মার্টিন কুপার

মার্টিন কুপার

বর্তমান মানবসভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে মোবাইল ফোন, যেটি ছাড়া মানুষ তার দিনের শুরু এবং শেষ কল্পনা করতে পারে না সেই অত্যাশ্চর্য যোগাযোগের যন্ত্রটির আবিষ্কর্তা হলেন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার (Martin Cooper)। মোবাইল ফোন ছাড়াও বেতার যোগাযোগের সঙ্গে জড়িত অনেকগুলি প্রকল্পে কাজ করেছিলেন তিনি৷ রেডিও নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক লাইট সিস্টেম, হ্যান্ডহেল্ড পুলিশ রেডিও ইত্যাদি যন্ত্র তৈরির অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন মার্টিন কুপার। এককালে নৌবাহিনীর সাবমেরিন অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কুপার। বিখ্যাত মোবাইল ফোন কোম্পানি মোটোরোলা-র ডিভিশন ম্যানেজার ছিলেন তিনি। মোবাইল ফোন আবিষ্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন কুপার।

১৯২৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের অন্তর্ভুক্ত শিকাগোতে ইউক্রেনীয় ইহুদী অভিবাসী পরিবারে মার্টিন কুপারের জন্ম হয়৷ কুপারের বাবার নাম আর্থার কুপার এবং মায়ের নাম মেরী কুপার। মার্টিনের এক ভাই ছিল, উইল কুপার, যিনি তাঁর থেকে তিন বছরের ছোট ছিলেন। শৈশবের বছরগুলোতে মার্টিন তাঁর পরিবারের সাথে কানাডার উইনিপেগে থাকতেন। ছোট থেকেই কুপার একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ ছিলেন। কোনো জিনিস কীভাবে কাজ করে তা বের করবার চেষ্টা করতেন। নিজের কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য মাঝে মাঝে ভীষণই উদগ্র হয়ে উঠতেন এমনকি জিনিসপত্র ভাঙচুরও করতেন তিনি। একদিন মার্টিন দেখতে পেলেন একদল ছেলে আতস কাচের মধ্য দিয়ে কাগজের উপর সূর্যের রশ্মি ফোকাস করে কাগজের টুকরোটিকে পোড়াচ্ছে। মার্টিন এটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মার্টিনের কাছে কোনো আতস কাচ না থাকায় সেই ছোট বয়সেই একটি কাচের সোডা বোতল ভেঙে নিজস্ব আতস কাচ তৈরির চেষ্টা করেন  তিনি। মার্টিনের যখন নয় বছর বয়স, তখন ঘর্ষণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। এমনকি ট্রেনকে আরও উন্নত করে তুলতে চুম্বক ব্যবহারের কথা সেই অল্প বয়সেই ভাবতে শুরু করেন তিনি।

শিকাগোর লসন এলিমেন্টারি স্কুল থেকে মার্টিন কুপার তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। পড়াশুনা খুবই উপভোগ করতেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষার পার্ট চুকিয়ে এরপর মার্টিন শিকাগোর ক্রেন টেকনিক্যাল হাই স্কুলে যোগ দেন। এখানে দু’জন শিক্ষকের সাথে পরিচয় হয় তাঁর, যাঁরা তাঁর জীবনে ভীষণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন মিস্টার কিনি এবং ইংরেজির শিক্ষক মিস করিগান। স্কুল শিক্ষা শেষে মার্টিন প্রবেশ করেন শিকাগোর ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। প্রাথমিকভাবে তিনি পদার্থবিদ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে বুঝতে পেরেছিলেন রসায়নে ভাল না হলে পদার্থবিদ হওয়া অসম্ভব এবং বাস্তবিক রসায়নে খুব একটা দক্ষ ছিলেন না তিনি। ফলত তিনি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলেন এবং ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়বেন বলে মনস্থির করলেন। ১৯৫০ সালে এই ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি আইআইটি থেকে এই একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংঘটিত কোরিয়ান যুদ্ধের সময় কুপার দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে থাকা আমেরিকার নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে সাবমেরিন অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য পরিষেবার জন্য কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি সিংম্যান রি-এর কাছ থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি ইউনিট প্রশংসাপত্র পদক পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে, মার্টিন নিউ লন্ডনের একটি সাবমেরিন স্কুলে ভর্তি হন এবং  পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তাঁকে আমেরিকান সাবমেরিন ‘ইউএসএস ট্যাঙ্গ এসসি’-তে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সাড়ে তিন বছর চাকরির পর সাবমেরিন অফিসার হিসেবে নৌবাহিনী ত্যাগ করেন মার্টিন কুপার ।

