কাজী নজরুল ইসলাম

বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র কাজী নজরুল ইসলাম।বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। ২৪ মে ১৮৯৯(১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ খ্রীঃ)  সালে মঙ্গলবার এক ঝড়ের রাতে কবির জন্ম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা থেকে আঠারো মাইল দূরের চুরুলিয়া গ্রামে।পিতা কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। নজরুলের পূর্বপুরুষেরা এসছিলেন ইরাকের বাগদাদ থেকে। ষোড়শ শতকে সম্রাট শাজাহান কর্তৃক নজরুলের পরিবার “কাজী” উপাধি প্রাপ্ত হয়।

তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিলধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিনহিসেবে কাজও করেছিলেন।১৯০৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর।  কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”।পিতার মৃত্যুর পর অভাব অনটনের জ্বালায় মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাঁকে।যে মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সেখানেই  শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন (আজান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন।এর কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দেন লেটো গানের দলে।লেটো গান(বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) শেখার প্রথম সুযোগ মিলেছিল চাচা করিমের কাছে।সমস্ত আসানসোল রানিগঞ্জ অঞ্চল ঘুরে ঘুরে নজরুল গান গেয়ে বেড়াতেন এবং সেই বয়সেই যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়।এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজের কাজ এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থও  পড়তে  থাকেন। তাঁর লেখা পালাগুলির মধ্যে বিখ্যাত ছিল- চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ। লেটো দলে নজরুল খ্যাত ছিল – ” খুদে ওস্তাদ” নামে। বিখ্যাত গোদা কবি শেখ চকো নজরুলকে আদর করে ‘ ব্যাঙাচী’ বলে ডাকতেন। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন – “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর।সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

নজরুল কিছুকাল সাংবাদিকতাও করেছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক- এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।

নজরুল জীবনে নারীর প্রভাব বেশ গভীর।কুমিল্লার দৌলতপুরের বিখ্যান খান বংশের সন্তান আলী আকবর খান। তিনি পেশায় ছিলেন একজন সৈনিক এবং পরবর্তীতে একজন গ্রন্থ প্রকাশক।দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে বিবাহের একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে নজরুলের আলাপ হয় আলী আকবর খানের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের সাথে।  নজরুল ইরানী ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম।তবে কারও কারও মতে নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় নজরুল-নার্গিসের বিয়ে ঠিক হয়।কিন্তু আলি আকবর যখন নজরুলকে ঘর জামাই থাকার শর্ত দেন নজরুল তা মেনে নিতে পারেননি। বিয়ের রাতেই সেই প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেই নজরুল দৌলতপুর ত্যাগ করেন।এরপর নজরুল খান সাহেব কে চিঠি লেখেন-

“ বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করুন সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েত অসহ্য হয়ে না পড়লে, আমি কখনো কাউকে ব্যথা দিই না। …আমিও আপনাদের মতো মানুষ। আমার গণ্ডারের চামড়া নয়, কেবল সহ্যগুণটা কিছু বেশী। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞান ছিল না বা “কেয়ার” করিনি বলে আমি কখনো এত-বড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার “ম্যানলিনেসে” বা পৌরুষে গিয়ে বাজে – যাতে আমাকে কেঊ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন “ক্ষুদ্র আত্মা” অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ হতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে। বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়। …….বাড়ির সকলকে দস্তুরমতো সালাম-দোয়া জানাবেন…… তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এ ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়। আরজ-ইতি। চীর-সত্য স্নেহ-সিক্ত – নুরু”

নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর নার্গিস তাঁর মামার বন্ধু, ময়মনসিংহবাসী প্রফেসর হেলালুদ্দিন ও মামাতো ভাই নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার শিয়ালদহ হোটেলে নজরুলের সাথে শেষ সাক্ষাত করেন। নজরুল সারাজীবনেও নার্গিসকে ভুলতে পারেননি তা নার্গিসকে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয় একটি চিঠিতে স্পষ্ট-

“কল্যাণীয়েষু, তোমার পত্র পেয়েছি – সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল – তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। …এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।……তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি – তা দিয়ে তোমাকে দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ-মাণিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না – আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলী দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির- অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সেই ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি। ……আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে, ভাটার স্রোতে। …… তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও- এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই-এই আমার শেষ কৈফিয়ত। 
ইতি।
নিত্যশুভার্থী,
নজরুল ইসলাম।

১৯২৪ সালে নজরুল বিয়ে করেন, প্রমিলা দেবীকে।এই বিয়ের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ভীষণভাবে খেপে উঠে, অনেক পত্রিকায় (যেমন প্রবাসী পত্রিকা) তার লেখাও নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।

নজরুল তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতাটি স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখেন-

****বিজয়িনী****

হে মোর রানী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।

সমর-জয়ী অমর তরবারি
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী,
এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।

ওগো জীবন দেবী!
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল !

বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরী আঁচল তোমার উড়ে
তৃণ আমার আজ তোমার মালার পূরে
বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে।।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।

আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।

পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮  নভেম্বর পত্রিকার ঐ সংখ্যাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:

আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…।

১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ক্রমে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি, এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে চিকিৎসার জন্য নজরুলকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের মতে উনি দুরারোগ্য “ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস” রোগে ভুগছেন।ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা হয়।

এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন, “মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”:- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।

নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত।কবির  রচনা তালিকা দেওয়া হল নীচে –

কবিতা
অগ্নিবীণা (কবিতা) ১৯২২
সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন) ১৯২৫
ফনীমনসা (কবিতা) ১৯২৭
চক্রবাক (কবিতা) ১৯২৯
সাতভাই চম্পা (কবিতা) ১৯৩৩
নির্ঝর (কবিতা) ১৯৩৯
নতুন চাঁদ (কবিতা) ১৯৩৯
মরুভাস্কর (কবিতা) ১৯৫১
সঞ্চয়ন (কবিতা সংকলন) ১৯৫৫
নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা (কবিতা সংকলন) ১৯৮২

কবিতা ও সংগীত
দোলন-চাঁপা (কবিতা এবং গান) ১৯২৩
বিষের বাঁশি (কবিতা এবং গান) ১৯২৪
ভাঙ্গার গান (কবিতা এবং গান) ১৯২৪
ছায়ানট (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
চিত্তনামা (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
সাম্যবাদী (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
পুবের হাওয়া (কবিতা এবং গান) ১৯২৬
সর্বহারা (কবিতা এবং গান) ১৯২৬
সিন্ধু হিন্দোল (কবিতা এবং গান) ১৯২৭
জিঞ্জীর (কবিতা এবং গান) ১৯২৮
প্রলয় শিখা (কবিতা এবং গান) ১৯৩০
শেষ সওগাত (কবিতা এবং গান) ১৯৫৮

সংগীত
বুলবুল (গান) ১৯২৮
সন্ধ্যা (গান) ১৯২৯
চোখের চাতক (গান) ১৯২৯
নজরুল গীতিকা (গান সংগ্রহ) ১৯৩০
নজরুল স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৩১
চন্দ্রবিন্দু (গান) ১৯৩১
সুরসাকী (গান) ১৯৩২
বনগীতি (গান) ১৯৩১
জুলফিকার (গান) ১৯৩১
গুল বাগিচা (গান) ১৯৩৩
গীতি শতদল (গান) ১৯৩৪
সুর মুকুর (স্বরলিপি) ১৯৩৪
গানের মালা (গান) ১৯৩৪
স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৪৯
বুলবুল দ্বিতীয় ভাগ (গান) ১৯৫২
রাঙ্গা জবা (শ্যামা সংগীত) ১৯৬৬

ছোট গল্প 
ব্যাথার দান (ছোট গল্প) ১৯২২
রিক্তের বেদন (ছোট গল্প) ১৯২৫
শিউলি মালা (গল্প) ১৯৩১

উপন্যাস
বাঁধন হারা (উপন্যাস) ১৯২৭
মৃত্যুক্ষুধা (উপন্যাস) ১৯৩০
কুহেলিকা (উপন্যাস) ১৯৩১

নাটক
ঝিলিমিলি (নাটক) ১৯৩০
আলেয়া (গীতিনাট্য) ১৯৩১
পুতুলের বিয়ে (কিশোর নাটক) ১৯৩৩
মধুমালা (গীতিনাট্য) ১৯৬০
ঝড় (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬০
পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬৪

প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ
যুগবানী (প্রবন্ধ) ১৯২৬
ঝিঙ্গে ফুল (প্রবন্ধ) ১৯২৬
দুর্দিনের যাত্রী (প্রবন্ধ) ১৯২৬
রুদ্র মঙ্গল (প্রবন্ধ) ১৯২৭
ধুমকেতু (প্রবন্ধ) ১৯৬১

অনুবাদ এবং বিবিধ
রাজবন্দীর জবানবন্দী (প্রবন্ধ) ১৯২৩
দিওয়ানে হাফিজ (অনুবাদ) ১৯৩০
কাব্যে আমপারা (অনুবাদ) ১৯৩৩
মক্তব সাহিত্য (মক্তবের পাঠ্যবই) ১৯৩৫
রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম (অনুবাদ) ১৯৫৮
নজরুল রচনাবলী (ভলিউম ১-৪,বাংলা একাডেমী)১৯৯৩

সঙ্গীত গ্রন্থাবলী
বুলবুল (১ম খন্ড-১৯২৮, ২য় খন্ড-১৯৫২)
চোখের চাতক (১৯২৯)
চন্দ্রবিন্দু (১৯৪৬)
নজরুল গীতিকা (১৯৩০)
নজরুল স্বরলিপি (১৯৩১)
সুরসাকী (১৯৩১)
জুলফিকার (১৯৩২)
বনগীতি (১৯৩২)
গুলবাগিচা (১৯৩৩)
গীতিশতদল (১৯৩৪)
সুরলিপি (১৯৩৪)
সুর-মুকুর (১৯৩৪)
গানের মালা (১৯৩৪)

তথ্যসূত্র


  1. https://en.wikipedia.org/wiki/Kazi_Nazrul_Islam
  2. http://banglaraja.com/kazi-nazrul-islam-er-jiboni/
  3. http://www.abasar.net/Bibidh_Anam.html
  4. http://www.somewhereinblog.net/blog/ghunpoka13/29953056
  5. কাজী নজরুল ইসলামঃ জীবন বৃত্তান্তঃ নজরুল তীর্থ 

 

7 comments

আপনার মতামত জানান