বাংলা চলচ্চিত্রের দীর্ঘকালীন প্রবহমানতায় যেসব মহান অভিনেতা তাঁদের অসামান্য সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় সমৃদ্ধ করেছেন এই শিল্পমাধ্যমকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সন্তোষ দত্ত (Santosh Dutta)। বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনয়ের জন্য মূলত জনপ্রিয় হলেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেও অনবদ্য সাবলীল অভিনয়ে আপামর বঙ্গবাসীকে তিনি মুগ্ধ করেছেন বারংবার। সন্তোষ দত্ত নিজের পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন একজন জাঁদরেল আইনজীবী হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি গোয়েন্দা ফেলুদার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর ভূমিকায় সন্তোষ দত্তের অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রের সম্পদ হয়ে রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক চলচ্চিত্রে অবিস্মরণীয় সব চরিত্র তো করেইছেন, সেইসঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের মতো আরও নানা চরিত্রে তাঁর অভিনয় দক্ষতা অকুণ্ঠ প্রশংসা দাবি করে। সিনেমা ছাড়াও তাঁকে টিভি সিরিয়ালেও দেখা গিয়েছিল।
১৯২৫ সালের ২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ অধ্যুষিত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত কলকাতায় সন্তোষ দত্তের জন্ম হয়। কলকাতার আমহার্স্ট রো-তে ছিল সন্তোষ দত্তের পৈতৃক বাড়ি এবং বর্ধমানের পলাশিতে কুরমুন গ্রামে ছিল তাঁর দেশের বাড়ি। বিদ্যাসাগর কলেজে থার্ড ইয়ারের ছাত্র থাকাকালীন মাত্র উনিশ বছর বয়সে সন্তোষ দত্তের বিয়ে দিয়ে দেন তাঁর বাবা। পাত্রী ছিলেন মানিকতলার কারবালা ট্যাঙ্ক লেনের বাসিন্দা প্রতিমা দেবী। পরবর্তীতে তাঁদের এক কন্যার জন্ম হয়, যাঁর নাম লাবণ্য।
ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের শখ সন্তোষ দত্তের ভিতরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই শখটি গড়ে উঠবার পিছনে তাঁর বাবারও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সন্তোষ দত্তের বাবা ছিলেন একজন মঞ্চাভিনেতা। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সন্তোষ গিরিশ ঘোষের নাটক দেখতে যেতেন। এছাড়াও দেশের বাড়িতে থাকাকালীন অনেক ছোট বয়েস থেকেই গ্রাম্য পালাপার্বনে অনুষ্ঠিত নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। মাত্র সাত বছর বয়সে এরকম এক গ্রামের অনুষ্ঠানে ‘সাজাহান’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তাঁর অভিনয়ে জগতে হাতে খড়ি হয়।
তবে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগে কিছু সময় ব্যাঙ্কেও চাকরি করেছিলেন তিনি। তৎকালীন ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে (অধুনা স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া) চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে প্রথমবারেই প্রথম তালিকার একদম প্রথমে তাঁর নাম আসে। কিন্তু কোন এক সূত্র মারফত তিনি জানতে পারেন যে, চাকরিটি যদি তিনি না নেন, তবে তাঁর জায়গায় সদ্য পিতৃহারা এক যুবকের চাকরি হতে পারে। তিনি সেই যুবকটিকে চাকরিটি দেওয়ার জন্য তালিকায় প্রথম নাম থাকা সত্ত্বেও চাকরি গ্রহণে অসম্মত হন। অবশ্য পরের মাসে ব্যাঙ্ক যেচেই তাঁকে ডাক পাঠিয়েছিল। ব্যাঙ্কের কাজ করবার সঙ্গে সঙ্গে আইন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন তিনি। যখন ব্যাঙ্ক থেকে তাঁকে জানানো হল যে, তাঁর বদলি হয়ে যাবে উড়িষ্যার অঙ্গুলে তখনই আগুপিছু না ভেবেই ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিলেন সন্তোষ। পরবর্তীকালে তিনি একজন ফৌজদারি আইনজীবী হন।
