রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন ভারতের একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ । তিনি আর.ডি ব্যানার্জি (R D Banerji) নামে অধিক পরিচিত ছিলেন৷ ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কর্তা হিসাবে।
১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কালিমাটি গ্রামে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন৷ বাবা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন বহরমপুর কোর্টের আইনজীবী। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ ও স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে তিনি ইতিহাসে সাম্মানিক ডিগ্রী লাভ করেন ও ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এম.এ পাস করেন।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯১০ সালে কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় যাদুঘরে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী হিসাবে। তারপর ১৯১১ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে তিনি নিযুক্ত হন৷ ১৯১৭ সালে তাঁর পদোন্নতি হয় পশ্চিমী সার্কের সুপারিন্টেন্ডিং প্রত্নতত্ত্ববিদ পদে । ১৯২৪ সালে তিনি পূর্ব বিভাগে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে পাহাড়পুরে খননকাজে অংশ নেন। ১৯২৬ সালে তিনি স্বেচ্ছা অবসর নেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে ১৯২৮ সাল নাগাদ তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রফেসর’ হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এখানেই অধ্যাপনা করেন।
রাখালদাসের মহেঞ্জাদারো আবিষ্কার নিয়ে একটি বিতর্ক আছে যে তাঁর এই আবিষ্কার তাঁর একক কৃতিত্ব নাকি স্যর জন মার্শালের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে তিনি এটি আবিষ্কার করেন। পি কে মিশ্র তাঁর ‘Rakhal Das Banerji: The Forgotten Archaelogist’ বইয়ে দাবি করেন, ১৯২৪ সালের আগে স্যর জন মার্শাল মহেঞ্জাদারো সম্পর্কে একপ্রকার অজ্ঞাতই ছিলেন। পি কে মিশ্রের মতে, ‘Marshall took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee had done all the work a discoverer should have done।’ তবে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে রাখালদাসের নামই স্মরণীয়। সিন্ধু সভ্যতার বৌদ্ধ নিদর্শনগুলি তিনিই প্রথম খেয়াল করেন। খনন কার্যের মাধ্যমে ব্রোঞ্জ যুগ, সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার এবং সভ্যতাগুলির ব্যখ্যাকর্তাও তিনি ছিলেন ৷ এছাড়া কুষান সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে তিনি বহু তথ্য আবিষ্কার করেন। এরপর বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। এমনকি মুদ্রাসম্বন্ধীয় বিষয়ে বাংলাতে প্রথম গ্রন্থ রচনা তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব।
কেবল খননকাজ নয় তিনি বেশ কিছু ইতিহাস বিষয়ক বইও লিখেছিলেন। রাখালদাস ১৪টি এককগ্রন্থ (monographs) ও বই, ৯টি উপন্যাস এবং বাংলা ও ইংরেজিতে তিনশো’র বেশি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। দু খন্ডে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, ‘পাষাণের কথা’, ‘শশাঙ্ক ও ধর্মপাল’ প্রভৃতি বইয়ের রচনাকার ছিলেন তিনি। এই বইগুলির মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া পাথরখোদাই লিপির বর্ণনামূলক সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর ‘প্রাচীন মুদ্রা’ (প্রথম পর্ব) গ্রন্থটি রাখালদাসের সবথেকে বড় অবদান। এ বইটিতে প্রাচীন ও প্রাক-মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রা সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত এটিই ভারতীয় ভাষায় মুদ্রাতত্ত্বের ওপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত ‘দি অরিজিন অব দি বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট'(The Origin of the Bengali Script) বইটির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জুবিলি রিসার্চ প্রাইজ’ (jubilee research prize) এ ভূষিত করে। এই বইটি তিনি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও থিওডর ব্লককে উৎসর্গ করেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ যেমন ‘An Indian City Five Thousand Years Ago’ (Calcutta Municipal Gazette, November, 1928); ‘Prehistoric, Ancient and Hindu India’ (১৯৩৪ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই প্রথম যিনি বাংলা ভাষার আদি রূপ প্রোটো বাংলা লিপি নিয়ে গবেষণা করেন। ‘ভারতের ইতিহাস’ নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যবইও রচনা করেছিলেন তিনি।
১৯৩০ সালের ২৩ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
4 comments