লেখাকে কখনো পাঠিয়েছেন চিত্রনাট্যে, কখনো বা গল্পের দুনিয়ায়। চিত্রনাট্য তাঁর কাছে গল্প-উপন্যাসের মতোই সাহিত্যের প্রকরণ।

এরপর ১৯৫২ সালে সিনেমা জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে পুনেতে নিজের গৃহ নির্মাণ করেন নাম দেন ‘মিথিলা’ এবং সম্পূর্ণভাবে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৫১ সালে ‘চিত্রচোর’ কাহিনীর মাধ্যমে ব্যোমকেশের পুনরায় বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ ঘটে। এই সময়ে ব্যোমকেশের কাহিনীতে সত্যবতী চরিত্রের সংযোজন ঘটে। ব্যোমকেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাহিনী হলো ‘দুর্গরহস্য’ ,’মাকড়সার রস’, ‘সীমান্ত হীরা’, ‘সজারুর কাঁটা’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। শেষ অসমাপ্ত ব্যোমকেশ উপন্যাস হল ‘বিশুপাল বধ’।

তবে শুধুমাত্র গোয়েন্দা কাহিনী নয় ঐতিহাসিক রচনা লেখাতেও ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা। তিনি উপন্যাসের আঙ্গিকে ইতিহাসকে তুলে ধরেছিলেন পাঠকের সামনে। তাঁর উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি হল ‘কালের মন্দিরা’, ‘গৌড়মল্লার’, ’তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘কুমারসম্ভবের কবি’, ’তুঙ্গ ভদ্রার তীরে’ ইত্যাদি। ‘কালের মন্দিরা’ উপন্যাসের পটভূমি ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য, ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। ‘গৌড়মল্লার’ উপন্যাসের পটভূমি ছিল বাংলার গৌড়ভূমি, ঐতিহাসিক চরিত্র মানবদেব ও জয়নাগ। ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসের পটভূমি মধ্য ও উত্তর-পূর্ব ভারত, ঐতিহাসিক চরিত্রাবলী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, রত্নাকর শান্তি, নয়পাল, বিগ্রহপাল, লক্ষ্মীকর্ণদেব, তিব্বতীয় আচার্য বিনয়ধর ইত্যাদি। ‘কুমারসম্ভবের কবি’ উপন্যাসের পটভূমি পশ্চিম ভারতের উজ্জয়িনী নগর গুপ্ত সাম্রাজ্যের অঙ্গ, সময় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতাব্দী, চরিত্র মহাকবি কালিদাস ও সম্রাট বিক্রমাদিত্য। ‘তুঙ্গ ভদ্রার তীরে’ উপন্যাসের পটভূমি দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর রাজ্য, ঐতিহাসিক চরিত্র রাজা দেবরায়।

‘জাতিস্মর’, ‘বুমেরাং’, ‘কাঁচামিঠে’, ’চুয়া চন্দন’ ইত্যাদি ছোটগল্প তিনি রচনা করেছিলেন ।‘চুয়াচন্দন’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বেশ কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্র হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। সত্যজিৎ রায় নির্দেশিত ‘চিড়িয়াখানা’, তপন সিংহ নির্দেশিত ‘ঝিন্দের বন্দী’, তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘ব্যোমকেশ’ এর বিভিন্ন কাহিনী নিয়েও বেশকিছু জনপ্রিয় সিনেমা তৈরি হয়েছে।এমনকি মৃত্যুর পর পাওয়া যায় তাঁর এক অপ্রকাশিত লেখা ‘প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত’ আর এই গল্প নিয়ে তৈরি হয় ‘দাদার কীর্তি’ সিনেমা।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় চলিত, তৎসম দুই ধরনের বাংলা ভাষায় অসামান্য দক্ষ ছিলেন। তিনি একাধারে রহস্য, রোমান্স, আধিদৈবিক বিষয়কে উপজীব্য করে অসাধারণ সাহিত্যকীর্তির পরিচয় রেখেছেন। পরিমিতিবোধ ছিল তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছোটগল্পগুলিকে সামাজিক, ঐতিহাসিক, ভৌতিক এবং শিশু সাহিত্য হিসেবে ভাগ করা যায়। অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘বরোদা’ গল্পটি। ‘বরোদা’ চরিত্রটি অভিনব চরিত্র ছিল। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট ‘ভল্লূ‌ সদার’ চরিত্রটিও পাঠকমহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। একদম ছোটদের জন্য লেখা গল্প হল ‘পুষি ভুলোর বনবাস’।

তিনি ‘তুঙ্গ ভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এছাড়াও শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, মতিলাল পুরস্কার প্রভৃতি পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৭০ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন, এ সময় তাঁকে মুম্বাইয়ে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান