কৈলাসনাথ কাটজু

কৈলাসনাথ কাটজু

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অনেকের সন্ধান পাওয়া যাবে, স্বাধীন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পূর্বে যারা স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু (Kailashnath Katju) তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। তবে সক্রিয় রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা আইনজীবী। আইন বিষয়ে বহুদূর পড়াশোনা এমনকি ডক্টরেট ডিগ্রি পর্যন্ত অর্জন করেছিলেন তিনি৷ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার মত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার কয়েকটি ঐতিহাসিক মামলাতে তিনি আইনজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীত্ব সামলানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি দীর্ঘদিন। এছাড়াও ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-এর মতো সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠার পিছনের অন্যতম কারিগর ছিলেন কৈলাসনাথ। রাজনীতির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু গ্রন্থও রচনা করেছিলেন তিনি যেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। 

১৮৮৭ সালের ১৭ জুন জাওরা নামক দেশীয় রাজ্যে (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের একটি অংশ) এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পরিবারে কৈলাসনাথ কাটজুর জন্ম হয়। তাঁদের কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পরিবার জাওরায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কৈলাসনাথের বাবা ত্রিভুবননাথ কাটজু ছিলেন সেই রাজ্যের দেওয়ান। কৈলাসনাথ বিবাহ করেছিলেন রূপ কিশোরী নামের এক রমণীকে এবং তাঁদের মোট পাঁচটি সন্তানের মধ্যে তিন পুত্র এবং দুই কন্যা ছিল। কৈলাসনাথের বড় ছেলে শিবানাথ ছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের একজন আইনজীবী এবং উত্তরপ্রদেশ আইনসভার সদস্য। আরেকপুত্র ব্রহ্মনাথ কাটজু এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। শিবানাথের পুত্র অর্থাৎ কৈলাসনাথের নাতি মার্কণ্ডেয় কাটজু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কৈলাসনাথের এক নাতনি তিলোত্তমা মুখার্জি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা এবং বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিক শশী থারুরের প্রথমা স্ত্রী ছিলেন। 