আইনজীবী হিসেবে কাজ করবার পাশাপাশি কিন্তু নিজের আসল ভালবাসার জায়গাটি ত্যাগ করেননি তিনি। অভিনয়ও চালিয়ে গেছেন পাশাপাশি। দুর্গাপুর নাট্যোৎসবের সময় দু’বেলা ট্রেনে যাতায়াত করে একদিকে অভিনয় করেছেন, আবার ফিরে এসে কোর্টের মামলা সংক্রান্ত কাজকর্ম সামলেছেন। অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা লড়েছিলেন সন্তোষ দত্ত। অনেকেই হয়তো শুনলে বিস্মিত হবেন, হেমন্ত বসু হত্যাকান্ড, দেবযানী বণিক হত্যা মামলা ইত্যাদি বিভিন্ন মামলার সঙ্গে আইনজীবী হিসেবে জড়িত ছিলেন সন্তোষ দত্ত। আবার নেপাল রায় হত্যা মামলার সময় অভিযুক্তদের পক্ষে যখন লড়ছিলেন তখন মামলা থেকে সরে আসার জন্য ফোনে হুমকি পর্যন্ত পেয়েছিলেন কিন্তু মামলা থেকে মোটেই পিছিয়ে আসেননি তিনি।
থিয়েটারের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ থেকেই একসময় সবিতাব্রত দত্ত, নির্মলকুমারদের মতো মানুষদের নিয়ে সন্তোষ দত্ত গড়ে তুলেছিলেন ‘আনন্দম’ নাট্যগোষ্ঠী। পরে এই নাট্যগোষ্ঠীর নাম হয়েছিল ‘রূপকার’। ১৯৫৭ সালে সন্তোষ দত্তের দল রূপকার মহারাষ্ট্র নিবাস হলে সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরি’র অভিনয় করে। সেই নাটকে ভবদুলালের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। শো-তে দর্শকাসনে বসে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ভবদুলালের চরিত্রে সন্তোষ দত্তের অভিনয় পাকা জহুরী সত্যজিৎ-এর মনে ধরেছিল। সন্তোষ দত্ত রয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ-এর মননে। এরপর যখন সত্যজিৎ রাজশেখর বসুর গল্প থেকে ১৯৫৮ সালে ‘পরশপাথর’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন, তখন ছোট্ট একটি ঘোষকের চরিত্রের জন্য তলব করেন সন্তোষ দত্তকে। সেই শুরু। এরপর একে একে নানারকমের ভূমিকায় তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিল আপামর বাঙালিকে।
সন্তোষ দত্তকে বাঙালি বোধহয় সবচেয়ে বেশি চেনেন জটায়ু চরিত্রটির জন্য। এই কিংবদন্তি চরিত্রটির স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়। গোয়েন্দা ফেলুদার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু সত্যজিতের অমর সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। যে-গল্পে লালমোহনের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয়েছিল জটায়ুর, সেই গল্পটি অর্থাৎ সোনার কেল্লা থেকে সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন সত্যজিৎ। জটায়ুর চরিত্রে অন্য কাউকে না ভেবে সন্তোষ দত্তকেই বেছে নেন তিনি। কিন্তু এই সিনেমা এবং এই চরিত্রটি সন্তোষ দত্তের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। গল্পটি রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে, তাই ঠিক হয় শ্যুটিং হবে সেখানেই। সন্তোষ দত্তকেও প্রায় এক মাস রাজস্থানে শ্যুটিংয়ের জন্য থাকতে হবে, কিন্তু সেসময় একটি জটিল হত্যা সংক্রান্ত মামলা নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাঁকে এবং যেদিন রাজস্থান যাওয়ার কথা, সেদিনই পড়েছিল মামলার শুনানির তারিখ। তখন মামলার দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া অত সহজ ছিল না। নিরুপায় হয়ে সন্তোষ দত্ত ফোন করলেন বিরোধী পক্ষের আইনজীবীকে এবং সমস্ত কথা খুলে বললেন। বিরোধী পক্ষের উকিল অবশ্য এ ব্যাপারে সন্তোষ দত্তকে সাহায্যই করেন এবং মামলা পিছোনোর আর্জি নিয়ে জজ সাহেবের কাছে পিটিশনও জমা দেন তিনি। এমন সহযোগিতার ফলেই শেষমেশ সোনার কেল্লা ছবিতে অভিনয় করতে পেরেছিলেন সন্তোষ দত্ত।
