গিরিশচন্দ্র ঘোষ

গিরিশচন্দ্র ঘোষ

বাংলার রঙ্গমঞ্চ ও নাট্য ইতিহাসে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তাঁকে বাংলা থিয়েটারের জনক বলা হয়। তিনি কেবল নাট্যকার ছিলেন না, একাধারে তিনি ছিলেন কবি, পরিচালক ও দক্ষ অভিনেতাও।

গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাগবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নীলকমল ঘোষ ও মাতার নাম রাইমণি দেবী। গিরিশচন্দ্রের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল পাঠশালায়। এরপর হেয়ার স্কুল ও ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতেও তিনি কিছুকাল পড়াশোনা করেছেন। ১৮৬২ সালে পাইকপাড়া স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে ওখানেই গিরিশচন্দ্রের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি হয়ে যায়। পড়াশোনায় ইতি টানলেও সাহিত্যের ওপর গিরিশের আলাদা আগ্রহ ছিল। তাঁর মনে কবি হওয়ার সাধ জেগেছিল পাঠশালায় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবর্ধনা দেখে।
খুব অল্প বয়সে গিরিশ তাঁর মাকে হারান। গিরিশের যখন চোদ্দো বছর বয়স বাবাও মারা গেলেন। এরপর তিনি দাদা ও বোনকেও হারিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর শ্যামপুকুরের নবীন সরকারের মেয়ে, প্রমোদিনী দেবীর সাথে গিরিশের বিয়ে হয়।

বিয়ের পর শ্বশুরমশাই নবীনচন্দ্র ‘অ্যাটকিনশন টিলটন’ কোম্পানিতে গিরিশকে ‘বুক-কিপার’-এর চাকরি জুটিয়ে দিলেন। ফলে নতুন করে গিরিশ আবার পড়াশোনা শুরু করেন। ১৮৬৭ সালে বাগবাজারের যাত্রাদলে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের গীতিকার হিসাবে তাঁর নাট্যজগতে অনুপ্রবেশ ঘটে। এর দুই বছর পর দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকে তিনি অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেন। এই সময় থেকেই তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন ও তার সাথে মঞ্চে অভিনয়ও চালিয়ে যান। অসামান্য মেধার অধিকারী গিরিশ একদিনে একটি গোটা নাটক লিখতে পারতেন। ১৮৭২ সালে তিনি প্রথম নাট্যকোম্পানি ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের জন্য গিরিশ যাঁকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন তিনি নটি বিনোদিনী। নটি বিনোদিনী সেই সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় নটি ছিলেন। নাট্যমঞ্চের নানা ওঠাপড়ার মাঝেই ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যায় যেটি কিনেছিলেন প্রতাপচাঁদ মুহুরি। গিরিশ সেখানে ম্যানেজারি করতেন ১০০ টাকার বিনিময়ে।

ম্যানেজারি করতে করতেই গিরিশ নাটক লেখার কাজ চালিয়ে যান দিনরাত । বিভিন্ন কাব্যকে তিনি সুন্দর ভাবে নাট্যমঞ্চে নাট্যরূপ দিতেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’ মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ইত্যাদি। পৌরাণিক চরিত্রগুলোকেও তিনি নাট্যমঞ্চে সুদক্ষভাবে উপস্থাপন করতেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘সীতার বনবাস’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত এবং উপস্থাপিত ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ‘ছত্রপতি শিবাজি’, ‘সিরাজদৌল্লা’, ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ইত্যাদি। আবার ‘মুকুল মঞ্জরা’ ও ‘আবুহোসেন’-এর মতো কিছু রোম্যান্টিক নাটকও তিনি রচনা ক‍রেছেন। তিনি কেবল অসামান্য নাট্যকারই ছিলেন না, অভিনয় দক্ষতাতেও তিনি কিছু কম ছিলেন না। নাটক ছাড়াও গিরিশচন্দ্র ‘সপ্তমীতে বিসর্জন’, ‘বেল্লিক বাজার’, ‘বড়দিনের বকশিশ’, ‘সভ্যতার পান্ডা’ ও ‘য্যায়সা কি ত্যায়সা’ নামে বেশকিছু প্রহসনও রচনা করেছিলেন।

‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকে নটি বিনোদিনী ‘সতী’ ও গিরিশ ‘দক্ষের’ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের মন জয় করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ রামচন্দ্র ও মেঘনাদ উভয় ক্ষেত্রে অভিনয়ের জন্য সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁকে “বঙ্গের গ্যারিক” আখ্যায় ভূষিত করেন। 

১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে গিরিশ স্ত্রীকে হারান। এরপর আবার বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকেও তিনি শেষ অবধি হারান। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ সাল অবধি প্রায় ২৪ বছর গিরিশচন্দ্র ‘স্টার’, ‘মিনার্ভা’, ‘ক্লাসিক’ ইত্যাদি থিয়েটারে নাটক রচনা ও মঞ্চ পরিচালনা করে গেছেন।জীবনের শেষের দিকে গিরিশ নানা আধ্যাত্মিক ও ধার্মিক বিষয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকটি দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নাটকের শেষে বিনোদিনী ও গিরিশ দুজনকেই ‘তোদের চৈতন্য হোক’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। এঁরা দুজনেই পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। রামকৃষ্ণদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর গিরিশ ঘোষের মধ্যে পরিবর্তন আসে।

১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই কিংবদন্তি মঞ্চাভিনেতা তথা মঞ্চনাটক পরিচালক গিরিশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম  গিরিশচন্দ্রের ‘ভক্ত ধ্রুব’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন। এছাড়াও ১৯৫৬ সালে মধু বসুর পরিচালনায় গিরিশচন্দ্রের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।

6 comments

আপনার মতামত জানান