বাংলা থিয়েটারের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল যে সমস্ত নাট্যশিল্পীর হাত ধরে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী (Sisir Kumar Bhaduri)। বাংলা রঙ্গমঞ্চে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল মূলত তাঁর হাত ধরেই৷ কিংবদন্তী অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবেই শিশিরকুমারের খ্যাতি। রসরাজ অমৃতলাল বসু শিশিরকুমারের প্রয়োগনৈপুণ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্যপ্রতিভার উপর যথেষ্ট পরিমাণে আস্থা রাখতেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী রবীন্দ্রনাথের সাতটি নাটকের প্রযোজনা করেছিলেন। এছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের নাটক সফলভাবে মঞ্চস্থ করতে সক্ষম হন তিনি। তাঁর ‘সীতা’ নাটকের প্রযোজনা প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শিশিরকুমার ‘নাট্যমন্দির’ নামে একটি থিয়েটার মঞ্চের সূচনা করেছিলেন, পরে সেখানেই গড়ে ওঠে বিশ্বরূপা থিয়েটার। দল নিয়ে বাংলা থেকে প্রথম শিশিরকুমারই বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন নাট্য প্রযোজনার উদ্দেশ্যে। শেষ দিকে কিছু নাট্যপ্রযোজনার পরে তাঁকে তীব্র সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছিলেন তিনি। বাংলা থিয়েটারকে তিনি যে উচ্চমানের গতানুগতিকতাহীন ও পরীক্ষামূলক পরিচালনা এবং অনবদ্য আধুনিকমানের অভিনয় উপহার দিয়েছিলেন তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নাট্যশিল্পীদের শ্রদ্ধা অর্জন করে চলেছে। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে শিশিরকুমার ভাদুড়ী আজও সমানভাবে চর্চিত হন।
১৮৮৯ সালের ২ অক্টোবর ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত হাওড়া জেলার রামরাজাতলায় শিশিরকুমার ভাদুড়ীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল হরিপদ ভাদুড়ী।
১৯০৫ সালে যখন গোটা বাংলা বঙ্গভঙ্গের আগুনে জ্বলছে, সে বছরেই কলকাতার বঙ্গবাসী স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন শিশিরকুমার। এরপর আরও উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি প্রবেশ করেছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের কলা বিভাগে। কলেজে থাকতেই তাঁর অভিনয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। ১৯১০ সালে কলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে সক্ষম হন তিনি। স্নাতকের পর স্নাতকোত্তরের দিকে অগ্রসর হন তিনি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯১৩ সালে। সারাজীবন সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। আইনের ক্লাসেও ভর্তি হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু পরীক্ষা দেননি।
এরপর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপনা শুরু করেন শিশিরকুমার। শৌখিন অভিনেতারূপে ছাত্র ও অধ্যাপক জীবন থেকেই ইংরেজি ও বাংলা বহু নাটকে অভিনয় করেছিলেন শিশিরকুমার। মূলত তখন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলেই তিনি অভিনয় করতেন। ১৯১২ সালে এই হলে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুন্ঠের খাতা’ নাটকে কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। সেই অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন ‘কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ঐ পার্টে আমার যশ ছিল’। বাংলা রঙ্গালয়ের পত্তন যাঁদের হাতে হয়েছিল অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজা যতীন্দ্রমোহন, মাইকেল, গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল প্রমুখের মধ্যে খুব কমজনই জীবিত ছিলেন তখন। অর্ধেন্দুশেখর ও গিরিশচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল এবং অমৃতলাল বেঁচে ছিলেন বটে, কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে রসালাপেই তাঁর সময় কেটে যেত, থিয়েটারে তাঁর দাপট কমে এসেছিল। পাশাপাশি তখনকার অভিনেতাদের মধ্যে অনেকেরই শিক্ষা, সংস্কৃতি তেমন কিছু ছিল না, প্রসঙ্গত মনে পড়বে দানীবাবুর কথা। শিক্ষার