উইলিয়াম শেক্সপীয়ার

উইলিয়াম শেক্সপীয়ার

উইলিয়াম শেক্সপীয়ার(William Shakespeare) একজন ইংরেজ কবি ও নাট্যকার যাঁকে ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার মনে করা হয়ে থাকে। তিনি ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় কবি’ এবং ‘বার্ড অফ আ্যভন'(Bard of Avon) নামেও পরিচিত। এলিজাবেথীয় যুগের নাট্যকার হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক বিশ্বে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং শ্রেষ্ঠত্ব অব্যাহত রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রধান ভাষায় তাঁর নাটকগুলি অনূদিত হয়েছে।

শেক্সপীয়ারের জন্মের তারিখ সম্পর্কে নানা মতবাদ আছে। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারের স্ট্রাটফোর্ড-আপন-আ্যভন( Stratford-upon-Avon)-এর এক ধনী পরিবারে শেক্সপীয়ারের জন্ম হয় এবং ১৫৬৪ সালে ২৬ এপ্রিল তাঁর ব্যাপ্টিজম অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। তবে ঐতিহ্যগতগত ভাবে শেক্সপীয়ারের জন্মদিন ২৩ এপ্রিল সেন্ট জর্জ দিবসের দিন পালিত হয়ে থাকে। শেক্সপীয়ার ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। তাঁর বাবা’র নাম জন শেক্সপীয়ার এবং মায়ের নাম মেরি আরডেন। শেক্সপীয়ারের বাবা ছিলেন একজন সফল গ্লোভার(গ্লাভস তৈরি করেন যিনি) ও অল্ড্যারম্যান (মেয়রের নীচের পদ)। মা মেরি ছিলেন একজন ধনী বংশের সন্তান। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল স্নিটারফিল্ডে। পরবর্তীকালে জন শেক্সপীয়ার স্ট্রাটফোর্ড -আপঅন -আ্ভনে একটি বড় বাড়ি কিনে চলে আসেন। শেক্সপীয়ার ছোটবেলায় এখানকার ‘কিংস নিউ স্কুল’-এ পড়াশোনা করেছিলেন। এই স্কুলে তিনি ল্যাটিন ব্যাকরণ ও ধ্রুপদী সাহিত্যের বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করেন। মাত্র আঠেরো বছর বয়সে তিনি ছাব্বিশ বছর বয়সের অ্যানি হ্যাথওয়েকে বিয়ে করেন।

উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের যে রচনাগুলি পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে ৩৭টি নাটক ১৫৪টি সনেট, দুটি দীর্ঘ আখ্যান কবিতা এবং আরও কয়েকটি কবিতা। এর মধ্যে কয়েকটি লেখা শেক্সপীয়ার অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছিলেন। তথ্যানুসারে তাঁর নাটকগুলি প্রথম লন্ডনে মঞ্চস্থ হওয়া শুরু হয় ১৫৯১ সাল থেকে। সম্ভবত মঞ্চের প্রয়োজনেই শেক্সপীয়ারের নাটক লেখার সূত্রপাত। ১৫৯২ সালে ইংল্যান্ডে ভয়াবহ প্লেগ রোগ দেখা দিলে দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। অনিবার্যভাবে রঙ্গমঞ্চগুলিও বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে শেক্সপীয়ার রচনা করলেন তাঁর দুটি আখ্যান কাব্য ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’ এবং ‘দি রেপ অব লুক্রেস’। শেক্সপীয়ার ১৫৯৪ সালে ‘লর্ড চেম্বারলিন’ নাট্যগোষ্ঠীতে যোগদান করেন। ‘লর্ড চেম্বারলিন’ নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এই দলটি খুব অল্পসময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে যায়। লন্ডনের অন্যতম প্রধান নাট্য কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং তারা নিজেদের একটি থিয়েটার কিনে ফেলে যার নাম দেয় ‘গ্লোব’(১৫৯৯)। ১৬০৩ সালে রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথম জেমস এই কোম্পানিকে একটি রাজকীয় অধিকার প্রদান করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে ‘কিংস ম্যান’ রাখেন। দলটির মাধ্যমে শেক্সপীয়ারের নাটক ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শেক্সপীয়ার নিজেও কিছু নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেগুলো হলো- ‘এভরি ম্যান ইন হিস হিউমার’, ‘হ্যামলেট’, ‘আ্যজ ইউ লাইক ইট’,’হেনরি সিক্স’ ইত্যাদি। একজন সফল নাট্যকার হিসেবে তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি স্ট্রাটফোর্ডে ‘নিউ হাউস’ নামে একটি বিশাল বাড়ি কিনেছিলেন। এছাড়া লন্ডনেও তাঁর একটি বাড়ি ছিল। শেক্সপীয়ার তাঁর বাবার বহু আকাঙ্খিত পারিবারিক উপাধি ‘কোট অফ আর্মস’ (১৬০৩) পেয়েছিলেন। এছাড়াও শেক্সপীয়ারের নিজস্ব রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছিল। সেখান থেকে তিনি প্রচুর লাভ করতেন। এছাড়া ‘গ্লোব’ থিয়েটারের আংশিক মালিকানা থেকেও তাঁর ভাল আয় ছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৫৮৯-১৬১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত তাঁর নাটকগুলি ছিল মূলত কমেডি এবং ঐতিহাসিক নাটক। এরপর ১৬০৮ সাল পর্যন্ত তিনি কয়েকটি ট্র্যাজেডি রচনা যেগুলির মধ্যে ‘হ্যামলেট’,’ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়র’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । জীবনের শেষ পর্বে তিনি ট্র্যাজি-কমেডি রচনায় মন দিয়েছিলেন। এই রচনাগুলি ‘রোমান্স’ হিসবেও পরিচিত। এই সময় অন্যান্যদের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন। ‘দ্য নোবল কিন্সম্যান’ ছিল তাঁর লেখা শেষ নাটক (১৬১৩)। ঐতিহাসিকদের ধারণা এই নাটকটি শেক্সপীয়ার ও জন ফ্লেচার যুগ্মভাবে লিখেছিলেন। তাঁর নাটকের প্রতিটি চরিত্র এক অসাধারণ সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সৃষ্টির গুণে। ঐতিহাসিক নাটকগুলি শেক্সপীয়ারের ইতিহাসের প্রতি গভীর আগ্রহের প্রমাণ। গ্রিক ও রোমান ইতিহাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তিনি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলো রচনা করেছেন। ঐতিহাসিক নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’, ‘রিচার্ড থ্রি’, ‘হেনরি ফোর’ ইত্যাদি।