নৌবাহিনী ছাড়ার পর, মার্টিন আমেরিকান টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ (এটিএন্ডটি) এর বেল সিস্টেম বিভাগে যোগ দান করেন। কিন্তু এখানকার কাজের পরিবেশ তাঁর কাছে ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। তাই, মার্টিন বেল সিস্টেম ছেড়ে ওয়েস্টার্ন ইলেক্ট্রিকের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান টেলিটাইপ কর্পোরেশনে যোগ দেন। টেলিটাইপ কর্পোরেশনে কাজ করার সময়, মার্টিন মোটোরোলার কাছ থেকে একটি অফার পান। অবশেষে সেই অফারটিই গ্রহণ করে ১৯৫৪ সালে টেলিটাইপ ছেড়ে ইলিনয়ের স্কামবুর্গের ‘মোটোরোলা ইনকর্পোরেটেড’-এ মোবাইল ইকুইপমেন্ট গ্রুপের একজন সিনিয়র ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন।

১৯৬০ সালে, মার্টিন কুপার তৎকালীন সময়ে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সিমস (CMOS – Complementary Metal–Oxide–Semiconductor)  শীটগুলি পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন যা আগে কেবল তথ্য প্রযুক্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মার্টিন মোটোরোলা রেডিওর জন্য তৈরি স্ফটিক বা ক্রিস্টালগুলির  ত্রুটিগুলি সংশোধন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এটি কোম্পানিটিকে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল ব্যাপকভাবে উৎপাদন করায় উৎসাহিত করেছিল। মার্টিন রেডিও-নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক লাইট সিস্টেম চালু করার নেপথ্যেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং একটি পেটেন্টও পেয়েছিলেন এরজন্য। ১৯৬৩ সালে, আইঈঈঈ ভেহিকুলার টেকনোলজি সোসাইটি (IEEE Vehicular Technology Society)  মার্টিনকে তাদের সভাপতি হিসেবে বেছে নেয় এবং তাঁকে  শতবর্ষী পদকে সম্মানিত করে। ১৯৬৭ সালে শিকাগো পুলিশ বিভাগের জন্য তৈরি  প্রথম সেলুলার ফোনের মত দেখতে পোর্টেবল হ্যান্ডহেল্ড পুলিশ রেডিও সিস্টেম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মার্টিন।

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে, মার্টিন কুপার মোটোরোলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিভাগের নেতৃত্ব দেন। কুপারকে শিকাগোর পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট যোগাযোগের জন্য ল্যান্ড-ফোন বা গাড়িতে সংযুক্ত ফোন অর্থাৎ কার ফোনের অসুবিধার কথা বলেন। কুপার লক্ষ্য করেন বিমানবন্দরে, ব্যবসায়, রিয়েল এস্টেটের কাজে জড়িত থাকা মানুষদেরও এই একই অসুবিধা। পোর্টেবেল একটি যোগাযোগ মাধ্যম তাঁদের সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে অনুভব করেন কুপার।

১৯৭২ সালের নভেম্বরে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মিচেলকে বোঝানোর পর, মার্টিন তাঁর ধারণাটিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্যম তাঁর সহকর্মীদের ক্রমেই তাঁর অনুগামী করে তোলে। কার্যত কোম্পানির সমস্ত কাজ বন্ধ করে প্রত্যেককে ফোন এবং তার পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ করতে হয়েছিল সেইসময়। মার্টিন এবং তাঁর সহকর্মীরা সফলভাবে মাত্র নব্বই দিনের মধ্যে একটি প্রোটোটাইপ সেল ফোন তৈরি করেন। তবে তখনও তাঁরা ফোনের বডি শেল তৈরি করতে পারেননি । এর জন্য মার্টিন মোটোরোলায় একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। প্রতিযোগিতাটি ছিল সেল ফোনের বডির জন্য একটি নক্সা তৈরি করার। তিনি পাঁচজন অংশগ্রহণকারীকে বেছে নিয়েছিলেন এবং সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। শেষে রুডি ক্রোলোপ নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের তৈরি  নক্সাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। প্রাথমিক নকশাটি মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা ছিল, কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা যখন সমস্ত অংশ একত্রিত করা শুরু করেন, তখন আকারটি তিনগুণ বড় হয়। প্রোটোটাইপ সেল ফোনটির নাম ছিল মোটোরোলা ‘ডায়না ট্যাক’ (DYNA TAC)। এটির ওজন ছিল ২.৫ পাউন্ড, দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে ৯ ইঞ্চি লম্বা এবং ১.৭৫ ইঞ্চি চওড়া ছিল। এই প্রোটোটাইপের জন্য মোটোরোলাকে প্রচুর খরচ বহন করতে হয়েছিল।