অভাবের কারণে সম্পূর্ণ নতুন রীতির প্রবর্তন করে থিয়েটারে নবযুগ আনার কোনওরকম ক্ষমতাই ছিল না তাঁর মত অন্য অভিনেতাদের। তেমনই একসময়ে শোনা গেল ‘ম্যাডান’ নামক এক কোম্পানির বাংলা রঙ্গালয়ে অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। ম্যাডান কোম্পানি শিল্পের চাইতে ব্যবসাতেই মনোযোগ দিয়েছিল বেশি। শিশির ভাদুড়ীর শৌখিন অভিনয়ের প্রশংসা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই তারা সেই খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে লাভের অঙ্ক বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল৷ তবে যতই ব্যবসাবুদ্ধি থাকুক না কেন, শিশিরকুমারকে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসা বাংলা থিয়েটারের পক্ষে যে এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল তা বলাই বাহুল্য।
সেই সময়ে বাংলা থিয়েটারে প্রয়োগনৈপুণ্যের অভাব লক্ষ্য করা যেত। শিশিরকুমারের শেষ শৌখিন নাট্যাভিনয় ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ নাটকটির প্রয়োগকর্তা ছিলেন শিশিরকুমার নিজে। সেই নাটকের প্রয়োগকৌশল যে বাংলা থিয়েটারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তা সেদিনকার শিক্ষিত, মননশীল দর্শকেরা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯২১ সালে সেই অভিনয়টি করবার পরেই শৌখিন নাট্যাভিনয় ত্যাগ করে ম্যাডান কোম্পানির উদ্যোগে পেশাদার মঞ্চে অভিনয়ের জন্য অধ্যাপনাও ছেড়ে দেন শিশিরকুমার। অবশেষে ১৯২১ সালে ম্যাডান কোম্পানির প্রযোজনায় কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলমগীর’ নাটকের নাম ভূমিকায় পেশাদার রঙ্গমঞ্চে প্রথম অবতীর্ণ হন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। আলমগীরের অভিনয় দর্শক সাধারণের মনে প্রোথিত হয়ে যায়। এরপর ১৯২২ সালে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘রঘুবীর’ নাটকের নামচরিত্রে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয়ে তাঁর এক অনন্য সাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সেসময়ে বাংলাদেশে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের চাণক্য বলতে বোঝাত একমাত্র দানীবাবুকেই, কিন্তু নবীন শিশিরকুমার তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভার বলে দানীবাবুর একচ্ছত্র সিংহাসন টলিয়ে দিয়েছিলেন। ক্রমে প্রভূত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যেই মতবিরোধের ফলে ম্যাডান কোম্পানি ত্যাগ করেন। সেই সময়ে ১৯২২ সাল নাগাদ শিশিরকুমার ভাদুড়ী চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকে মনোনিবেশ করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘আঁধারে আলো’ নামক নির্বাক ছবিটি নরেশ মিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন তিনি।
এরপর ‘ওল্ড ক্লাব’-এর কয়েকজন অবৈতনিক নটশিল্পীকে নিয়ে একটি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেনের প্রদর্শনীতে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন শিশিরকুমার। সে নাটকে রামচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ‘সীতা’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় অ্যালফ্রেড থিয়েটার ভাড়া নিয়ে তিনি এর নিয়মিত পেশাদারি অভিনয়ের আয়োজন করেন। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আর্ট সম্প্রদায় তখন স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করছে। শিশিরকুমারের রঙ্গমঞ্চে প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে তারা ষড়যন্ত্র করে দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপকুমারের কাছ থেকে ‘সীতা’র অভিনয়স্বত্ত্ব ক্রয় করে নেন। এই কারণেই সে নাটকটি মঞ্চস্থ করা আর সম্ভব হয়নি, বদলে ‘বসন্তলীলা’ নামক একটি গীতিমালার অভিনয় করেন শিশিরকুমার। ম্যাডানের পর অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ১৯২৪ সালে শিশিরকুমারের পুনরাগমন ঘটে। এরপর ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট মনমোহন থিয়েটার ভাড়া নিয়ে যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ নাটক পুনরায় মঞ্চস্থ করেন তিনি। আসলে যোগেশচন্দ্র চৌধুরীকে সীতার কাহিনী নিয়ে নতুন পালা লেখার আহ্বান জানান শিশিরকুমার নিজেই। নাটকটির রচনা যোগেশচন্দ্রের হলেও নাট্য পরিকল্পনা ছিল শিশির ভাদুড়ীর। আধুনিকমানের অভিনয়, দৃশ্যসৌন্দর্য, নৃত্যগীতবাদ্য-সহযোগে ‘সীতা’ প্রযোজনাটি বাংলা থিয়েটারের নবদিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছিল বলা যায়। সে নাটকে মঞ্চ, আলো, দৃশ্যপটে এমন কিছু পরিবর্তন করেছিলেন শিশিরকুমার যা ইতিপূর্বে বাংলা থিয়েটার জগতের কাছে অজানা ছিল৷ রঙ্গমঞ্চের উপর পৌরাণিক যুগের স্থাপত্য, ভাস্কর্যের ব্যবহার, এমনকি সাজপোশাকেও সেই প্রাচীনকালের ছাপ এ জিনিস ‘সীতা’র আগে কেউ করেননি। এমনকি ‘সীতা’ নাটকের দৃশ্যগুলিকে স্বাভাবিক করবার জন্য রঙ্গমঞ্চ থেকে পাদপ্রদীপ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সমস্ত দৃশ্যে আকাশের বা আশপাশের আলো ব্যবহার করা হত। এছাড়াও বিলাতি ভাবধারা বর্জন করে রোশনচৌকি, প্রবেশপথে আলপনা, বসার সিটে বাংলা অক্ষরে সংখ্যা লেখা ইত্যাদি বিষয়গুলিও নাটকটির আয়োজনকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ‘সীতা’ প্রযোজনাটির নানা কাজে যুক্ত ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র রায়ের মতো মানুষজন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে ‘সীতা’ বাংলা থিয়েটারের একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে। ‘সীতা’র প্রথম অভিনয়ে অমৃতলাল মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘শিশিরকুমারই থিয়েটারের নবযুগের প্রবর্তক’। রবীন্দ্রনাথ ‘সীতা’ দেখে প্রয়োগনৈপুণ্য কথাটি ব্যবহার করেছিলেন৷ ইতিপূর্বে সম্ভবত আর কোনও নাট্যবিষয়ক আলোচনায় এই শব্দের প্রয়োগ হয়নি কখনও। মনমোহন থিয়েটারকেই ‘নাট্যমন্দির’ রূপে গড়ে তুললেন তিনি এবং তার শুভারম্ভ হল ‘সীতা’ অভিনয়ের মাধ্যমে। এখানে উল্লেখ্য, সম্ভবত ‘সীতা’ নাটকের পূর্বেই শিশিরকুমারের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শিশিরকুমারের জীবনের অনুপ্রেরণায় ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ নামে যে উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, তাতে লিখেছিলেন ‘সীতা’ নাটকের শেষ দৃশ্যে রামের হাহাকার এবং ‘সীতা সীতা’ বলে যে বুকফাটা চিৎকার রয়েছে, সেই দৃশ্যে অভিনয়ের সময় মুখে সীতার নাম উচ্চারণ করলেও ভিতরে ভিতরে নিজের স্ত্রীয়ের নাম উচ্চারণ করে অমন উচ্চরবে কাঁদতেন শিশিরকুমার। এই দৃশ্যটি স্বভাবতই খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় কল্পনার মিশেল থাকতে পারে, কিন্তু স্ত্রী-এর আত্মহত্যার খবরটি সত্য।
‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘জনা’, ‘পুণ্ডরীক’—একের পর এক উৎকৃষ্ট নাট্যাভিনয়ের কারণে নাট্যমন্দির তখন সফলতার চূড়ায় বিদ্যমান। ‘জনা’কে আধুনিক যুগের উপযোগী করে ঢেলে সাজান শিশিরকুমার ভাদুড়ী ১৯২৫ সালে। নাট্যমন্দিরের তিনজন পরিচালক ছিলেন তখন তুলসীচরণ গোস্বামী, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র এবং শিশিরকুমার ভাদুড়ী। এসময় কর্ণওয়ালিস থিয়েটারকে নতুন মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন তিনি। উদ্বোধন হল ‘সীতা’ নাটকেরই অভিনয় দিয়ে। এরপরেই ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত বিখ্যাত নাটক ‘বিসর্জন’ নির্মাণ করলেন শিশিরকুমার এবং প্রথমে রঘুপতির ভূমিকায় ও পরবর্তীতে দশম অভিনয়ে জয়সিংহের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হন তিনি। ১৯২৭ সালে ‘প্রফুল্ল’ নাটকে যোগেশের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই প্রথম কোনও সামাজিক নাটকে অভিনয় করলেন তিনি। ১৯২৭ সালে শরৎচন্দ্রের ‘ষোড়শী’ উপন্যাসের নাট্যরূপে জীবানন্দের চরিত্রে তাঁর অভিনয় অনবদ্য হয়েছিল। সেবছরেই রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’ নাটক মঞ্চস্থ করেন তিনি। এই নাটকেই এমন এক কাণ্ড করলেন শিশিরকুমার যা তৎকালীন বাংলা থিয়েটারে অভিনব। দর্শক এবং অভিনেতাদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে শেষ দৃশ্যে সকলকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই যে ছকভাঙার পরীক্ষা তা বাংলা থিয়েটারকে যেন এক কদম এগিয়ে দিল। ১৯২৮ সালে ‘দিগ্বীজয়ী’ নাটকে নাদির শাহ, ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদ চরিত্রে শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখানে উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’র একটি চরিত্র খুঁজে পেতে দেরি হওয়ায় পুনরায় আর্ট থিয়েটারই সে নাটকের অভিনয় করে ফেলে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘পাষাণী’ মঞ্চস্থ করার পর কিছু সংবাদপত্র বলেছিল এ নাটক হিন্দুধর্মে আঘাত হেনেছে। যদিও দর্শক সেকথা কানে না তোলায় খুবই সাফল্য অর্জন করেছিল ‘পাষাণী’ নাটকটি। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’র মতো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী, তবে এসময় অর্থাভাবে নাট্যমন্দির ছেড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী স্টার থিয়েটারেই যোগ দেন তিনি।
১৯৩০ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা দলবল নিয়ে শিশিরকুমারের বিদেশে অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর। বাংলা থেকে এই প্রথম কেউ নাটক নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিল। ২৩ জন কলাকুশলী নিয়ে দুভাগে যাত্রা করেন তাঁরা৷ মিস মার্বারি তাঁদের ড্রেস রিহার্সাল দেখে অর্থ বিনিয়োগে ভয় পেলে কলকাতার বিখ্যাত আলোকশিল্পী সতু সেনের আর্থিক সহযোগিতায় আমেরিকার ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটারে ‘সীতা’ অভিনীত হয় ১৯৩১ সালে। যদিও আড়াই হাজার টাকার লোকসান হয় এবং ঋণ বহন করতে রাজি হন সতু সেন। দেশে ফিরে স্টার, রঙমহল, নাট্যনিকেতন প্রভৃতি জায়গায় তুচ্ছ সব নাটকে অভিনয় করেছেন শিশিরকুমার। ১৯৩৪ সালে বাংলার প্রথম কিশোর নাটক ‘ফুলের আয়না’ মঞ্চস্থ করেন শিশিরকুমার। ১৯৪২ সালে শিশিরকুমার ‘শ্রীরঙ্গম’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পরবর্তীকালে বিশ্বরূপা থিয়েটারে পরিবর্তিত হয়। এখানে কয়েকটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন তিনি। তার মধ্যে ‘মাইকেল’ নাটকের নামভূমিকায় তাঁর অভিনয় ছিল দেখবার মতো। এছাড়াও ‘বিপ্রদাস’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘তখত্-এ-তাউস’, তুলসী লাহিড়ীর ‘দুখীর ইমান’ শ্রীরঙ্গমের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত টানা শ্রীরঙ্গমে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ করে গিয়েছেন তিনি৷ শিশিরকুমারের হাত ধরে বহু প্রতিভাবান অভিনেতা তখন থিয়েটার জগতে এসেছিলেন।
নাট্যাভিনয় ও নাট্যনির্মাণের পাশাপাশি শিশিরকুমার চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তাতে অভিনয়ও করে গিয়েছেন সমান তালে। ১৯৩৭ সালে ‘টকী অফ টকীজ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর পরিচালিত আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হল ‘সীতা’ (১৯৩৩), ‘চাণক্য’ (১৯৩৯), ‘মোহিনী’ (১৯২১), ‘বিচারক’ (১৯২৮) প্রভৃতি। এর মধ্যে অধিকাংশ ছবিতে নিজে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। শোনা যায় শিশিরকুমারই নাকি বিখ্যাত অভিনেত্রী মাধবীকে সিনেমার জগতে নিয়ে এসেছিলেন।
আজীবন শিল্পী হিসেবে অনবদ্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সে পুরস্কার শিশিরকুমার সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন খেতাবের বদলে দেশে একটি জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বেশি খুশি হতেন।
১৯৫৯ সালের ৩০ জুন বরানগরে ৬৯ বছর বয়সে ‘নাট্যাচার্য’ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (সম্পাদক), সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, ১৯৬০, পৃ ৭৪৯
- মণি বাগচী, শিশিরকুমার ও বাংলা থিয়েটার, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, জুন ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৯৭-১৩০
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.indianetzone.com/
- https://www.veethi.com/
2 comments