ব্রিটিশ শাসিত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত সংগঠিত আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলা সহ ভারতের সর্বত্র গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন ব্রিটিশ অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা করা শুরু হয় এবং তার পাশাপাশি বোমা তৈরি শুরু হয়। ফলে বোমা নিক্ষেপ করে হত্যার ষড়যন্ত্রই বিপ্লবীদের কাছে প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ইতিহাসে এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল মেদিনীপুর বোমা মামলা । মেদিনীপুরের গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির কথা ইতিহাসে বিখ্যাত, সেই সঙ্গে বিখ্যাত মেদিনীপুরের বিপ্লবীরাও। আলিপুর বোমা মামলার মতো এখানেও বোমা আবিষ্কারের ফলে সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল এই মামলা।
১৯০৮ সালে শুরু হয় এই মেদিনীপুর বোমা মামলা এবং ১৯০৯ সালে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। মেদিনীপুর বোমা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্রলাল খান, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যোগজীবন ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সন্তোষকুমার দাশ প্রমুখ। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ওয়েস্টনকে হত্যার মিথ্যা মামলায় তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং মেদিনীপুরের সেশন আদালতে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর মিস্টার ওয়েস্টন, বেঙ্গল পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মৌলভি মাজ্হারুল হক এবং ইন্সপেক্টর বাবু লালমোহন গুহ।
এই মামলার আগে আগে কিংসফোর্ড হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী। এর পরে ব্রিটিশ পুলিশরা স্বভাবতই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের একের পর এক জেরা করতে থাকেন। নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো শুরু হয়। বিপ্লবীদের মধ্যেও সতর্কতার বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। মেদিনীপুরে নাড়াজোল রাজবাড়ি এই মামলার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলা যায়। নাড়াজোলের রাজপরিবারের সন্তান নরেন্দ্রলাল খান প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবীদের অভিযানে সহায়তা করতেন এবং নানাভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। স্বদেশিয়ানার প্রভাবে বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তিনি। তাঁর পাশাপাশি এই আন্দোলনে সঙ্গী হন রাজনারায়ণ বসুর ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রমোহন বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখ। এই নাড়াজোল রাজবাড়ির ভিতরেই বিপ্লবীদের এক গোপন আস্তানা ছিল। এখানেই পুলিশের চোখের আড়ালে কড়া সতর্কতার মধ্যে বোমা তৈরি ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ চলতো। হেমচন্দ্র কানুনগো বোমা তৈরি শিখে এসে এই বাড়িতেই বোমা বানানো শেখাতেন। ‘যুগান্তর’ দলের অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ সকলেই এই বাড়িতে এসে সভা করতেন। বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার জন্য এই বাড়িটি ছিল আদর্শ জায়গা। চারপাশে ঘন জঙ্গল থাকায় বাড়িতে সন্দেহভাজন কাউকে খুঁজে পাওয়া পুলিশের দুঃসাধ্য ছিল। ১৯০৮ সালের ৩ মে তারিখে তৎকালীন পুলিশ সুপার মিস্টার কার্ণিশ সমগ্র মেদিনীপুরে খানা তল্লাশি শুরু করেন এবং উপেন্দ্রনাথ ঘোষ, কালিদাস মহাপাত্র, শীতলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পিয়ারিলাল দাসের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। নিকটবর্তী হনুমানজির মন্দিরেও তল্লাশি চালানো হয়। মূলত ছয়টা স্থানে এই দিন তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু তল্লাশি চালানোর কারণ কী বা ঠিক কী সন্দেহে এই তল্লাশি তা কারও কাছে পরিষ্কার ছিল না। আলিপুর বোমা মামলার সঙ্গে সংযুক্ত বা সম্পর্কিত আরো কোন গোপন ষড়যন্ত্রের হদিশ পেতেই এই তল্লাশি করা হয়েছিল বলে অনেক পুলিশ ইন্সপেক্টর জানিয়েছিলেন। ৭ জুলাই রাত্রে পিয়ারিমোহন দাসের বাড়ি তল্লাশি চালানোর জন্য সার্চ-ওয়ারেন্ট বের করেন মৌলভী মাজহারুল হক এবং এই তল্লাশির খবর মি. নেলসনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৮ জুলাই সকালবেলায় পিয়ারিমোহন দাসের গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলা হয় সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে। বাড়িতে পিয়ারিমোহন দাসের স্ত্রী বসন্ত কুমারী দেবী এবং তিন পুত্র আশুতোষ, সন্তোষ ও পরিতোষ উপস্থিত ছিল। অনেকক্ষণ খোঁজার পরে বাড়ির বৈঠকখানা থেকে পাওয়া যায় একটি বোমা। আর এই বোমা তৈরি বা নিক্ষেপের পরিকল্পনাকারী সন্দেহে সন্তোষকুমার দাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সহকারী পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্ট মিস্টার ব্রেটের অধীনে এই সমগ্র তল্লাশি চালানো হয়। সেই বোমাটি মিস্টার ওয়েস্টনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মেদিনীপুরের সিভিল সার্জেন ক্যাপ্টেন ওয়েইনম্যান সেই বোমাটি খোলেন। দেখা যায় বোমার মধ্যে হলদে-বাদামি রঙের গুঁড়ো রয়েছে যা আসলে আর্সেনিক সালফাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরেটের মিশ্রণ। এই মিশ্রণের সাহায্যে তখন হাতবোমা তৈরি হত। ২৩ জুলাই পর্যন্ত জেলে বন্দি রাখা হয় সন্তোষ কুমার দাসকে। ২৯ জুলাই সন্তোষের বয়ান সংগ্রহ করা হয়। এর আগে ২৬ জুলাই মৌলভি মাজহারুল হকের বাড়ির পিছনে নর্দমায় আরেকটি বোমা আবিষ্কার করা হয়। তারপর ৩১ জুলাই বাবু লালমোহন বরোদা দত্ত ও সারদা দত্তের কাছারিঘর থেকে আরও একটি বোমা আবিষ্কার করা হয়। সেই দিনই পুলিশ গ্রেপ্তার করে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে যাদের মধ্যে বরোদা প্রসাদ দত্ত, সারদা প্রসাদ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন ব্যানার্জি, নিরাপদ মুখার্জি, মধুসূদন দত্ত, শ্যাম লাল সাহা এবং সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জী ছিলেন উল্লেখযোগ্য। পরে ২৮ ও ২৯ আগস্ট আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাবু অবিনাশ চন্দ্র মিত্র, বাবু উপেন্দ্র নাথ মাইতি এবং নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান। মেদিনীপুর বোমা মামলায় মোট ১৫৪ জন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। নরেন্দ্রলাল খানকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেলে বন্দি করে রাখা হয়, জামিন মেলেনি তাঁর। পরে তাঁকেও বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ওয়েস্টনকে হত্যার মিথ্যা মামলায় তাঁদের সকলকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ৪ নভেম্বর এই মামলা শুরু হলে অ্যাডভোকেট-জেনারেল মিস্টার সিন্হা সন্তোষ কুমার দাস, জগজীবন ঘোষ এবং সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জীকে ছাড়া বাকি সকলকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। এই তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধেই ‘বিস্ফোরক পদার্থ আইন’ রুজু করে মামলা শুরু হয়।
১৯০৯ সালে মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয় যেখানে সন্তোষ কুমার দাস, জগজীবন ঘোষ এবং সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জীকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়।