সন্তোষ দত্ত যেমন পরিশ্রমী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তেমনি অতি সাধারণ জীবনযাপনও করতেন তিনি। ১৯৭৮ সাল পর্যন্তও তিনি কোর্টে যেতেন ট্রামে বাসে চেপে। কখনও কখনও রাস্তার মানুষ তাঁকে চিনেও ফেলতেন। অবশেষে অনেকের অনেক বলায় বাধ্য হয়ে একটি নেভি ব্লু রঙের অ্যামবাসাডার কিনেছিলেন। ফেলুদার একটি গল্পে হয়তো সন্তোষ দত্তের এই গাড়ি কেনাকে মাথায় রেখেই সত্যজিৎ জটায়ুর নতুন গাড়ি কেনার কথা লিখেছিলেন। সত্যজিতের করা জটায়ুর অলংকরণগুলি যে আদতে সন্তোষ দত্তেরই একরকম প্রতিকৃতি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সন্তোষ দত্ত ছিলেন ফুটবলের ভীষণ ভক্ত এবং তাঁর প্রিয় দল ছিল মোহনবাগান। আবার অবসর বিনোদনে রান্না করতেও পছন্দ করতেন। এছাড়াও বিপুল পড়াশুনা ছিল তাঁর। পড়াশুনা করতে করতেই তিনি ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত কমেডিয়ান গ্রাউচো মাক্সের। সন্তোষের হাতের লেখাটিও ছিল দেখবার মতন। ক্যালিগ্রাফি অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের হরফ লেখাতেও ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা।
সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের যেসব জনপ্রিয় পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন সন্তোষ দত্ত, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, তরুণ মজুমদার (গণদেবতা), দীনেন গুপ্ত (মর্জিনা আবদাল্লা), উমানাথ ভট্টাচার্য (চারমূর্তি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ), পার্থপ্রতিম চৌধুরী (যদুবংশ, পূজারিণী) পীযুষ বসু (সিস্টার), পূর্ণেন্দু পত্রী (মালঞ্চ), সলিল দত্ত (ওগো বধু সুন্দরী) প্রমুখ। সন্তোষ দত্ত অভিনীত কিংবদন্তি গোপাল ভাঁড়ের চরিত্রটি হয়ে রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের সম্পদ। এছাড়াও আরও যেসব বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাপুরুষ, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, কিশোর কন্যা, জনঅরণ্য, শেষ রক্ষা, এক যে ছিল দেশ, সুবর্ণলতা, বৈকুন্ঠর উইল, আমার পৃথিবী, অগ্নি সংকেত প্রভৃতি। সন্তোষ দত্ত অভিনীত শেষ ছবি ‘ পলাতক ‘ যা তাঁর মৃত্যুর তিনবছর পর ১৯৯১ সালে মুক্তি পায়। মৃত্যুর আগে শেষ যে নাটকটি করেছেন তা হল রবি ঘোষের ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’। সিনেমা ছাড়াও একসময় তাঁকে দেখা গিয়েছিল রবি ঘোষের সঙ্গে ‘গোয়েন্দা ভগবানদাস’ নামের একটি টিভি সিরিয়ালে। সন্তোষ দত্তকে অধিকাংশ বাঙালি কৌতুকাভিনেতা বলেই চিনেছে। কিন্তু চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও একইভাবে সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে আপামর বাঙালি দর্শককে মুগ্ধ করেছিলেন তিনি।
১৯৮৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফুসফুসের ক্যান্সারে মাত্র ৬২ বছর বয়সে এই কিংবদন্তি অভিনেতা সন্তোষ দত্তের মৃত্যু হয়।
One comment