তারকেশ্বর ভ্রমণ

তারকেশ্বর ভ্রমণ

আপামর হিন্দু বাঙালিদের কাছে তারকেশ্বর একটি আবেগের নাম। জায়গাটি মূলত একটি শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। সেটি হল তারকনাথ মন্দির। আপামর বাঙালির কাছে তারকেশ্বর আর তারকনাথ মন্দির অভিন্ন। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গকে স্বয়ম্ভু বলা হয় । অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এখানে শিব স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছিলেন। গোটা বাংলার শিবভক্ত মানুষদের কাছে তারকেশ্বর মন্দিরের আকর্ষণ চিরন্তন। শ্রাবণ মাসে দূর দূর থেকে ভক্তেরা আসেন। যারা মানত করে থাকেন, তাঁরা পায়ে হেঁটে মন্দিরে এসে বাবার মাথায় জল ঢালেন। এছাড়াও এখানের মালিয়া পার্ক স্থানীয় মানুষদের কাছে জনপ্রিয় পিকনিক স্পট।

তারকনাথ মন্দির। ছবি সববাংলায়

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় অবস্থিত তারকেশ্বর শহরটি কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে তারকেশ্বরে তারকনাথ মন্দিরের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, ১৭২৯ সালে রাজা বিষ্ণুদাসের ভাই ভারমল্লা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সহোদর গোস্বামীর ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে, কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ দাসের ‘শিবায়ণ’ কাব্যে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কলকাতা থেকে বিভিন্নভাবে তারকেশ্বর যাওয়া যায়। সব থেকে সহজ উপায়টি হল ট্রেন পথ। হাওড়া স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে করে তারকেশ্বর স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়। ট্রেনে সময় লাগবে মাত্র দেড় ঘণ্টা। সারাদিন ধরে প্রচুর লোকাল ট্রেন রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব গাড়িতে করেও যাওয়া যায়। সময় লাগবে প্রায় দুঘণ্টা। স্থানীয়দের কাছে মালিয়া পার্ক জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। মালিয়া পার্ক যেতে চাইলে মালিয়া হল্ট স্টেশন নামতে হবে। এই স্টেশন থেকে মালিয়া পার্কের দুরত্ব মোটামুটি এক কিলোমিটার। তারকনাথ মন্দির এবং মালিয়া পার্কের মধ্যে দুরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার।

তারকনাথ মন্দিরের ঠিক বাইরেই প্রচুর ছোট বড় হোটেল রয়েছে। সেগুলি সকল প্রকার মানুষের সাধ্যের মধ্যেই। মাত্র ১০০ টাকা থেকে এখানে হোটেল পাওয়া যায়। অনলাইনে হোটেল সেইভাবে বুক হয় কিনা আগে থেকে দেখতে হবে, কারণ বেশিরভাগ হোটেলই ওখানে গিয়েই বুক করে লোকে। হোটেলে থাকলেও তাদের থেকে পাণ্ডা বা পূজার সামগ্রী নেবেন না। তারা অযথা বেশি দাম নেয়। কথা ভালভাবে না বলে নিলে পূজা শেষে প্রচুর টাকা চাইবে। যারা একদিনের জন্য গিয়ে দুধপুকুরে স্নান করে জামা পালটানোর জন্য ঘরের ভাড়া করেন, শুরুতে খুব কম ভাড়া বললেও পূজার সামগ্রী, পাণ্ডা এইসব ধরে প্রচুর টাকা দাবি করে। তাই সেসব হতে খুবই সাবধান। সবচেয়ে ভাল নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়া, তার ফলে জুতো রাখা বা স্নান করার পর ঘর নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, ফলে মাত্রাতিরিক্ত দাম দেওয়ার কোন প্রয়োজনই নেই। আর মালিয়া পার্কে থাকতে চাইলে কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতিতে থাকা যায়। তবে এই ঘর বুক করতে চাইলে বড়বাজারের অফিসে যোগাযোগ করতে হবে, ওখানে গিয়ে বুক করা যাবে না।

তারকেশ্বরে প্রধান দ্রষ্টব্য তারকনাথ মন্দির। এছাড়া মালিয়া পার্ক এখানে স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় একটি পার্ক।

