বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের জাতির জনক এবং পাকিস্তানের শাসন থেকে উদ্ধার করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুন।
শেখ মুজিবর রহমান গোপালগঞ্জের গিমাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।১৯৪৪ সালে আই এ ও ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। এসময় তিনি বেকার হস্টেলের ২৪ নং কক্ষে থাকতেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় ১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন প্রকাশ করার অপরাধে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আজীবন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষটি ১৯৪৪ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন শেখ মুজিবর। ১৯৫৪ সালে হন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী।১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেন। দফাগুলি হল যথাক্রমে :
- ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন এবং সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠন
- প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত অপর সকল বিষয় ফেডারেটিং ইউনিট বা প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে ছেড়ে দেওয়া
- দুই রাষ্ট্রের জন্য পৃথক মুদ্রা চালু করা অথবা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া
- করারোপের সকল ক্ষমতা ফেডারেটিং রাষ্ট্রগুলির হাতে দেওয়া
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহকে স্বাধীনতার অধিকার
- রাষ্ট্রসমূহকে নিজের নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেওয়া।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজনীতির প্রতি তাঁর এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে ছয়-দফা কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার দাবী। সমস্ত রাজনৈতিক দলের রক্ষণশীল সদস্যরা এই কর্মসূচি আতঙ্কের চোখে দেখলেও এটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। শেখ মুজিবর রহমান ছয়দফা কর্মসূচির চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার পর আইয়ুব সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। শেখ মুজিবর এবং আরও চৌত্রিশ জনের বিরুদ্ধে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়। সরকারিভাবে মামলার নাম দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। মামলায় অভিযুক্তদের বেশিরভাগই ছিলেন পাকিস্তানের বিমান এবং নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার এবং কর্মচারী। এঁদের মধ্যে তিনজন ছিলেন ঊর্ধ্বতন বাঙালি অসামরিক কর্মকর্তা। শেখ মুজিবর সেই সময় আগাম জেলবন্দী থাকায় তাঁকে ১ নম্বর আসামী হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলায় শেখ মুজিবরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি অন্যান্য আসামীদের যোগসাজশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। অভিযোগ করা হয় শেখ মুজিবুর এবং অন্যান্য আসামী ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার গোপন পরিকল্পনা করছেন। ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার চলার সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আবেগ অনুভূতি জেগে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের সময় তাঁর জনমোহিনী রূপ আরোও সামনে আসে এবং পুরো বাঙালী জাতি তাঁদের নেতার বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে তরুণ প্রজন্মের দ্বারা সংগঠিত গণআন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে আইয়ুব সরকার দেশে গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য মামলাটি ফিরিয়ে নেয়। শেখ মুজিবর নিঃশর্ত মুক্তি পান। এটি ছিল বাংলাদেশের বাঙালীদের মুক্তির সনদ। শেখ মুজিবর ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্বতন পূর্ববাংলার বাংলাদেশ নামকরণ করেন।
তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একমাত্র মুখপত্র হন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। সারা দেশের জনগণ তাঁকে ছয়দফা মতবাদের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতাসহ সমর্থন দেয়। ছয় দফা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁর উপরই বর্তায়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রমনা রেসকোর্সে একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং শপথ নেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় তাঁরা কখনও ছয়দফা থেকে বিচ্যুত হবেন না।
এই পরিস্থিতিতে জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবরকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক ঘোষণায় ৩ মার্চ ঢাকায় হতে চলা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সারা পূর্ববঙ্গ তাঁকে সমর্থন জানায়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তাঁর নির্দেশমত চলে। তিনি কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের সরকার প্রধান হয়ে যান। ১২ মার্চ ১৯৭১ সালে লন্ডনের দৈনিক ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার ভাষায়: ‘জনতার পুরোপুরি সমর্থন পেয়ে শেখ মুজিবর যেন পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃত্বে আসীন হন’।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবর রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে।শেখ মুজিবর তাঁর ভাষণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন। বক্তৃতার শেষে তিনি ঘোষণা করেন: “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে… মনে রাখবে, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ…এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানী সেনার হাতে গ্রেফতার হন। ১৯৭১ সালের অস্থায়ী সরকারে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান এবং ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৪ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলায় ভাষণ দেন।
শেখ মুজিবরের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। তাঁর লিখিত অন্যান্য বইগুলি হল ‘কারাগারের রোজনামচা'(প্রিজন ডাইরিজ), ‘শেখ মুজিব ইন পার্লামেন্ট ১৯৫৫-৫৮’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাত্রে তিনি ঢাকার ধানমন্ডির নিজস্ব বাসভবনে গুপ্ত ঘাতকদের দ্বারা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা ও তিন পুত্র শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রাসেল সহ সপরিবারে খুন হন। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও জামাতা ওয়াজেদ আলি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
16 comments