‘হেনরি ফোর’ নাটকে রাজ বিদূষকের চরিত্রটি এক অফুরন্ত প্রাণ রসের উৎস যা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। আবার ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে খলনায়ক ব্রুটাস হত্যাকারী ও বিশ্বাসঘাতক হলেও তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব মানসিক দুর্বলতা ও অন্তিম পরিণতি পাঠকের মনকে বিষন্ন করে তোলে। চরিত্র সৃষ্টিতে শেক্সপীয়ারের অসামান্য দক্ষতার পরিচয় তাঁর এই নাটকগুলি। ক্লিওপেট্রাকে মহীয়সী করে তুলেছে তাঁর আত্মত্যাগ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক ‘আ্যন্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’র মূল বিষয় সুন্দরী ক্লিওপেট্রা ও আ্যন্টনির প্রেম। ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ শেক্সপীয়ারের প্রথম ট্র্যাজিক নাটক।ভাষার মাধুর্য ও নাটকীয়তার অসাধারণত্বের জন্য রোমিও-জুলিয়েট যুগ যুগ ধরে মানুষের মন কেড়ে নিয়েছে। মানুষের মানসিক দুর্বলতা থেকে কিভাবে ট্র্যাজেডি রচিত হয় তারই প্রকাশ ঘটেছে শেক্সপীয়ারের বিখ্যাত ট্রাজেডি নাটক ‘ওথেলো’তে। শেক্সপীয়ারের অন্য আরেকটি বিখ্যাত নাটক ‘ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথ সাহসী ও বীর, কিন্তু মানসিক দিক থেকে সে কিছুটা দুর্বল ।তাই স্ত্রীর কথায় চালিত হয়। লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রের দৃঢ়তা, অদম্য মনোবল , দীপ্ত ভঙ্গি আমাদের মুগ্ধ করে। শেক্সপীয়ারের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে তাঁর ‘হ্যামলেট’ নাটকে। এটি তাঁর রচিত দীর্ঘতম নাটক। হ্যামলেট’র মৃত্যু এক বেদনাময় গভীর অনুভূতির স্তরে নিয়ে যায় পাঠককে। শেক্সপীয়ারের শেষের দিকের লেখাগুলো কিছুটা বিচিত্র ধর্মী। এই সময়ে লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ‘দ্য টেমপেস্ট’।

শুধুমাত্র নাট্যকার হিসেবে নয়, কবি হিসেবেও তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রতিটি কবিতাই কাব্যময়তায় উজ্জ্বল। ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’-কবিতায় একদিকে যেমন দেহ-মনের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে, তেমনি ভালবাসার সকরুণ পরিণতিও মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। ‘দ্য রেপ অফ লুক্রেস’ কবিতায় তিনি ‘লুক্রেসের’ যে মানসিক অস্থিরতা তুলে ধরেছেন তা সত্যিই অনবদ্য। ১৬০৯ সালে শেক্সপীয়ারের ‘সনেটস’ প্রকাশিত হয়। এটি ছিল তাঁর চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন। এটি ছিল তাঁর কবিতার জগতে শেষ প্রকাশিত কাজ। শেক্সপীয়ার তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময় এই সনেটগুলো লিখেছিলেন। এই সনেটগুলোর একটি নিজস্ব রীতি আছে। পেত্রার্ক এবং স্পেন্সারীয় রীতির সনেট ছাড়াও তিনি এক নতুন ধরণের সনেট রীতি তৈরি করেন যা ‘শেক্সপীরীয় সনেট’ হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যে খ্যাত।

১৬১০ সালের পর শেক্সপীয়ার অবসর জীবন যাপন করার জন্য চিরদিনের মত লন্ডন শহর, প্রিয় রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে চলে যান নিজের জন্মস্থান স্টাটফোর্ডে। একটিমাত্র নাটক ছাড়া এই পর্বে তিনি আর কিছুই লেখেননি। অবশেষে ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল শেক্সপীয়ারের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।

12 comments

আপনার মতামত জানান