দুধপুকুর। ছবি সববাংলায়

তারকনাথ মন্দির – এই মন্দির হিন্দুদের কাছে অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান বলে পরিগণিত হয়। মন্দিরটি আটচালা স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। মন্দিরের শিবলিঙ্গকে স্বয়ম্ভু বলা হয় কারণ বিশ্বাস করা হয় তারকনাথকে কেউ নির্মাণ করে স্থাপন করেননি। গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ রয়েছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এই শিবলিঙ্গকে সাধারণ শিলাখণ্ড মনে করে সেই শিবলিঙ্গের মাথায় একসময় স্থানীয় মহিলারা ধান ঝাড়ত বলে শিবলিঙ্গের মাথায় গর্ত হয়েছিল যা আজও লক্ষ করা যায়। গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হলে পুরুষদের খালি গায়ে প্রবেশ করতে হবে। পুরোহিত দিয়ে পূজা করাতে চাইলে পাণ্ডাদের থেকে প্রচণ্ড সাবধান। পুজো দেওয়ার আগে ভালভাবে কথা বলে দিন ডালির দাম কত বা কত দক্ষিণাতে , কী পুজো করবে ইত্যাদি। কথা ভালভাবে না বলে নিলে পূজা শেষে প্রচুর টাকা চাইবে। যাঁরা শুধু বাবার মাথায় জল ঢালার উদ্দেশ্যে আসেন, তাঁরা নির্দ্বিধায় পাণ্ডা ছাড়াই গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারেন। গর্ভগৃহে যাবার জন্য আপনাকে পাণ্ডার সাহায্য নিতেই হবে এমন নয়। শিব মন্দিরের সামনে একটি নাট মন্দির আছে। শিব মন্দিরের পাশাপাশি কালী ও লক্ষ্মী নারায়ণের মন্দির আছে। শিব মন্দিরের উত্তর দিকে দুধপুকুর নামে একটি পুকুর আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে এই পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করলে সকল মনস্কামনা পূর্ণ হয়। পুকুরে নেমে বেশিদূর যাবেন না। মন্দিরটি সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে এবং বিকাল ৪ টে থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

মালিয়া পার্ক। ছবি সববাংলায়

মালিয়া পার্ক – তারকেশ্বরের স্থানীয় মানুষদের কাছে জনপ্রিয় পিকনিক স্পট হল মালিয়া পার্ক। তারকনাথ মন্দিরে যাবার পথে যাত্রীরা এই পার্কে বিশ্রাম নেয়। শ্রাবণ মাসে সুন্দর আয়োজন থাকে। বিশ্রামের জায়গা বেশ বড় প্রশস্ত। শিবের বড় একটি মূর্তি রয়েছে, এবং রয়েছে বিশালাকার হনুমান মূর্তি। এছাড়াও মনিষীদের মূর্তি এবং অন্যান্য সুন্দর স্থাপত্যে ভরা এই পার্ক। এর ভেতরে বাচ্চাদের জন্য আলাদা শিশুউদ্যান রয়েছে। সেই শিশুউদ্যানটি শীতকালে ১২টা থেকে ৫টা এবং অন্য সময়ে দুপুর ৩টে থেকে ৬ টা অবধি খোলা থাকে। শিশুউদ্যানটির ভিতর নাগরদোলা, ট্রয়ট্রেন, ইত্যাদির আলাদা করে টিকিট নিতে হয়। বাইক ও গাড়ি রাখার জন্য প্রচুর জায়গা আছে। এখানে বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া যায়,তাছাড়া এখানেও খাবার পাওয়া যায়। পার্কের পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে থাকতে চাইলে রুম পাওয়া যায়। তবে এই ঘর বুক করতে চাইলে বড়বাজারের অফিসে যোগাযোগ করতে হবে, ওখানে গিয়ে বুক করা যাবে না।

