দ্বিজেন্দ্রলাল

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (Dwijendralal Ray) উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা একজন নাট্যকার, সুরকার এবং সংগীত রচয়িতা যিনি মূলত তাঁর দেশাত্মবোধক গানের জন্য বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন৷ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দ্বিজেন্দ্রলাল ডি.এল.রায় নামেও পরিচিত ছিলেন।  

১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম কার্তিক চন্দ্র রায় এবং মায়ের নাম প্রসন্নময়ী দেবী। বাবা ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের দেওয়ান এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামকরা গায়ক। জন্মসূত্রে তিনি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সংগীত প্রীতি ও সাহিত্যানুরাগ। দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘সুরধনী’ কাব্যে দ্বিজেন্দ্রলালের বাবা কার্তিক চন্দ্র রায়কে ‘অমাত্য-প্রধান’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে । ঠাকুরদা মদনগোপাল রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাপতি। রায়গুনাকর ভারতচন্দ্র রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বর্ণনায় ‘রায় বকসী মদনগোপাল মহামতি’ নামে দ্বিজেন্দ্রলালের ঠাকুরদা মদনগোপালের উল্লেখ আছে। দ্বিজেন্দ্রলালের মা ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের স্ত্রীয়ের নাম সুরবালা দেবী। তাঁদের একাধিক সন্তানের মধ্যে বেঁচেছিলেন কেবল দুই সন্তান – মায়া ও দিলীপ কুমার রায়। দিলীপ কুমার রায় পরবর্তীকালে বাবার মতই বিখ্যাত সুরকার ও গীতিকার হিসেবে বাংলা গানের জগতে অসামান্য অবদান রাখেন।

প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করার পর ১৮৭৮ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন এবং ১৮৮০ সালে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে এফ.এ পাস করার পর হুগলী কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রী লাভ করেন৷ ১৮৮৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাস করেন। সেই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি।এরপর কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে বাড়ির অমতে ইংল্যান্ড যান তিনি কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য। সেখানে  রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় তিনি FRAS , MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করে ১৮৮৬ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন৷ ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়েই দ্বিজেন্দ্রলালের বাবা এবং মায়ের মৃত্যু হয়।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কর্মজীবন শুরু হয় দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে৷ বাংলা, বিহার ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জরিপ ও বন্দোবস্ত, আবগারি, ভূমি রেকর্ডস এবং কৃষি, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে কাজ শুরু করেছেন তিনি। ১৮৯৪ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল আবগারি দপ্তরের প্রথম পরিদর্শক নিযুক্ত হন। ১৮৯৮ সালে জরিপ ও বন্দোবস্ত বিভাগের সহকারি অধিকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ১৯০৩ সাল নাগাদ তিনি খুলনাতে বদলি হয়ে যান৷ এরপরে মুর্শিদাবাদ, কান্দি, গয়া এবং জাহানাবাদেও সরকারি উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন তিনি।১৯০৯ সালে তিনি ২৪ পরগনার উপ-ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯১২ সালে তাঁকে বাঁকুড়া স্থানান্তর করা হয় এবং তিন মাসের মধ্যে তাঁকে আবার মুঙ্গেরে স্থানান্তর করা হলে সেখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতার কারণে তিনি স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের বারো থেকে সতেরো বছর বয়সের মধ্যে লেখা গানের সংকলন ‘আর্যগাথা’র (প্রথম পর্ব) ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই।  ১৮৮৬ সালে তাঁর লেখা ইংরেজি কবিতাগুচ্ছ “Lyrics of Ind” নামে প্রকাশিত হয়৷ দ্বিজেন্দ্রলাল প্রায় শ’পাঁচেক গান রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে প্রেম, নাটক, হাসি ও স্বদেশি গানই মুখ্য। এই পাঁচশো গানের মধ্যে সুর পাওয়া যায় মাত্র একশো বত্রিশটি গানের। দ্বিজেন্দ্রলাল মূলত অমর হয়ে আছেন তাঁর “ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” গানটির জন্য। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি তাঁর প্রতিবাদ তাঁর বহু দেশাত্মবোধক গানে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর তিনি ইতিহাসাশ্রিত, প্রহসন, সামাজিক, পুরাণাশ্রিত নাটক লিখতে শুরু করেন৷ সব মিলিয়ে তিনি মোট একুশটি নাটক লিখেছেন। তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটকগুলি ছিল ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩), ‘প্রতাপ সিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬), ‘নুরজাহান’ (১৯০৮),  ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) ‘সাজাহান'(১৯০৯) প্রভৃতি৷ জাতীয়তাবাদ  ঐতিহাসিক নাটকের মূল বৈশিষ্ট্য হলেও তিনি তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটকে মৌলিকতার প্রমাণ রেখেছেন৷ ঐতিহাসিক নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল বিষয়বস্তু  হিসেবে গ্রহণ করেছেন পাশ্চাত্য ভাবধারাকে। তাঁর লিখিত সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘তারাবাঈ’।  এই নাটকের মূল বৃত্তান্ত রাজস্থান থেকে গৃহীত।  যদিও নাটকটি বঙ্গভঙ্গের আগে রচিত হয়েছিল তবুও এর মধ্যে স্বদেশপ্রেমের অভাব ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য প্রতিভাকে স্বদেশী আন্দোলন কতটা প্রভাবিত করেছিল তার সার্থক পরিচয় পাওয়া যায় ‘প্রতাপসিংহ’ নাটকে। স্বদেশী আন্দোলনের ভূমিকায় বীরশ্রেষ্ঠ প্রতাপ সিংহকে শৌর্য বীর্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি৷ রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে তিনি ‘দুর্গাদাস’ নাটকটি লেখেন। তাঁর লেখা ‘নুরজাহান’ নাটকটি তাঁর জনপ্রিয় নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম।  এই নাটকের নায়িকা নুরজাহানকে তিনি দোষ গুণের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিলিয়ে অসামান্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