কৈলাসনাথের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল জাওরার বার হাইস্কুল থেকে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে পড়াশোনার জন্য লাহোরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি ভর্তি হন রংমহল হাইস্কুলে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কৈলাসনাথ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৫ সালের মার্চ মাসে লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। সেবছরই জুলাই মাসে তিনি চলে যান এলাহাবাদে এবং সেখানকার মুইর সেন্ট্রাল কলেজে অধ্যয়ন শুরু করেন। এলাহাবাদের হিন্দু হোস্টেলের প্রথম ব্যাচের একজন ছাত্র ছিলেন কৈলাসনাথ।  ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের একটি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি এবং সেই প্রদেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯০৮ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কৈলাসনাথ কাটজু ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯০৮ সাল থেকে তিনি কানপুরে আইন অনুশীলন শুরু করেন পণ্ডিত পৃথ্বীনাথ চকের অধীনে। পৃথ্বীনাথকে ভীষণই শ্রদ্ধা করতেন কৈলাসনাথ এবং ‘গুরু’ বলে মানতেন। কৈলাসনাথের অসাধারণ চিন্তাশক্তি, প্রজ্ঞা এবং মানবপ্রকৃতি বোঝবার অসামান্য ক্ষমতা কানপুরের আইনজীবীদের মহলে তাঁকে সুপরিচিত করে তোলে। ১৯১৪ সালে তিনি কানপুর থেকে এলাহাবাদে ফিরে আসেন এবং তেজ বাহাদুর সাপ্রুর চেম্বারে যোগ দেন। গভীরভাবে আইন অধ্যয়ন, নিরলস এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি একজন সর্বোত্তম আইনজীবী হয়ে ওঠেন। আর তাঁকে পিছন পিরে তাকাতে হয়নি। ১৯১৪ সাল থেকেই আইনজীবী হিসেবে তিনি ছোট-খাটো সফলতা পেরিয়ে ক্রমে বড় সফলতা অর্জন করতে থাকেন। কিছু বছর পরে ১৯১৯ সালে কৈলাসনাথ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডক্টরেট অর্থাৎ এলএলডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তাঁকে ডি.লিট উপাধিও প্রদান করা হয়েছিল। ১৯২১ সালে তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ যেসব মামলায় তিনি আইনি লড়াই লড়েছেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এলাহাবাদ হাইকোর্টে চলা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন কৈলাসনাথ। তাঁর কর্মজীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য মামলা হল দিল্লির লালকেল্লায় ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সেনাদের বিচার। এই মামলাটিতেও তিনি অভিযুক্ত অফিসারদের পক্ষের আইনজীবী হিসেবে লড়াই করেছিলেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আইনচর্চার পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন কৈলাসনাথ। তবে রাজনীতি তাঁর কাছে কোনও শখের বিষয় ছিল না, বরং ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনসেবা এবং দেশসেবাই লক্ষ্য ছিল তাঁর। তিনি আন্তরিকভাবে অনুভব করতে পারতেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ত্যাগ এবং সংগ্রামকে। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের মত একটি সর্বভারতীয় দলকেই বেছে নিয়েছিলেন রাজনৈতিক জীবন শুরু করবার জন্য। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের ১৭ জুলাই তিনি যুক্ত প্রদেশের গোবিন্দ বল্লভ পন্থের মন্ত্রীসভার আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি এলাহাবাদ জেলার (দোয়াবা) নির্বাচনী এলাকা থেকে আইনসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই যুক্ত প্রদেশ থেকেই কংগ্রেসের টিকিটে তিনি ভারতের গণপরিষদেও নির্বাচিত হন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নাগরিকত্ব ইস্যুতে বিধানসভাতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ ছিল। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে তিনি এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯২১ এবং ১৯৩০ সালে অসহযোগ আন্দোলন এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় কৈলাসনাথ গ্রেপ্তার না হলেও পরবর্তীকালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে তাঁকে ১৮ মাস কারাবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৪২ সালের অগাস্ট মাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়তেও কৈলাসনাথকে নয় মাস কারারুদ্ধ করে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। কৈলাসনাথ কাটজু ছিলেন কংগ্রেসি আন্দোলনের অন্যতম একজন অর্থদাতা এবং পরামর্শপ্রদানকারী। রাজনীতি ছাড়াও শিক্ষা এবং সাংবাদিকতা প্রয়াসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন কৈলাসনাথ। ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-এর মতো বিখ্যাত সংবাদপত্র প্রকাশকারী সংস্থা ও অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও এলাহাবাদের প্রয়াগ মহিলা বিদ্যাপীঠের আচার্য ছিলেন কৈলাসনাথ কাটজু এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরেও কৈলাসনাথ বিভিন্ন সময়ে নানা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের দিনটি থেকে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে কৈলাসনাথ কাটজু ওড়িশার প্রথম রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৮ সালের ২০ জুন পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ২১ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় রাজ্যপাল হিসেবে নিযুক্ত হন কৈলাসনাথ এবং আগামী তিন বছর অর্থাৎ ১৯৫১ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালে মান্দসৌর নির্বাচনী এলাকা থেকে লোকসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন কৈলাসনাথ এবং সেবছরই জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ১৯৫১ সালের ৫ নভেম্বর চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর স্থানে ভারতবর্ষের চতুর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন কৈলাসনাথ এবং ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই দায়িত্ব বহন করেন তিনি। ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারিতেই ভারতের চতুর্থ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি এবং ১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি এই পদ তাঁকে ছাড়তে হয় কারণ তিনি মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই সময় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেবছরই অর্থাৎ ১৯৫৭ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদে বহাল ছিলেন তিনি। এছাড়াও কৈলাসনাথ কাটজু বিভিন্ন সময়ে সাধারণ প্রশাসন, গৃহ, প্রচার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, সমন্বয় এবং দুর্নীতি বিরোধী দপ্তরের দায়িত্বও সামলেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে। 

কেবলমাত্র দক্ষ এক রাজনীতিবিদ এবং একজন ধুরন্ধর আইনজীবীই নন, কৈলাসনাথ কাটজু নিঃসন্দেহে সুলেখকও বটে৷ তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে যেসমস্ত ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছেন, তাঁর রচিত গ্রন্থে সেইসব সময়ের জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। ইতিহাসের অন্ধকার অন্তরাল থেকে কত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থগুলির কারণে। তাঁর লেখা সেইসব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি হল, ‘এক্সপেরিমেন্ট ইন অ্যাডভোকেসি : আ কলোসাস ইন দ্য কোর্টস অফ জাস্টিস’, ‘দ্য ডে’জ আই রিমেমবার’ এবং ‘রেমিনিসেন্স অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট ইন অ্যাডভোকেসি’। মূলত আইন অনুশীলন সম্পর্কে এবং আইনজীবী হিসেবে তাঁর জীবন কেমন কেটেছিল তাঁরই অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যাবে এই বইগুলিতে। যেহেতু তিনি বেশ কিছু ঐতিহাসিক মামলার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, তাই ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরিখে এই গ্রন্থগুলির প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট হবার নয়। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও কৈলাসনাথ কাটজু যেসব নিবন্ধ রচনা করেছিলেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নিবন্ধ হল ‘সাম জাজেস অ্যান্ড ল’ইয়ার হুম আই নো’। এছাড়াও তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হল ১৯৬৬ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট ভবনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতাটি।

১৯৬৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৫৫মিনিটে এলাহাবাদে নিজের বাড়িতেই কৈলাসনাথ কাটজুর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান