ঋষি অরবিন্দ নামে পরিচিত অরবিন্দ ঘোষ (Aurobindo Ghose) ছিলেন ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা আধ্যাত্মিক গুরু, দার্শনিক এবং কবি। অগ্নিযুগের একজন বীর বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা অরবিন্দ পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেছিলেন একজন যোগী। রাজনীতির পথ ছেড়ে দর্শনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে তিনি জীবনের এক অন্য মানে খুঁজে নিয়েছিলেন। সাধনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করেছিলেন। পন্ডিচেরিতে নির্মাণ করেছিলেন শ্রী অরবিন্দ আশ্রম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে শ্রী অরবিন্দ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়।
১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় অরবিন্দের জন্ম হয়। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলির কোন্নগরে। তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন একজন ডাক্তার এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রাক্তন সদস্য। তাঁর মা স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন বিখ্যাত লেখক রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে। পারিবারিক পরিবেশ অরবিন্দের চিন্তা এবং চেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
অরবিন্দের বাবা চাইতেন তাঁর সন্তানরা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করুক। সেই সময় সিভিল সার্ভিস পেতে গেলে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক ছিল। সেই কারণে ১৮৭৯ সালে গোটা পরিবার ইংল্যান্ডে চলে যায়। অরবিন্দসহ তাঁর বাকি দুই ভাইকে ম্যাঞ্চেস্টারে (Manchester) রেভারেন্ড ডব্লিউ. এইচ. ড্রেওয়েটের (W. H. Drewett) তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ড্রেওয়েট ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের ল্যাটিন (Latin) ভাষা শেখাতেন। বড় দুই দাদা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেও অরবিন্দ ভর্তি হতে পারেননি কারণ তখনও তাঁর বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মত বয়স হয়নি। ফলে তিনি ড্রেওয়েটের কাছেই ইতিহাস, ফরাসি, ভূগোল এবং অঙ্ক শিখতে থাকেন। ১৮৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অরবিন্দ ও তাঁর ছোটো ভাই সেন্ট পলস বিদ্যালয়ে (St. Paul’s School) ভর্তি হন। তিনি কেমব্রিজের কিংস কলেজ (King’s College) থেকে বৃত্তিসহ পাশ করেন।
অরবিন্দ সিভিল সার্ভিসে অরবিন্দ ২৫০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একাদশতম হন। তবে তাঁর সিভিল সার্ভিসে কোনো রকম আগ্রহ ছিলনা। তিনি ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় ইচ্ছাকৃত দেরি করে পৌঁছেছিলেন যাতে তিনি প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে যান। ১৮৯৩ সালে তাঁকে প্রথমে বরোদা রাজ্যের শাসনভার দিয়ে পাঠানো হয়। এখানে তাঁর কাজ ছিল সমীক্ষা এবং ভূমি বন্দোবস্ত বিভাগে। পরে তাঁকে রাজস্ব বিভাগে এবং তারপরে তাঁকে সচিবালয়ে পাঠানো হয়। এর পাশাপাশি ১৮৯৭ পর্যন্ত তাঁকে আরও বিভিন্ন কাজ করতে হত, যেমন- ব্যাকরণ পড়ানো, গায়েকোয়াড়ের মহারাজের জন্য বক্তব্য লিখে দেওয়া ইত্যাদি। ১৮৯৭ সালের পরে তিনি বরোদা কলেজে (Baroda Collge) বর্তমানে যার নাম মহারাজা সয়াজীরাও ইউনিভার্সিটি অফ বরোদা পার্ট টাইম ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছিলেন। পরে তাঁকে সহ-উপাচার্যের পদ দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতীয় এবং বিদেশি ভাষা মিলিয়ে তিনি সর্বমোট ১২ টি ভাষা জানতেন।
বরোদায় থাকাকালীন দেশের উত্তাল পরিস্থিতি তাঁকে প্রভাবিত করে। তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। বাংলা ও মধ্যপ্রদেশের বেশ কিছু বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে তিনি গোপনে যোগাযোগ করা শুরু করেন। বালগঙ্গাধর তিলক (Lokmanya Tiak) এবং ভগিনী নিবেদিতার (sister Nibedita) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি মাঝে মাঝেই বরোদা এবং বাংলায় যাতায়াত করতেন। ১৯০১ সালে কলকাতায় এলে তাঁর বিয়ে হয় ভূপালচন্দ্র বোসের ১৪ বছর বয়সী মেয়ে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯০৬ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। প্রত্যক্ষভাবে তিনি নরমপন্থী রাজনীতির সমর্থক হলেও কিন্তু পরোক্ষে সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতেন যাতে স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা যায়। তাঁর ভাই বারীনের সাহায্যে বাঘাযতীন, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
১৯০৬ সালে দাদাভাই নৌরজির নেতৃত্বে হওয়া কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনে বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে তিনিও চরমপন্থার আদর্শে নেতৃত্ব দেন। ১৯০৭-০৮ সাল নাগাদ নাগাদ তিনি পুনে, মুম্বাই, বরোদায় ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাতে থাকেন এবং জাতীয়তাবাদের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। ১৯০৮ সালের মে মাসে আলিপুর বোমা মামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ইংরেজিতে ‘কর্মযোগী’ (Karmayogin) এবং বাংলায় ‘ধর্ম’ (Dharma) এই দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
উত্তরপাড়ায় দেওয়া একটি বক্তৃতায় আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি তাঁর আকৃষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছিল। ১৯১০ সালে রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সেই বছরের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে তিনি পন্ডিচেরিতে চলে যান। আলিপুর বোমা মামলায় জেলে যাওয়ার পরে জেলে বসেই তাঁর চিন্তাভাবনা পরিবর্তিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। তিনি জানিয়েছিলেন যে আলিপুর জেলে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নিজের আত্মজীবনীতে অরবিন্দ লিখেছেন যে ১৯০৭ সালে বারিন তাঁকে মহারাষ্ট্রের এক যোগী বিষ্ণু ভাস্কর লেলে-এরসঙ্গে দেখা করান, যিনি তাঁকে নিজের মধ্যে থাকা গুরুর ওপর নির্ভর করার কথা বলেন। এই যোগীর প্রভাব তাঁর ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছিল বলে মনে করা হয়।
পন্ডিচেরিতে গিয়ে অরবিন্দ নিজেকে আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক জগতের মধ্যে বন্দী করে ফেলেন। চার বছরের নির্জন যোগাভ্যাসের পর ১৯১৪ সালে তিনি একটি মাসিক দার্শনিক পত্রিকা শুরু করেন যার নাম ‘আর্য’ (Arya)। আধ্যাত্মিক জীবনে পদার্পন করার পরে তিনি এই সংক্রান্ত প্রচুর বই লেখেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, ‘দ্য লাইফ ডিভাইন’ (The Life Divine), ‘দ্য সিন্থেসিস অফ যোগা’ (The Synthesis of Yoga), ‘এসেজ অন দ্য গীতা’ (Essays on the Gita), ‘দ্য সিক্রেট অফ দ্য বেদ’ (The Secret of the Veda), ‘দ্য উপনিষদস’ (The Upanishads), ‘দ্য রেনেশাঁস ইন ইন্ডিয়া’ (The Renaissance in India), ‘ওয়ার অ্যান্ড সেলফ-ডিটারমিনেশন’ ( War and Self-determination), ‘দ্য হিউমান সাইকেল’ (The Human Cycle), ‘দ্য ফিউচার পোয়েট্রি’ (The Future Poetry) ইত্যাদি। মুক্ত ছন্দে লেখা ২৪০০০ পঙক্তির ‘সাবিত্রী’ কবিতাটি তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য।
শুরুর দিকে পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের কিছু সংখ্যক অনুগামী ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলস্বরূপ ১৯২৬ সালে পন্ডিচেরিতে গরে ওঠে শ্রী অরবিন্দ আশ্রম (Sri Aurobindo Ashram)। ১৯২৬ সাল থেকেই অরবিন্দ নিজেকে শ্রী অরবিন্দ বলে পরিচয় দিতে থাকেন।
১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে পন্ডিচেরিতেই এই স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা আধ্যাত্মিক-দার্শনিক যোগগুরুর মৃত্যু হয়।
6 comments