উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় সুরকার কমল দাশগুপ্ত (kamal Dasgupta)। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়াও ঠুমরি ঘরানার গানে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবনে প্রায় আট হাজার গানে সুর দিয়েছিলেন। বাংলা, হিন্দি, তামিল, উর্দু ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। এমনকি আমেরিকান এক তথ্যচিত্রের আবহ সঙ্গীত নির্মাণ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর। কমল দাশগুপ্ত প্রায় চারশো নজরুলগীতিতে সুর দিয়েছিলেন।
১৯১২ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত যশোরের নড়াইল গ্রামে কমল দাশগুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম কমলপ্রসন্ন দাশ গুপ্ত। কেউ কেউ বলে থাকেন তাঁর শৈশব কেটেছিল কোচবিহারে। তাঁর বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত এবং মা কামিনীরঞ্জন দাশগুপ্ত উভয়েই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন। ফলে ছোট থেকেই পারিবারিক এক সঙ্গীত মুখর পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার কারণে কমলের মনের ভিতরে সঙ্গীতের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ জন্ম নিয়েছিল। কমলের দাদা বিমল দাশগুপ্ত এবং ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্ত গানের জগতের সুপরিচিত নাম ছিলেন। বিমল দাশগুপ্ত গানের পাশাপাশি জাদুবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। অন্যদিকে সুবল দাশগুপ্ত গানে সুর দেওয়ার পাশাপাশি তবলা বাদক হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিলেন। দাদা বিমল দাশগুপ্তের কাছ থেকেই সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন কমল। এখানে উল্লেখ্য যে, কোচবিহার ছিল বিষ্ণুপুরী রাগসঙ্গীত চর্চার অন্যতম প্রসিদ্ধ ক্ষেত্র। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গীতের আবহে বেড়ে ওঠা কমল দাশগুপ্ত যে খুব ছোটবেলাতেই বিষ্ণুপুরী এই ঘরানার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
১৯২৮ সালে কোচবিহারের স্কুল থেকে স্কুল শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কমল কলকাতা চলে আসেন এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন।
দাদা বিমল দাশগুপ্তের কাছে প্রাথমিক সঙ্গীতশিক্ষার পর কমল দাশগুপ্ত সরগম শিক্ষা ও অনুশীলনের জন্য বিখ্যাত অন্ধ গায়ক শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। পরে আবার দিলীপকুমার রায়ের কাছেও সঙ্গীত শিক্ষা নেন। এমনকি দিলীপকুমারের সঙ্গীতদলের সদস্য হয়ে রবীন্দ্রনাথকে গান শোনাতেও গিয়েছিলেন তিনি। তবে কমল দাশগুপ্তের সত্যিকারের গুরু ছিলেন ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খান। এই জমিরউদ্দীন ছিলেন ঠুমরি গানের পন্ডিত। তাঁর কাছ থেকেই কমল এই ঘরানা সম্পর্কে বিশদে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। ওস্তাদজী অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর প্রিয় শিষ্যের অন্তর্নিহিত প্রতিভার হদিশ পেয়ে গিয়েছিলেন। জমিরউদ্দীন খানের কাছে সঙ্গীতসাধনা করতে করতেই এইচএমভিতেও (হিস মাস্টার্স ভয়েস) সমানভাবে কাজ করছিলেন কমল।
১৯৩২ সালে গায়িকা সত্যবতীর কন্ঠে সুরকার হিসেবে কমল দাশগুপ্তের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরে তিনি নিজের গাওয়া গজল রেকর্ড করেন। বিভিন্ন শৈলীর, বিবিধ ঘরানার সঙ্গীতে কমল দাশগুপ্তের অনায়াস বিচরণ ছিল। বেশ কিছু হিন্দি ভজনেও সুর দিয়েছিলেন তিনি। ভৈরবী তাঁর প্রিয় রাগ ছিল। ভৈরবীতে তিনি কয়েকশো গান তৈরি করেছিলেন, যেমন ‘জানি জানি একদিন ভালোবেসেছিলে মোরে’, ‘আমি ভোরের যূথিকা’ ইত্যাদি। বিভিন্ন রকম ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন তিনি। যেমন – কাওয়ালি ছন্দে বানিয়েছিলেন ‘আমি বনফুল গো’, তেমনি দাদরা এবং ঝুমুরের মিশ্রণে তৈরি করেছিলেন ‘মোর মন চলে যায় সেই দেশে গো’র মতো কিছু গান।
১৯৩৫ সালে কমল দাশগুপ্ত কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ঠিক এই সময় থেকেই প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী সখ্য গড়ে ওঠে। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের অফিসে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় নজরুলের। প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই তাঁরা একে অপরের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের সম্পর্ক এরপর দীর্ঘ এগারো বছর (১৯৩৪-৪৫) স্থায়ী হয়। এই দীর্ঘ সম্পর্কের ফল ছিল প্রায় চারশোটি নজরুলগীতি যেগুলিতে কমল স্বয়ং সুরারোপ করেছিলেন।
কমল দাশগুপ্তের গৌরবময় কর্মজীবনের একটি বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কমল দাশগুপ্ত অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পন্ডিতমশাই’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় সুরকার হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এরপর একেরপর এক বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করে গেছেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে কমল দাশগুপ্ত ‘সর্বজনীন’, ‘বিবাহোৎসব’ এবং ‘দেবযানী’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। কিংবদন্তি অভিনেতা ও পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁর দেওয়া সুরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং ১৯৪২ সালে নিজের পরিচালিত ‘জওয়াব’ নামক হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন কমল দাশগুপ্তকে। সেই প্রথম বলিউডে পা রাখার সুযোগ পেলেন কমল। এই সিনেমার ‘তুফান মেল ইয়ে দুনিয়া তুফান মেল’, ‘কুছ ইয়াদ না রাহে’র মতো গান আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