১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল নিউইয়র্কে একটি প্রেস কনফারেন্স ডাকা হয় এই ফোনের প্রদর্শনীর জন্য৷ কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেই ম্যানহাটনের নিউ ইয়র্ক হিলটনের কাছে একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মার্টিন জনসমক্ষে তাঁর হাতে ধরা ডায়না ট্যাক প্রোটোটাইপ সেল ফোন থেকে প্রথম কলটি করেছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী  এ টি এন্ড টি (AT&T ) এর ইঞ্জিনিয়ার জোয়েল  এস এঙ্গেলকে। কলটি মার্টিনকে বার্লিংটন হাউসের (বর্তমানে অ্যালায়েন্স বার্নস্টেইন বিল্ডিং) ছাদে স্থাপিত মোটোরোলার একটি বেস স্টেশন এবং এ টি এন্ড টি ল্যান্ড-লাইন টেলিফোন সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করে। ১৯৮৩ সালের মধ্যে এই হ্যান্ডসেটটির আসল ওজনের অর্ধেক কমিয়ে আনা হয়।  ১৯৮৪ সালে মোটোরোলা প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সেলফোন তৈরি করা শুরু করে।

কয়েক বছর পরে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক রিচার্ড রয় ‘স্মার্ট অ্যান্টেনা’ ব্যবহার করে মোবাইল টেলিকমকে আরও উন্নত করার একটি ধারণা দেন মার্টিনকে এবং সেই সাথে এই বিষয়ে একসাথে কাজ করার প্রস্তাব দেন । মার্টিন বুঝতে পেরেছিলেন যে এই নতুন প্রযুক্তিটি ব্যক্তিগত যোগাযোগের ভবিষ্যতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ১৯৯২ সালে রিচার্ড রয়ের সাথে মার্টিন ‘অ্যারেকম’ (ArrayComm) কোম্পানি গঠন করেন।

১৯৯৭ সালে মার্টিন কুপার স্পেক্ট্রাল এফিসিয়েন্সির উপর একটি সূত্র তৈরি করেন যা কুপার সূত্র নামেও পরিচিত ৷ এই সূত্র অনুযায়ী, প্রতি ত্রিশ মাসে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিও স্পেকট্রামের উপর যে তথ্য প্রেরণ করা যেতে পারে, তার পরিমাণ প্রতি ত্রিশ মাসে দ্বিগুণ হয়। মার্টিন আরও বলেন যে এই সূত্টিরটি ১৮৯৭ সাল থেকেই সত্য যখন গুগলিয়েলমো মার্কনি প্রথম ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফের পেটেন্ট করেছিলেন । ২০১০ সালে, কুপার সেলুলার পোর্টেবল হ্যান্ড-হোল্ড টেলিফোন তৈরি এবং স্থাপনে নেতৃত্বের জন্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

কুপার আজীবন তাঁর কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে গবেষণামূলক লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন৷ তাঁর লেখা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘দ্য মিথ অফ স্পেকট্রাম স্কারসিটি’, ‘মোবাইল ওয়াইম্যাক্স-ফোর্থ-জেনারেশন ওয়্যারলেস’, ‘দ্য নিড ফর সিম্পলিসিটি’, ‘অ্যান্টেনাস গেট স্মার্ট’, ‘এভরিওয়ান ইজ রং’ ইত্যাদি৷

অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য আজীবন নানা পুরস্কারে, সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে কুপারকে। ১৯৯৫ সালে মার্টিন যোগাযোগ ক্ষেত্রে তাঁর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য ওয়ার্টন ইনফোসিস বিজনেস ট্রান্সফরমেশন অ্যাওয়ার্ড পান। তিনি আমেরিকার রেডিও ক্লাব থেকে ফ্রেড লিঙ্ক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ২০০৪ সালে আইআইটি থেকে বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করা হয়। এছাড়াও পেয়েছেন ওয়্যারলেস সিস্টেম ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রি লিডার অ্যাওয়ার্ড (২০০২), , গ্লোবাল স্পেক গ্রেট মোমেন্টস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), সিই কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স হল অফ ফেম অ্যাওয়ার্ড (২০০৮), বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য প্রিন্স অফ আস্তুরিয়াস পুরস্কার (২০০৯) ইত্যাদি।

আপনার মতামত জানান