হাওড়া জেলা

হাওড়া জেলা

আমাদের পশ্চিমবঙ্গ ২৩টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি হল হাওড়া জেলা।

ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্যতম একটি জেলা হল হাওড়া। হাওড়া নাম হল কিভাবে সেই প্রসঙ্গটিও বেশ চমকপ্রদ। ‘হাওড়া’ নামটির বুৎপত্তি নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। বর্তমান হাওড়া শহরের অদূরে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হাড়িড়া নামে একটি গ্রামের অস্তিত্ব ছিল; ‘হাওড়া’ নামটি এই ‘হাড়িড়া’ নামেরই অপভ্রংশ হিসেবে ধরা হয় এবং এইভাবেই হাওড়া নামটি অর্থবহ হয়ে উঠেছে। জেলাটির নামকরণ নিয়ে আরও জানতে এখানে দেখুন।

ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে হাওড়া জেলার উত্তরে হুগলি জেলা; দক্ষিণে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা অবস্থান করছে ; পশ্চিমে আছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা; পূর্ব দিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা অবস্থিত। হুগলি নদী এই জেলার পূর্ব সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়েছে৷ দামোদর নদ বিধৌত হাওড়া জেলা দক্ষিণবঙ্গের পলল সমভূমির উপর অবস্থিত হওয়ায় এই জেলার ভূমিরূপের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় – উঁচু নদীপাড় ও দীর্ঘ জলাভূমি বা নিম্নভূমি। হাওড়া জেলার প্রধান নদনদীগুলি হল হুগলি, রূপনারায়ণ, দামোদর, সরস্বতী প্রভৃতি। দামোদর নদ এই জেলার মাঝবরাবর প্রবাহিত হয়েছে। বর্ষার জলে পুষ্ট জোয়ার-ভাঁটা এই নদীগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বর্ষাকালে নদীর পাড়ে ভাঙন ও বন্যাও এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের (ডিভিসি) স্লুইস গেটের মাধ্যমে জোয়ারের প্রকোপ থেকে জেলার জনবসতি ও কৃষিক্ষেত্রকে রক্ষা করা হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৪৬৭ বর্গকিমি স্থান জুড়ে জেলাটি অবস্থান করছে, আয়তন হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে এর স্থান একুশতম। ২০১১ সালের জনগননা অনুসারে এই জেলা পশ্চিমবঙ্গে নবম স্থান অধিকার করে। এই জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৪৮৫০০২৯ জন। এই জেলার অন্যতম প্রধান শহর হল হাওড়া। রবীন্দ্র সেতু, বিদ্যাসাগর সেতু, বিবেকানন্দ সেতু ও নিবেদিতা সেতু নামে এই চারটি সেতু হাওড়া ও কলকাতা শহরদুটিকে যুক্ত করেছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই হাওড়া জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল। ১৭৯৬ সালে সালকিয়ায় একটি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে বাউড়িয়ায় স্থাপিত কটন মিলটি ছিল ভারতের প্রথম কার্পাস বয়ন কারখানা। ১৮৫৪ সালে হাওড়া স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফাউন্ড্রি সহ বিভিন্ন ভারী শিল্পে হাওড়া শহরের উৎকর্ষ ও ব্যাপকতা বিচার করে একে ‘বাংলার শেফিল্ড’ বলা হত। বর্তমানে হাওড়া জেলার শিল্পক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এখন ভারী ও মাঝারি শিল্পে বিকাশ লাভ করেছে৷

হাওড়া জেলা দুটি মহকুমায় বিভক্ত যথা –  ১. হাওড়া সদর মহকুমা ২. উলুবেড়িয়া মহকুমা। এই জেলায় মূলত বাংলা (৮৪.৯৯%) ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাই বেশী৷

পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত ধর্মীয় উৎসবগুলি বাদে হাওড়া জেলা বিখ্যাত হল চণ্ডীপূজার জন্য। এই জেলায় দেবী চণ্ডীর অসংখ্য লৌকিক রূপ লক্ষিত হয়। যেমন কল্যাণচণ্ডী, মঙ্গলচণ্ডী, মাকালচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী ইত্যাদি। আমতার মেলাইচণ্ডীর মন্দির এই জেলার অন্যতম বিখ্যাত মন্দির। বাগনানে অবস্থিত খালোড় কালীবাড়িও এখানকার অন্যতম বিখ্যাত মন্দিরগুলির একটি।

এই জেলায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বটানিক্যাল গার্ডেন – হাওড়ার শিবপুরে ২৭৩ একর আয়তনবিশিষ্ট এই উদ্যানে বর্তমানে মোট ১৪০০ প্রজাতির প্রায় ১৭,০০০টি গাছ রয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক উদ্ভিদ উদ্যান। হাওড়ায় অবস্থিত বেলুড় মঠ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়। ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ হাওড়ার বেলুড়ে গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে এই মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর সেতু (“দ্বিতীয় হুগলি সেতু”) হাওড়া ও কলকাতা শহরের সংযোগরক্ষাকারী একটি সেতু। এই সেতু ভারত তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও উচ্চতম সেতু হিসেবে বিবেচিত। হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ)। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।  এছাড়াও এখানকার পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – গাদিয়াড়া, গড়চুমুক, পানিত্রাস ইত্যাদি।

এই জেলা কার্পাস বয়ন, পাট, শাটল কক, ধাতুশিল্প, কাগজ, সফট টয়, বাটিক প্রিন্ট, প্রভৃতি শিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধ। এখানকার দেউলপুর গ্রামে তৈরি পোলো বলের খ্যাতি একসময় জগৎবিখ্যাত ছিল।

3 comments

আপনার মতামত জানান