এরপর এমপি প্রোডাকশনের সামাজিক ছবি ‘হসপিটাল’-এর সঙ্গীত পরিচালক হন তিনি । সেই বছরেই বড়ুয়া প্রোডাকশনের আরেকটি সিনেমা ‘রাণী’তে সুরকার হিসেবে কাজ করেন তিনি। এই রাণী ছবির গানও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৪ সালে কমল দাশগুপ্ত পাড়ি দেন বোম্বেতে এবং সংস্কৃত কবি কালিদাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘মেঘদূত’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করেন। বোম্বেতে থাকার সময় বিভিন্ন ঘরানার ছবিতে সুর দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে থাকাকালীন ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’-এর সুরকার ছিলেন তিনি যার প্রায় প্রত্যেকটি গানই দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৪৬ সালে ‘কৃষ্ণ লীলা’, ‘জমিন আসমান’, ১৯৪৭ সালে ‘ফয়সালা’ ইত্যাদি ছবিতে পরপর কাজ করতে থাকেন তিনি। প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তাঁর শেষ ছবি ছিল ‘ইরান কি এক রাত’ (১৯৪৯)। ‘ফুলবাড়ী’ হল সুরকার হিসেবে বলিউডে তাঁর শেষ কাজ। সুরকার হিসেবে শেষ যে বাংলা সিনেমায় কাজ করেছিলেন সেটি হল ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘বধূবরণ’। প্রায় আশিটি বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত নির্মাণ করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ ভারতের গায়িকা শুভলক্ষ্মীর কন্ঠে কমলের সুরে বিখ্যাত একটি গান হল, ‘মে নিরগুনিয়া গুন নেহি’ ভজনটি। পনেরোটি হিন্দি এবং আটটি তামিল চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
এছাড়াও যুদ্ধসংক্রান্ত আমেরিকান এক তথ্যচিত্রের আবহ সঙ্গীত নির্মাণ করে কমল দাশগুপ্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নিজের কৃতিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যে রণসঙ্গীত ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’, সেই গানটির সুরও কমল দাশগুপ্তের নির্মিত। সঙ্গীতের মুর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে সরোজিনী নাইডু পর্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন তাঁর। নৌশাদের মতো মানুষ কমল দাশগুপ্তের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘হোয়াট আ মিউজিশিয়ান’।
কমল দাশগুপ্ত স্বরলিপি রচনার সুবিধার্থে শর্টহ্যান্ড পদ্ধতি চালু করেছিলেন। একদিনে ৫৩টি গানে সুর দেওয়ার বিরল রেকর্ডও রয়েছে তাঁর। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে কমল দাশগুপ্তের গ্রামাফোন রেকর্ডগুলির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। আজও সমান জনপ্রিয় তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘সাঁঝের তারকা আমি’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ইত্যাদি। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে প্রখ্যাত নজরুলগীতি শিল্পী ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত এবং বিয়ের চতুর্থ বছরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। ফলে কমল নাম বদলে হয়ে যায়, কামালউদ্দিন আহমেদ। ফিরোজার থেকে প্রায় আঠারো বছরের বড় ছিলেন কমল। ১৯৬৭ সালে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান তিনি৷ কিন্তু তখন কমল দাশগুপ্তের জীবনে ঘোরতর দারিদ্র্যের সময়। এককালে ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দেওয়া প্রখ্যাত সুরকার অভাবের তাড়নায় ঢাকায় একটি মুদিখানা দোকান পর্যন্ত খুলেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে নাগরিকত্ব লাভ করেন কমল দাশগুপ্ত। পরে অবশ্য কাজে ফেরবার সুযোগ পেয়েছিলেন কমল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহায়তায় গড়ে তোলা বাংলাদেশের স্বনামধন্য গীতিকার এবং বেতার জগতের শিল্পী শহীদূল ইসলামের বাদ্যযন্ত্রী গোষ্ঠীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমল। নানারকম কাওয়ালি তো রেকর্ড করলেনই, পাশাপাশি সেসময় ‘কেন এমন হয়’ নামের একটি সিনেমাতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজও করেছিলেন। ফিরোজা এবং কমলের মোট তিনটি পুত্র সন্তান হয়েছিল।
মানুষ হিসেবেও একজন বিরাট মনের, উদার স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। আবার ছিলেন কিছুটা শৌখিনও। ১৯৫০-এর দশকে কলকাতায় দুর্লভ একটি বুইক গাড়ি কিনেছিলেন। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। নিজের খরচেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেসময় লঙ্গরখানা খুলে প্রত্যেকদিন প্রায় একশোজন করে দুর্ভিক্ষপীড়িতকে খাওয়াতেন তিনি। প্রায় একমাস ধরে এই মহৎকার্য চালিয়ে গিয়েছিলেন। আবার ক্রিকেটের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ অনুরাগ।
সঙ্গীতে কৃতিত্বের জন্য যেসব পুরস্কার পেয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় পুরস্কার।
শারীরিক অসুস্থতা এবং যথাযথ চিকিৎসার অভাবে ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই ঢাকার পি.জি হাসপাতালে এই কিংবদন্তি সুরকার ও গায়ক কমল দাশগুপ্তের মৃত্যু হয়।