সাজাহান দ্বিজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। সাজাহানের অন্তর্দ্বন্দ্ব নুরজাহানের পরিপূরক৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘পরপারে’ (১৯১২) ‘ও বঙ্গনারী’ (১৯১৫)। তাঁর লেখা পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)। এছাড়া তিনি ‘একঘরে’ (১৮৮৯), ‘কল্কি অবতার’ (১৮৯৫),  ‘বিরহ’ (১৮৯৭), ‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২) প্রভৃতি প্রহসন রচনা করেন৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গভীর মনোযোগে সঙ্গে শেক্সপীয়ার, বার্নাড শ প্রভৃতি ইউরোপীয় নাট্যকারদের নাটক পড়তেন যে কারণে তিনি তাঁর নাটককে আধুনিক নাট্যরীতির ধাঁচে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। গিরিশ ঘোষের নাটকে যে ধর্মভাব ও আধ্যাত্মিকতার আবরণ ছিল বাংলা নাটককে তিনি তার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন৷ 

দেশাত্মবোধ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মধ্যে বরাবরই ছিল৷ ১৮৯০ সালে যখন তিনি সরকারের হয়ে কর্মরত সেই সময়, কৃষকদের জমির অধিকার নিয়ে বাংলার গভর্নরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন৷ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দুটি নতুন বাংলা প্রদেশকে পুনরায় একত্রিত করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান লিখেছিলেন যা আজও জনপ্রিয়। তিনি নারীদের উন্নয়নে এবং হিন্দু ধর্মীয় গোঁড়ামি ও আচারের বিরুদ্ধে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক অবস্থানের জন্যও খ্যাত ছিলেন।দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আর্য্যগাথা’র (দ্বিতীয় ভাগ), ‘মন্দ্র’ কাব্য এবং আরও অনেক রচনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পাহাড়’ গানটি শুনে জগদীশচন্দ্র বসু এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে দ্বিজেন্দ্রলালকে তিনি বাঙালির স্বদেশ চেতনা নিয়ে একটি গান লিখতে অনুরোধ করেছিলেন যার ফলশ্রুতি -‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি। দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকার দেবকুমার রায়চৌধুরী লিখেছেন এই গানটি গাইবার সময়ে দ্বিজেন্দ্রলালের রক্তচাপ এতটাই বেড়ে যেত যে বেশ কয়েকবার তিনি অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে পড়েছিলেন।

১৯০৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যসভা ‘পূর্ণিমা মিলন’ বা ‘সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন’। মৃত্যুর আগে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। পরবর্তীকালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হলে তার আখ্যাপত্রে লেখাছিল ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রতিষ্ঠিত’। মৃত্যুর আগেই প্রথম সংখ্যার ‘সূচনা’ লিখে গিয়েছিলেন- ‘আমাদের শাসন-কর্ত্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রমাইকেল পিয়ারেজ পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন’। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে কবিতা ও গানের সংকলন: হাসির গান (১৯০০), মন্ত্র (১৯০২), আলেখ্যা (১৯০,) এবং ত্রিবেণী (১৯১২) প্রভৃতি।  

চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার দুমাসের মধ্যে ১৯১৩ সালের ১৭ মে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যু হয়৷ 

তথ্যসূত্র


  1. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য
  2. https://en.m.wikipedia.org/
  3. https://www.anandabazar.com/
  4. http://en.banglapedia.org/
  5. https://www.anandabazar.com/

5 comments

আপনার মতামত জানান