হুগলী

হুগলী জেলা

আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ২৩টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল হুগলী জেলা ।

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বর্ধমান বিভাগের একটি জেলা হল হুগলী৷ প্রশাসনিক কারণে বর্ধমানের দক্ষিণাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৭৯৫ সালে ইংরেজদের দ্বারা হুগলি জেলা তৈরি হয়েছিল যখন হাওড়া তখনও হুগলী জেলার অংশ ছিল। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল নদী, খাল, বিল অধ্যুষিত ছিল। একটা সময় ছিল যখন এই অঞ্চল ছিল কৈবর্ত ও বাগদিদের আবাসস্থল। আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থেও হুগলি নামের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। মঙ্গলকবি বিপ্রদাস পিল্লাইয়ের রচিত মনসামঙ্গল কাব্যেও হুগলী নামের উল্লেখ দেখা যায়। হুগলী নদী এই জেলার পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গেছে৷ হুগলী নদী ছাড়াও এই জেলার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হল দামোদর নদ৷

কিভাবে এই হুগলী নামকরণ হল এ সম্পর্কে নানা মত থাকলেও তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সপ্তগ্রাম বন্দরের যাতায়াতের পথে একটি গ্রাম্য জনপথের নদীর ধারে প্রচুর হোগলা গাছ জন্মেছিল। নদী পথে যাতায়াতের সময় পাশের গ্রামের নাম জানতে চায় কোন এক নাবিক। সাহেব নদীর তীরে হয়ে থাকা গাছের নাম জানতে চাইছেন এমন ধারণা থেকে উত্তর দেওয়া হয়েছিল ‘ হোগলা ‘। তবে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল কিনা তার কোন তথ্যপ্রমাণ নেই৷ জেলাটির নামকরণ নিয়ে আরও জানতে এখানে দেখুন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে এই জেলার উত্তরে অবস্থান করছে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে আছে বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশ , দক্ষিনে হাওড়া জেলা এবং পূর্ব দিকটিকে ঘিরে রেখেছে নদীয়া জেলা। এর পূর্ব দিক বরাবরই বয়ে গেছে হুগলী নদী।

 ৩১৪৯ বর্গমিটার স্থান জুড়ে হুগলী জেলা অবস্থিত, আয়তনের বিচারে পশ্চিমবঙ্গে জেলাটি চতুর্দশতম স্থান অধিকার করে৷ ২০১১ সালের জনগননা অনুসারে প্রায় ৫৫২০৩৮৯ জন লোক বসবাস করেন৷এই জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাই বেশী প্রায় ৮৭.৪৯%। এছাড়া হিন্দী (৭.৭৭%), উর্দু (১.৭২%), সাঁওতালী (২.৩৭%) ভাষার মানুষের বসবাসও রয়েছে৷ হুগলী জেলাটির চারটি মহকুমা রয়েছে চুঁচুড়া সদর, চন্দননগর, শ্রীরামপুর, ও আরামবাগ।

পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে হুগলী জেলাটি বেশ উন্নত। এখানে হুগলী নদীর উভয় তীরে পাট-শিল্পের  বিকাশ ঘটেছে৷ ত্রিবেণী, ভদ্রেশ্বর, চাপদানী, শ্রীরামপুরে গড়ে উঠেছে জুট মিল৷ ভারতবর্ষের সব থেকে বড় মোটর নির্মাণ কারখানা ‘ হিন্দুস্তান মোটর প্লান্ট’ গড়ে উড়েছে এই জেলার উত্তরপাড়াতে৷ এই জেলা অর্থনীতি ও শিল্পে উন্নত হলেও জেলার ৫০% মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। এই জেলার অন্তর্গত আরামবাগ মহকুমা ও জাঙ্গীপারা, পাণ্ডুয়া, ধনিয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলগুলি মূলত কৃষি ভিত্তিক। 

হুগলী জেলায়  বেশ কিছু প্রসিদ্ধ স্থান আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – কামারপুকুর যেটি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত। অপর একটি বিখ্যাত স্থান হল তারকেশ্বর। এখানে শিবের একটি মন্দির আছে এবং শ্রাবণ মাসে বহু পূণ্যার্থী সমাগমে এই মন্দির গমগম করে। এই জেলার শ্রীরামপুর বিখ্যাত সেখানকার রথযাত্রার জন্য। ব্যান্ডেলে অবস্থিত ব্যান্ডেল চার্চ যেটি পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম চার্চের মধ্যে অন্যতম৷ এছাড়া সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান দেবানন্দপুর গ্রামে ৷ এইসব ছাড়াও হুগলী জেলার বিভিন্ন স্থান ধূসর ইতিহাসের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে আছে৷ হুগলী জেলার চন্দননগর ছিল একসময় পর্তুগিজদের ঘাঁটি। চন্দননগর হুগলী জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর৷

এই জেলায় যে স্থাপত্যগুলি বিখ্যাত সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হংসেশ্বরী মন্দির, আঁটপুর রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দির, হুগলীর ইমামবাড়া প্রভৃতি৷

11 comments

আপনার মতামত জানান