সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। তাঁর পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এবং ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) এই তিনটি ছবি একত্রে ‘অপু ট্রিলজি’ নামে বিখ্যাত। ১৯৫৬ সালের ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’-এ ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি ‘শ্রেষ্ঠ মানবীয় তথ্যচিত্র’-এর শিরোপা পায়। চার্লি চ্যাপলিনের পর সত্যজিৎ রায় ছিলেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার ‘লিজিয়ন অফ অনার’-এ ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ লাভ করেন। কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র মিলিয়ে মোট ৩৭টি ছবি তৈরি করেছেন সত্যজিৎ রায়। তবে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি কাল্পনিক এক গোয়েন্দা চরিত্রকে নির্মাণ করেন ‘ফেলুদা’ নামে। তাছাড়া তাঁর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান ধারার গল্প-উপন্যাসের চরিত্র হল প্রোফেসর শঙ্কু। সুকুমার রায়ের পরে বাংলার বিখ্যাত শিশু-কিশোরদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনার ভারও ছিল তাঁর উপর। ২০০৪ সালে বিবিসি-র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ত্রয়োদশতম স্থান অর্জন করেন সত্যজিৎ রায়।

১৯২১ সালের ২মে কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্পের জগতে খ্যাতনামা রায়চৌধুরী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। তাঁর বাবা বিখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার রায় এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সুপ্রভা রায়। তাঁর ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, প্রকাশক এবং ব্রাহ্মসমাজের একজন অন্যতম সদস্য। মাত্র তিন বছর বয়সেই সত্যজিৎ রায় তাঁর বাবাকে হারান।

প্রথমে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে সত্যজিৎ রায় প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন এবং তারপরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ ঘটে তাঁর। এমনকি প্রাচ্যের শিল্পতত্ত্ব বিষয়েও তাঁর মনে এক স্পষ্ট ধারণা জন্মায়। অনেক পরে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের উপর সত্যজিৎ রায় একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের পড়াশোনা মাঝপথে থামিয়েই কলকাতায় কাজের সূত্রে চলে আসেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

‘ডি জে কিমার’ নামের একটি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থাতে ১৯৪৩ সালে মাত্র আশি টাকা বেতনে একজন ‘জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। পরে সিগনেট প্রেসের কর্ণধার ডি. কে. গুপ্তের অধীনে একজন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। এই কাজের সূত্রেই জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’, জওহরলাল নেহেরুর ‘এ ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র একটি শিশু-কিশোর উপযোগী সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’-র প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণও করেন তিনি। এই বইটি তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৪৭ সালে কলকাতায় চিদানন্দ দাশগুপ্ত গড়ে তোলেন ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’ যেখানে প্রদর্শিত বহু বিদেশি চলচ্চিত্র দেখেই সত্যজিৎ রায়ের মনে চলচ্চিত্র-শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ ও আকর্ষণ তৈরি হয়। লন্ডনে থাকার সময় ডি জে কিমারের অফিসে কাজ করতে করতেই পেশাদারি মনোভাব নিয়ে ছবি করবেন বলে ঠিক করেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রেনোয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘বাইসাইকেল থিভস’ দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।