সারা বছরই এই মন্দিরে ভক্তদের সমাগম হয়। তবে সোমবার শিবঠাকুরের পুজোর সবথেকে ভালো দিন। তাই সোমবার ভক্তেরা অপেক্ষাকৃত বেশি আসে। শিবরাত্রির সময় প্রচুর ভক্তেরা এখানে আসে। শ্রাবণ মাস শিবভক্তদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র মাস। তাই সারা শ্রাবণ মাস জুড়েই মন্দিরে ভিড় থাকে। এছাড়াও গাজন উৎসবের সময়ও ভক্তদের ভিড় থাকে। এইসব সময়গুলো ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে একদম ভোরবেলায় এখানে পৌঁছতে পারলে ভালভাবে ফাঁকায় বাবা তারকনাথের দর্শন করা যায়।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – হাওড়া স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে করে তারকেশ্বর স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়। স্টেশন থকে মন্দির দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। মালিয়া পার্ক যেতে চাইলে মালিয়া হল্ট স্টেশন নামতে হবে। এই স্টেশন থেকে মালিয়া পার্কের দুরত্ব মোটামুটি এক কিলোমিটার। তারকনাথ মন্দির এবং মালিয়া পার্কের মধ্যে দুরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
  • কোথায় থাকবেন – তারকনাথ মন্দিরের ঠিক বাইরেই প্রচুর ছোট বড় হোটেল রয়েছে। মালিয়া পার্কে থাকতে চাইলে কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতিতে থাকা যায়।
  • কী দেখবেন – তারকনাথ মন্দির, মালিয়া পার্ক।
  • কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। শ্রাবণ মাসে প্রচুর ভিড় হয়।
  • সতর্কতা
    • তারকনাথ মন্দিরটি সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে এবং বিকাল ৪ টে থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
    • মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে।
    • গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হলে পুরুষদের খালি গায়ে প্রবেশ করতে হবে।
    • পাণ্ডাদের থেকে প্রচণ্ড সাবধান। পুজো দেওয়ার আগে ভালভাবে কথা বলে দিন ডালির দাম কত বা কত দক্ষিণাতে কি পুজো করবে ইত্যাদি। কথা ভালভাবে না বলে নিলে পূজা শেষে প্রচুর টাকা চাইবে।
    • দুধপুকুরে নেমে বেশিদূর যাবেন না।
    • মন্দিরের যেখানে সেখানে বা দুধপুকুরে ধূপের প্যাকেট বা নোংরা আবর্জনা ফেলবেন না।
    • মন্দিরের ভেতরে ছবি তুলবেন না।
    • মালিয়া পার্কটি বুধবার বন্ধ থাকে।
    • মালিয়া পার্কের মূল শিশুউদ্যানটি শীতকালে ১২টা থেকে ৫টা এবং অন্য সময়ে দুপুর ৩টে থেকে ৬ টা অবধি খোলা থাকে।
    • মালিয়া পার্কে থাকতে চাইলে কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতিতে থাকা যায়। তবে এই ঘর বুক করতে চাইলে বড়বাজারের অফিসে যোগাযোগ করতে হবে, ওখানে গিয়ে বুক করা যাবে না।
  • বিশেষ পরামর্শ
    • শ্রাবণ মাস ছাড়া অন্য মাসের একদম ভোরবেলায় নিজের গাড়ি করে এখানে পৌঁছতে পারলে ভালভাবে ফাঁকায় বাবা তারকনাথের দর্শন করা যায়। নিজের গাড়ি থাকার ফলে জুতো রাখা বা স্নান করার পর ঘর নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, ফলে মাত্রাতিরিক্ত দাম দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
    • মন্দিরে নিয়ে যাবার জন্য বেশ কিছু লোক মন্দিরে যাবার রাস্তাতেই আপনাকে ধরবে, কিন্তু তাদের কথা শুনবেন না। একইভাবে হোটেলে থাকলেও তাদের থেকে পাণ্ডা বা পূজার সামগ্রী নেবেন না। তারা জল, ফুল, মোমবাতির মতো পূজার উপকরণ বিশাল দামে বেচে। পূজার সামগ্রী নিজে নিয়ে যাবেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে যাবার জন্য আপনাকে এদের থেকেই সামগ্রী নিতে হবে এমন নয়।

তথ্যসূত্র


  1. নিজস্ব প্রতিনিধি
  2. https://www.wbtourism.gov.in/

আপনার মতামত জানান