লন্ডন থেকে দেশে ফিরে শৌখিন তথা অপেশাদার বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রগ্রাহক, শিল্প-নির্দেশকদের সঙ্গে নিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটির শ্যুটিং শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। এই ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বাধা ছিল অর্থ সংগ্রহ। সত্যজিৎ ভেবেছিলেন ছবিটির প্রাথমিক কিছু অংশ শ্যুটিং করে তা দেখিয়ে বাকি ছবির টাকা তুলবেন তিনি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, নিজের অর্থ সংস্থানের উপর ভরসা করেই ছবির কাজ শুরু করেন তিনি। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দীর্ঘ তিন বছর ধরে নানাবিধ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ ছবির কাজ শেষ হয়। ১৯৫৫ সালে ছবিটি মুক্তি পায় এবং প্রভূত দর্শক সাফল্য লাভ করে। ১৯৫৬ সালের ‘কান চলচ্চিত্র উৎসব’-এ ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি ‘শ্রেষ্ঠ মানবীয় তথ্যচিত্র’-এর শিরোপা পায়। তারপর তাঁর ‘অপরাজিত’ ছবিটির জন্য সত্যজিৎ রায় ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কারে ভূষিত হন। তারপর একে একে ‘জলসাঘর’, ‘পরশ পাথর’, ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার’, ১৯৬৪ সালে ‘চারুলতা’ সহ ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন ঘরানার ছবি নির্মাণ করেন তিনি। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সহ প্রযোজনায় ‘দ্য এলিয়েন’ নামে একটি কল্পবিজ্ঞানের ছবি তৈরির পরিকল্পনা করলেও তা ব্যর্থ হয় এবং তারপর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নামে একটি অত্যন্ত বাণিজ্য-সফল ছবি তৈরি করেন তিনি। এর দ্বিতীয় ভাগ হিসেবে মুক্তি পায় ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটি। ১৯৮৪ সালে ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটি মুক্তি পায় এবং এই সময় থেকেই শারীরিক নানাবিধ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় সত্যজিৎকে। জীবনের একেবারে শেষ দিকে ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’ এবং ‘আগন্তুক’ নামে তিনটি অসাধারণ ছবি তৈরি করেন তিনি।

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” (Best Human Documentary) পুরস্কারটি। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ – এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে ‘অপু ত্রয়ী’ বলা হয় এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বহুল স্বীকৃত। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ণ, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্র গ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১৯৯২ সালে পাওয়া অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার ওরফে অস্কার যা তিনি সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন।

১৯৮০-র শুরুর দিকে ভারতীয় লোকসভা সদস্য ও প্রাক্তন অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত তাঁর বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ আনেন যে তিনি ‘দারিদ্র্য রপ্তানি’ করছেন এবং সত্যজিতের কাছে ‘আধুনিক ভারত’-এর প্রতিনিধিত্ব করে এমন ছবি বানানোর দাবি করেন। অন্যদিকে ভারত জুড়ে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করতেন সত্যজিৎ রায় জাতির নিপীড়িত শ্রেণির প্রতি ‘প্রত্যয়ী’ ছিলেন না, বরং তিনি ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে বর্ণনাভঙ্গি ও নান্দনিকতার মাধ্যমে দারিদ্র্যকে মহৎ করে দেখিয়েছেন। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন যে, সত্যজিৎ তাঁর ‘বুর্জোয়া’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ছবির সংঘাতগুলির কোনও সমাধান দেখাতে পারেননি। সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনের সময় তাঁর ছেলে সন্দীপ এক পর্যায়ে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ষাটের দশকে সত্যজিৎ এবং চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতা উত্তমকুমারকে ছবিতে নেওয়ার জন্য মৃণাল সেন সত্যজিতের সমালোচনা করেন।

সত্যজিতের চলচ্চিত্র কৌশল অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ এবং বাংলাদেশের তারেক মাসুদ ও তানভীর মোকাম্মেল-কে অনুপ্রাণিত করেছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, মৃণাল সেন ও আদুর গোপালকৃষ্ণানের মত চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভারতীয় চলচ্চিত্রে সত্যজিতের আসামান্য অবদান স্বীকার করেছেন। ভারতের বাইরে মার্টিন স্করসিস, জেমস আইভরি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও এলিয়া কাজানের মত চিত্রনির্মাতারা তাঁর কাজ দেখে প্রভাবিত হয়েছেন বলে ধারণা করে হয়। ইরা সাক্‌স-এর ২০০৫ সালে নির্মিত ‘Forty Shades of Blue’ ছিল ‘চারুলতা’র একটি দুর্বলভাবে অনুসৃত পুনর্নির্মাণ, আর ১৯৯৫ সালের ‘মাই ফ্যামিলি’ ছবিটির শেষ দৃশ্য ‘অপুর সংসার’-এর শেষ দৃশ্যকে অনুসরণ করে তৈরি।

বহু প্রতিষ্ঠান সত্যজিতকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। চার্লি চ্যাপলিনের পর সত্যজিৎ রায় ছিলেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার ‘লিজিয়ন অফ অনার’-এ ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পদক ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করে।

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু হয়।

13 comments

আপনার মতামত জানান